‘শিক্ষা’ অতি ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু জগতের সবচেয়ে মূল্যবান শব্দ এটিই। মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষণেই কিছু না কিছু শিখে থাকে। মানুষের জানার আগ্রহ স্বভাবগত। হাজার বছর ধরে পূর্ব পুরুষদের আহরিত এবং সঞ্চিত জ্ঞান ধারণ করে মায়াভরা এ পৃথিবীটাকে আরো সুন্দর করে গড়ে তোলার জন্য মানুষকে নিরন্তর গবেষণা ও সাধনা করতে হয়। তাই মানুষ প্রতিক্ষণই শিখতে চায়। জগতে শিখার যেমন কোনো শেষ নেই, তেমনি শিক্ষা গ্রহণেরও কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই। মানুষ সারা জীবন পরিবার, সমাজ, বিদ্যালয় ইত্যাদি নানা ক্ষেত্র থেকে শুধু শিখেই যায়। তাই কবি সুনির্মল বসু বলেছেন-
“বিশ্ব জোড়া পাঠশালা মোর,
সবার আমি ছাত্র,
নানানভাবে নতুন জিনিস
শিখছি দিবারাত্র।”
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে অন্যতম। রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে শিক্ষার বিকল্প নেই। রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা, উপবৃত্তি কিংবা বিনা পয়সায় খাবার ইত্যাদির কথা না ভেবে বেশিরভাগ মানুষ এখন নিজের তাগিদেই সন্তানকে শিক্ষা দানের জন্য অনেক অর্থ ব্যয় করতেও কৃপণতা করছে না। প্রতিটি বাবা-মা এখন তাঁদের সন্তানকে নামীদামি ও ভালো স্কুলে পড়াতে চান। ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে সক্ষম এমন কোনো বাবা-মাকে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না, যারা তাদের সন্তানকে স্কুলে পাঠাচ্ছেন না। প্রতিটি পরিবারেই এখন শিক্ষার ক্ষুধা জাগ্রত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাজেটেও শিক্ষা এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত। রাষ্ট্র এখন শিক্ষার পিছনে ব্যয়কে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হিসেবে মূল্যায়ন করছে।
সমাজের প্রতিটি স্তরেই শিক্ষার ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও কিছু কথা থেকেই যায়। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের পেছনে এই যে এতো অর্থ, শ্রম এবং মেধা ব্যয় করছি। রাষ্ট্রের ভাষায় বিনিয়োগ করছি। তার থেকে আমরা কতটুকু আউটপুট পাচ্ছি? তার সফলতাই বা কতটুকু? আমরা তা কীভাবে নির্ণয় করব? আমি শিক্ষার সাথে টাকার তুলনা করতে চাইছি না। আমার আলোচনার বিষয়ও সেটি নয়। তবে অর্থ অবশ্যই একটি সুন্দর জীবনের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় উপাদান। তথাপিও অর্থকেই একমাত্র মানদ- হিসেবে পরিমাপ করতে চাই না।
জন্মগত বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মানুষ অত্যন্ত দুর্বল একটি প্রাণী। কিন্তু বুদ্ধিমত্তায় সে শ্রেষ্ঠ। অন্য প্রাণী হতে আলাদা। মানুষ নিজে একা তার চাহিদাগুলোকে পূরণ করতে পারে না, বিধায় সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করে। একে অপরকে সহযোগিতা করে থাকে। আর এ সহযোগিতামূলক মনোভাবই সমাজে নিয়ে আসে শান্তি। সামাজিক শান্তি যাতে বিঘিœত না হয়, তার জন্য আছে রাষ্ট্র, আইন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রতিটি মানুষকেই রাষ্ট্রের সকল নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। জ্ঞানার্জনের মধ্য দিয়ে পরিবারিক ও সামাজিক শান্তি বজায় রেখে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে, জীবন-যাত্রাকে অধিকতর সুন্দর করে তোলাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।
সাম্প্রতিক সময়ে আমরা লক্ষ্য করছি যে, সব এলাকাতেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়ছে, শিক্ষার হার বাড়ছে, শিক্ষার ব্যয় বাড়ছে, শিক্ষার উপকরণ বাড়ছে, শিক্ষার উপর গবেষণা বাড়ছে। একই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঘুষ, দুর্নীতি, মাদক, জুয়া, খুন, ধর্ষণ, হত্যার মতো নানারকম জঘন্যতম সামাজিক অপরাধ। সন্তানের হাতে মা-বাবা এবং মা-বাবার হাতে সন্তান খুনের মতো ঘটনা এখন অহরহই ঘটছে। আবার এসব কাজ কেবল অশিক্ষিতজনেরাই করছে তা কিন্তু নয়। বরং উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত লোকদের দ্বারাই এসব কাজ সংঘটিত হচ্ছে অনেক বেশি।
সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। ঐশী নামের মৃত্যুদ-প্রাপ্ত যে মেয়েটি তার বন্ধুদের সহায়তায় নিজের পুলিশ কর্মকর্তা বাবা মাহফুজুর রহমান ও মাকে নিজ বাসাতেই হত্যা করল তার দায় কি বর্তমান শিক্ষার উপর একটুও বর্তাবে না? ঐশীর বাবা মেধাবী ছাত্র ছিলেন বলেই পুলিশ ক্যাডার হতে পেরেছিলেন। আর একজন ক্যাডার কর্মকর্তা তার মেয়েকে অবশ্যই নিজের চেয়ে অনেক বড় মানুষ হিসেবে স্বপ্ন দেখতেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! আপন ¯েœহের সন্তান যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন সুন্দর মানুষ হওয়ার। অথচ সেই বাবা-মা খুন হলেন ¯েœহের সন্তানের হাতে। এটা কি স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিলেন মাহফুজুর রহমান দম্পতি? বনশ্রীতে ফুলের মতো দুই শিশু সন্তানকে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় হত্যা করলেন তাদেরই জন্মদাত্রী মা। এমনটা অতীতে কোথায় কোন সমাজে দেখা গেছে সে ইতিহাস জানা মুশকিল। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এমনকি মসজিদের ইমাম কর্তৃক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির মতো ঘটনা এখন অহরহই ঘটছে। ছোট ছোট কোমলমতি শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না এ ধরনের আদিম পৈচাশিক বর্বরতা থেকে। আজ কতটা নি¤œ পর্যায়ে নেমে গেলে একজন শিক্ষক তার মেয়ের মতো ছাত্রীর দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাতে পারেন। ছাত্রদের দ্বারা শিক্ষক নিগৃহের ঘটনাও কম নয়। নিজ হাতে শিক্ষকের পা ধুয়ে না দেওয়ায় বাদশাহ আলমগীর তার সন্তান এবং শিক্ষকের উপর বেজাড় হওয়ার যে মহান ঘটনা আমরা পুস্তকে পড়েছি। আজ কোথায় সেই ছাত্র এবং শিক্ষক?
অফিস-আদালতে ঘুষ ছাড়া ফাইল না নড়া, রাষ্ট্রের উন্নয়নের সিংহভাগ অর্থ আমলাদের পকেটে ঢুকা, ব্যাংক থেকে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে অস্ত্রের ঝনঝনানিসহ চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, খুন, ধর্ষণ, জঙ্গীপনা এ সকল বড় বড় অপরাধের সবই এখন শিক্ষিতদের দখলে। রাস্তা-ঘাটে যানবাহনে অশিক্ষিত/নিরক্ষর সাধারণ মানুষকে প্রায়ই দেখা যায়, অন্য যাত্রীকে পাশে বসার জায়গা করে দিতে। অথচ সমাজের শিক্ষিত নামধারী সভ্য মানুষদের বেলায় ঘটে তার উল্টোটা। শিক্ষিত মানুষজন অনুনয় বিনয় করে পাশে বসতে পারলেও কোনো খেটে খাওয়া ঘর্মক্লান্ত কুলি, মজুর, শ্রমিক শ্রেণি তাদের পাশে বসতে গেলে সৃষ্টি হয় নানা অযুহাত ও টালবাহানা। বয়স্ক মানুষ এমনকি অনেক রোগীকেও যানবাহনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এই যে নিরীহ কৃষক-শ্রমিক যাদের শ্রমে-ঘামে স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে দেশ অনেকটাই এগিয়ে গেছে, তারা আজও সমাজের প্রতিটি পদে পদে বঞ্চিত-অপমানিত । আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা তাদেরকেও সম্মান দিতে শিখায় না।
তা হলে একটি প্রশ্ন তো জাগতেই পারে। আমরা এতো টাকা ব্যয় করে শিক্ষার নামে যা অর্জন করছি তা কি শুধু সার্টিফিকেট নামের আবর্জনা? এ শিক্ষা না পারছে কোনো কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা দিতে; না পারছে নৈতিকগুণ সম্পন্ন সুন্দর মানুষ উপহার দিতে। এদেশে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের পরও লক্ষ লক্ষ লোক বেকার হয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করে। পুঁজিবাদি সমাজে সকল ক্ষমতা এখন সমাজের শিক্ষিতজনের হাতে। অশিক্ষিত মানুষ ভাগ্যের জোরে বড় কিছু হতে পারলেও তাকে নির্ভর করতে হয় শিক্ষিত লোকদের উপরই। প্রশাসন, আইন, বিচার সবকিছু শিক্ষিত লোকদের হাতে থাকা সত্ত্বেও কেন সমাজে নৈতিক পরিবর্তন নেই। তা নতুন করে ভাবার এখনই সময়। না ভাবলে যা হবার তাই হবে। কারণ প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।
নিরক্ষর শ্রেণির অপরাধ শুধু লেখাপড়া না জানা। আর এ না জানার পেছনেও আছে শিক্ষিত শ্রেণির অপরাধ। মানবজীবন যেহেতু স্বল্পকালের তাই নৈতিক শিক্ষার জন্য আলাদাভাবে সময় বের করা অত্যন্ত কঠিন। তাই বিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদেরকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে দীর্ঘদিনের অনিয়মের ফলে শিক্ষকতা পেশাতেও অনেক অযোগ্য নীতিভ্রষ্ট লোকের আগমন ঘটেছে। তাদেরকে যেহেতু একেবারে কেঁচি দিয়ে কেটে ফেলার সুযোগ নেই। তাই সকলের মধ্যে বিবেকবোধ জাগ্রত করে তোলার প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যালয়গুলোতে মানবতার শিক্ষা দিতে হবে। মানবতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের দেশকে, দেশের মানুষকে, সর্বোপরি এ পৃথিবীটাকে ভালোবাসার শিক্ষা দিতে হবে। এক সময় আমরা পড়তাম-পানির অপর নাম জীবন। এখন বলা হয়-বিশুদ্ধ পানির অপর নাম জীবন। শিক্ষাক্ষেত্রেও স্লোগান পরিবর্তন করা দরকার। যুগ যুগ ধরে আমরা পড়ে আসছি যে, শিক্ষা জাতির মেরুদ-। কিন্তু সে শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই এখন আমাদের মেরুদ- ভেঙে দিচ্ছে। যে শিক্ষা সৎ ও আদর্শবান মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না; তা শিক্ষাই নয়। তাই এখন বলতে হবে-সুশিক্ষাই জাতির মেরুদ-। তাই সমাজের সর্বস্তরে সুশিক্ষার বীজ রোপন করতে হবে। শুধু পরীক্ষায় পাশ নয়, শিক্ষার্থীর হৃদয়-মন যাতে সুন্দর হয়, জাতীয় চেতনা ও মানবতাবোধে উজ্জীবিত হয়; সে দিকে লক্ষ্য রেখে সিলেবাস প্রণয়ন ও পাঠদান পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। আদর্শবান শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। এজন্য জাতীয় স্বার্থেই আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই আমাদের সোনার বাংলা একদিন সোনার মানুষে ভরে উঠবে।
লেখক:
মোহাম্মদ হাফিজ উদ্দিন
প্রভাষক ও কলাম লেখক, নেত্রকোনা।
যধভরুঁফফরহ.হবঃ@মসধরষ.পড়স
পাঠকের মতামত: