পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ চাষযোগ্য উর্বর সমভূমি হওয়ায় বাংলাদেশে জীবন ধারণ ব্যবস্থা অত্যন্ত সহজ সরল। এছাড়া এখানকার বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সবসময় বিশ্ববাসীকে আকৃষ্ট করেছে। শত শত বছর পূর্বে যখন কোনো সীমা রেখা, সীমান্ত প্রহরী বা কাঁটাতারের বাঁধা ছিল না; তখনও এদেশ ছেড়ে কেউ অন্য দেশে যেত না। বরং দূরদেশের বহু মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন, ধর্মপ্রচার ইত্যাদি নানা কাজে এদেশে আগমনের পর আর ফিরে যাননি। বৈবাহিক বন্ধনের মাধ্যমে স্থায়ী বসতি গড়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। তাই জাতি হিসেবে আমরা সংকর জাতি এবং জনসংখ্যার ঘনত্বের বিচারে পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ ও ভিনদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনের সাথে দেশীয় সংস্কৃতি তাল মিলাতে না পারায় বর্তমান বাংলাদেশে এক সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিদেশি বুর্জোয়া শ্রেণি নানা সময়ে এদেশের কিছু দুষ্ট লোকের সহায়তায় নানা কৌশলে সাধারণ মানুষের উপর জুলুম, অত্যাচার ও নির্যাতন চালিয়ে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করেছে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ, সামাজিক অবক্ষয় ও নানামুখী অপতৎপরতা ইতিহাসেরই একটি ধারাবাহিকতা মাত্র। তবে বাঙালি জাতি যখনই কোনো ঘোর সংকটে নিপতিত হয়েছে, সকল বিভেদ ভুলে নিজস্ব চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে তা প্রতিহত করেছে।
বাঙালি জাতির চিরায়ত অভ্যাস বা রীতি-নীতিগুলোই হলো বাঙালি সংস্কৃতি বা কৃষ্টি। খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-আশাক, চাল-চলন, খেলা-ধুলা, লোক বিশ্বাস, ব্যবহার্য জিনিসপত্র, স্থাপত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, অভিনয়, কারুকলা, ভাষা, সাহিত্য, ধর্ম, রাজনীতি, সামাজিক লোকাচার ইত্যাদি প্রতিটি উপাদানেই রয়েছে বাঙালি জাতির নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়। সংস্কৃতি পরিবর্তন, সংযোজন ও বিয়োজন হয়ে থাকে। হাজার বছর আগের বাঙালি সংস্কৃতি আর আজকের বাঙালি সংস্কৃতি এক নয়। তবে সে পরিবর্তনে মৌলিক চেতনা বিসর্জন কাম্য নয়। আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনাবোধ একদিনে জন্ম নেয়নি। এ চেতনা জাতি হিসেবে আমাদেরকে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করেছে। বাঙালি চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাঙালি স্বাধীনতা সূর্যকেও ছিনিয়ে এনেছে। বাঙালি সংস্কৃতি যেমন সকল ধর্ম, বর্ণ ও শ্রেণি-পেশার মানুষকে সুখে-দুঃখে, উৎসব-আনন্দে পরস্পরের সহযোগী করেছে। তেমনি পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন, জাতীয় ঐক্য, দেশপ্রেম ও মানবতাবোধেও উজ্জীবিত করেছে। পারস্পরিক সুসম্পর্ক, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বড় অংশ।
এক সময় জারি-সারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, বাউল, কীর্তণ, ঘাটুগান, ধামাইল, নাটক, যাত্রাগান, পালাগান, সুরে ও ছন্দে কিতাব পাঠ ইত্যাদি নানা ধরনের গান ও বাজনায় মুখরিত থাকত বাংলার প্রতিটি পাড়া-মহল্লা। শীতের রাতে বাদ্যযন্ত্রের সুমধুর আওয়াজ সবাইকে ঘরছাড়া করে ছাড়ত। রক্ষণশীল পরিবারের ছেলে-মেয়েরাও সবার চোখ ফাঁক দিয়ে হাজির হতো এসব অনুষ্ঠানে। পালাগানে দুইপক্ষের রসেভরা কথা একদিকে যেমন সবাইকে আনন্দ দিত। অন্যদিকে জ্ঞানগর্ভ বিতর্ক সাধারণ মানুষের নৈতিক চেতনা ও জ্ঞানের পরিধিকেও সমৃদ্ধ করত। সারারাত জেগে গান শুনার পর ভোরবেলা থেকে গৃহস্থালি কাজে কারও কোনো ক্লান্তি তো থাকতই না, বরং অনুষ্ঠানের নানা বিষয়ে জমে উঠত সরব আলোচনা। পরিবারের সকলে মিলে অনুষ্ঠান উপভোগ করা ছিল খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এসব অনুষ্ঠানে কোনো অশ্লীলতা না থাকলেও বিনোদনের কোনো ঘাটতি থাকত না। অনুষ্ঠানের আয়োজকরাও ছিলেন সমাজে শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। পাড়ার ছেলে-বুড়ো সকলেই ছিলেন তাদের সর্বাত্মক সহযোগী।
খেলাধুলাতেও সারাবছরই মেতে থাকত প্রতিটি গ্রাম। হা-ডু-ডু, ফুটবল, দাঁড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুট, কানামাছি, নৌকা বাইচ, ঘোড়দৌড়, লাঠিখেলা ইত্যাদির ছিল নিয়মিত আয়োজন। এসবকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত অনেক ক্লাব, সমিতি ও নানা সংগঠন। যা এলাকায় অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করত এবং নতুন নেতৃত্বও সৃষ্টি করত। বর্ষার দিনে বৈঠক ঘর, ঘরের বারিন্দা ও মেঝেতে কিংবা চৈত্রের দুপুর বেলায় গাছের ছায়ায় জমে উঠত সাপ-লুডু, দাবা, কেরাম, চোর-পুলিশ, গুটি খেলা ইত্যাদিতে। বয়সী ছেলে-মেয়েরা একসাথে অংশগ্রহণ করলেও মা-বাবার মনে কোনো সন্দেহ বা সংকোচ থাকত না। গান-বাজনা ও খেলাধুলার অনাবিল আনন্দ মানুষকে যেমন প্রাণবন্ত করে রাখত; তেমনি এসবের কল্যাণে অনেকেই দেশ-বিদেশে খ্যাতির শিখরেও আরোহণ করেছেন। বর্তমানে গ্রাম কিংবা শহর কোথাও আর আগের মতো খেলাধুলার চর্চা নেই।
বাঙালি সংস্কৃতির আরেক অন্যতম আকর্ষণ হলো মেলা। এটিই একমাত্র সংস্কৃতি যা এখনও কিছুটা টিকে আছে। মেলার তিলের খাজা, নাড়ু-ঝুড়ি, মিষ্টান্ন, নতুন খেলনা, সার্কাস, নাগরদোলায় চড়া শিশুমনে ব্যাপক বিনোদন দিয়ে থাকে। বর্তমানে গ্রাম্যমেলা ছাড়াও বইমেলা, কৃষিমেলা, বৃক্ষমেলা, বাণিজ্যমেলা, বিজ্ঞান মেলা, প্রযুক্তিমেলা ইত্যাদি নানা ধরনের মেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। যা সব শ্রেণির মানুষকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। পশু-পাখি পোষা, বাগান করা, বনভোজন, শিক্ষা সফরও আমাদের সংস্কৃতির বড় অংশ।
বই মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু। সুন্দর জীবন ও সমাজ গঠনে বইপড়ার বিকল্প নেই। আজ থেকে পঁচিশ ত্রিশ বছর আগেও পাড়া-মহল্লায় বইপাঠের যথেষ্ট চর্চা ছিল। কেউ কোনো নতুন বই পড়ার পর অন্যের কাছে তার অনুভূতি প্রকাশ করত। অন্যরাও তা ধার নিয়ে পড়ত। কখনও কখনও বইয়ের বিশেষ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ একজন অন্য জনকে পড়েও শুনাত। বইপাগল এসব ব্যক্তিদের উদ্যোগে কিছু ছোট পাঠাগারও গড়ে উঠতে দেখা যেত। তথ্য প্রযু্িক্তর বিকাশে আজ সেই সমঝধার পাঠক আর নেই।
বাঙালি সাংস্কৃতিক চেতনা ধারণের ফলেই লালন, হাসন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জয়নুল, জীবনানন্দ, আব্দুল আলীম, বাউল করিমদের মতো বিশ্ববিখ্যাত হাজারো শিল্পী, কবি, সাহিত্যিকদের আমরা পেয়েছি। রাজনৈতিক অঙ্গণেও ছিল বাঙালিদের সরব বিচরণ। পলাশীর যুদ্ধ থেকে শুরু করে এমন কোনো আন্দোলন সংগ্রাম নেই যেখানে বাঙালির স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ছিল না। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান ভাগ ইত্যাদি সবকিছুতেই ছিল বাঙালি শ্রেষ্ঠত্ব। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা ভাসানী, তাজ উদ্দিন আহমেদের মতো বিশ্বজনীন নেতৃত্ব তৈরির পিছনে রয়েছে বাঙালির সচেতন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসের অর্জনগুলো আমাদের সমৃদ্ধ রাজনৈতিক চেতনার ফসল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন আর আগের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চর্চা নেই। তাই আর আগের মতো বড় বড় কবি, সাহিত্যিক, বাউল, শিল্পী, দার্শনিক ও প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক নেতাদের জন্ম হয় না। তবে জন্ম হয় জঙ্গী, সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চাঁদাবাজ, ধর্ষকদের মতো ঘৃণ্য নরপিশাচদের।
আধুনিকতার নামে অন্যের অনুকরণ করতে গিয়ে নিজের অস্তিত্বকেই অপমান করেছি এবং নিজেরাও ধ্বংসের মুখে পতিত হয়েছি। আবহাওয়াবিজ্ঞানের ভাষায়, কোনো এলাকার বায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে বায়ুর ঘনত্ব কমে গেলে সেখানে বায়ু শূন্যতা সৃষ্টি হয়। তখন পার্শ্ববর্তী এলাকার শীতল বায়ু ওই এলাকার দিকে প্রবল গতিতে ধেয়ে আসে এবং ফলশ্রুতিতে ঘূর্ণিঝড় বা টর্নেডোর সৃষ্টি হয়। আজ শহর থেকে গ্রাম সব জায়গায় বাঙালি সংস্কৃতি চর্চাতেও মারাত্মক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। আর এ শূন্যতার সুযোগে ভিনদেশি নানা অপসংস্কৃতি জায়গা দখল করে নিচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে এসব অপসংস্কৃতি দ্রুত আমাদের সংস্কৃতির উপর টর্নেডো ছোবল হানছে। তবে আজও যারা বাঙালি চেতনার ছিটেফোঁটা ধারণ করে চলেছেন, তাঁরাই এ দেশটাকে কোনো রকমে টিকিয়ে রেখেছেন।
অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্য বিষয়গুলোর অবহেলা কাম্য নয়। ব্যক্তি, সমাজ, পরিবেশ, পৃথিবী, সর্বোপরি আত্মার উন্নয়নকেও গুরুত্ব দিতে হবে। পশ্চিমাদের মতো শুধু চাকচিক্যময় জাগতিক উন্নয়নকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনকে যেন হত্যা করে আমরা যেন লেজহীন শিয়ালের জাতিতে পরিণত না হই। জেনে অবাক হতে হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রে আত্মহত্যার হার পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে অনেক বেশি। অথচ কী নেই তাদের! তাই অর্থনৈতিক উন্নয়নই শেষ কথা নয়। নৈতিক এবং আত্মিক উন্নয়নটাও জরুরি। মনে রাখতে হবে, সন্তুষ্ট চিত্তে অতি সাধারণ জীবনযাপনেও শান্তি পাওয়া যায়, কিন্তু অসন্তুষ্ট চিত্তে বিলাসবহুল রাজপ্রাসাদেও তা পাওয়া যায় না।
বর্তমান আনন্দহীনতার অপসংস্কৃতি সবাইকে একগুয়ে, একাকী এবং হতাশাগ্রস্ত করে দিচ্ছে। মানুষ এখন প্রাণহীন ফেসবুক, টুইটার ব্যবহার করতে করতে মেজাজ বিগড়ে খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। সাংসারিক হতাশা ও বিষাদ থেকে মুক্তি পেতে নানা অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছে। অনেকেই সুকৌশলী ধর্ম ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে সন্ত্রাসের মতো ঘৃণ্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এসব অবক্ষয় থেকে মুক্তি পেতে আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে। বাঙালি জাতি বারবার নানা ষড়যন্ত্রের শিকার হলেও কখনও কোনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করেছে। দেশও জাতির সম্মান রক্ষা করেছে।
বাঙালি চেতনার সকল দুয়ার বন্ধ করে শুধু বক্তৃতা-বিবৃতিতে সীমাবদ্ধ থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না। শিক্ষা, রাজনীতি, ধর্ম সকল ক্ষেত্রে বাঙালি জাতীয় চেতনাবোধ জাগ্রত করতে হবে। তবেই মানবতাবোধে উজ্জীবিত বাঙালি জঙ্গিবাদসহ সকল অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে বিজয়ী হবে। সকল সংকটে বাঙালি চেতনাই আমাদের রক্ষাকবচ।
লেখক: মোহাম্মদ হাফিজ উদ্দিন, প্রভাষক, মোহনগঞ্জ সরকারি কলেজ
গবেষক ও কলাম লেখক, নেত্রকোনা।
পাঠকের মতামত: