বাংলাদেশের বহুরূপী রাজনীতির দাবার চালের রহস্য বেশ জমে উঠেছে। শাসক দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ সাহেবের সাম্প্রতিক একটি মন্তব্যে নিরুত্তাপ রাজনৈতিক অঙ্গনে হঠাৎ করেই প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। তার বক্তব্য নিয়ে খোদ শাসক দলেই দেখা দিয়েছে নিদারুণ বিস্ময় এবং সৃষ্টি করেছে নানামুখী কৌতূহল উদ্দীপক প্রশ্নের। লোকজন বলাবলি করছেন, কেন তিনি হঠাৎ করে এমনতরো নির্জলা সত্য অথচ বোমা ফাটানো উচিত কথাটি বলে বসলেন, তিনি স্বেচ্ছায় বলেছেন নাকি আদিষ্ট হয়ে বলেছেন— অথবা তিনি কি সুদূরপ্রসারী কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কথাগুলো বলেছেন নাকি মনের অন্তর্নিহিত বেদনা এবং নিত্যকার অযাচিত যাতনার কষ্ট থেকে বলেছেন? সৈয়দ সাহেবের শত্রুরা মনে করছেন এ যাত্রায় তিনি আর রক্ষা পাবেন না, অন্যদিকে তার মিত্ররাও বেজায় খুশি। তাদের বক্তব্য, সৈয়দ সাহেব সত্যিকার অর্থেই সৈয়দ বংশের সন্তান এবং তিনি যথার্থভাবেই তার প্রয়াত পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের সম্মান রেখেছেন। তিনি যা বলেছেন তা সব আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মনের কথা এবং তার এ বক্তব্যকে দেশের বেশির ভাগ মানুষই সমর্থন করে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে তার বক্তব্যের ভাবার্থ এবং কিছু চৌম্বক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সামান্য আলোচনা আবশ্যক—
ছাত্রলীগের একটি অনুষ্ঠানে সৈয়দ আশরাফ তাদের সরকারের অন্যতম শরিক দল জাসদ সম্পর্কে বলেন— দলটির ধারক ও বাহকেরা শতভাগ ভণ্ড। তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। তাদের কারণে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং দেশ অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসরতার দিকে চলে যায়। এত কিছুর পরও জাসদেরা এখন আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তি করে। এদের একজনকে আবার মন্ত্রিত্বও দেওয়া হয়েছে। একটি হঠকারী সংগঠনের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য এবং সরকারে তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পদ দেওয়ার ফলে যে ভুল হয়েছে তার প্রায়শ্চিত্ত আওয়ামী লীগকে একদিন না একদিন করতেই হবে। তিনি জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ভুল তত্ত্ব এবং সেই তত্ত্বমতে লাখ লাখ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য জাসদ নেতৃত্বের বহুরূপী ভণ্ডামি সম্পর্কেও বিশদ কথাবার্তা বলেন। তার বক্তব্য বিদ্যুেবগে কয়েক মিনিটের মধ্যেই সব অনলাইন পোর্টালের লিড নিউজ রূপে সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে ঝড় তোলে এবং পরের দিন সব দৈনিক পত্রিকার প্রধান শিরোনামে পরিণত হয়।
সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের সূত্রে বর্তমানে তিন খণ্ডে বিভক্ত জাসদ সমস্বরে শক্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। সরকারের সঙ্গে দহরম মহরমে এগিয়ে থাকা তথ্যমন্ত্রী ইনু নিয়ন্ত্রিত জাসদের একাংশের নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং প্রয়াত কর্নেল তাহেরের ভাই আনোয়ার হোসেন তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনার ওই মন্ত্রীকে থামান। উনি ১৪ দলের ঐক্য ভাঙার চেষ্টা করছেন। তিনি আরও বলেন, পরিষ্কারভাবে আমাদের বলে দিতে হবে, ঐক্য চান কি চান না— ১৪ দলের ঐক্য থাকবে কি, থাকবে না? একদিকে আমাদের সভাপতি এবং ১৪ দলের অন্যতম নেতার নামে বিষোদগার করবেন, আর অন্যদিকে জঙ্গি ঠেকাবেন, এটা হতে পারে না। অধ্যাপক আনোয়ার সৈয়দ আশরাফের বিরুদ্ধেও একহাত নেন। তিনি অভিযোগ করেন, সৈয়দ আশরাফ ঠিকমতো মন্ত্রিত্ব চালাতে পারেন না। তার কাজকর্মও ভালো না। তিনি তাকে আবোল-তাবোল প্রলাপ বকা বাদ দিয়ে আপন দায়িত্ব অর্থাৎ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন। জাসদের এই অংশের অন্য নেতৃবৃন্দও নানারকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। স্বয়ং ইনু সাহেবও মুখ বন্ধ রাখতে পারেননি। তিনি জাসদের ১৯৭২-৭৫ সালের কর্মকাণ্ডকে অতীত ইতিহাস বলে মন্তব্য করেন এবং বর্তমান সময়টি কাদা ছোড়াছুড়ির জন্য উপযুক্ত নয় বলে মতামত ব্যক্ত করেন। জাসদের অপর অংশের নেতা আ স ম আবদুর রব বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য জাসদ নয়, আওয়ামী লীগই দায়ী। সংবাদপত্রে পাঠানো এক বিবৃতিতে জনাব রব বলেন, আওয়ামী লীগের ভুল রাজনীতির কারণে দলটি ৭৫-পূর্ব সময়ে সম্পূর্ণ গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাদের নানামুখী কঠোর তত্পরতা এবং গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে উগ্রপন্থা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং বঙ্গবন্ধু জনগণকে ফেলে দলীয় সুবিধাবাদীদের আবর্তে বন্দী হয়ে পড়েন। সর্বক্ষেত্রে দলের বাড়াবাড়ি, সীমা অতিক্রম, একদলীয় ঔপনিবেশিক শাসনের আদলে বাকশাল চালু এবং জনগণ থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হওয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ক্ষেত্র তৈরি করে। তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় এবং তার মৃত্যুর পর সুবিধাভোগী হিসেবে নিত্যনতুন বিপর্যয় সৃষ্টি করতে থাকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করে এবং দলটির শীর্ষ নেতারা ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত লাশ দাফন-কাফন বাদ দিয়ে বঙ্গভবনে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেন। নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ার জন্য খোন্দকার মোশতাকের পদধূলি গ্রহণকারীরাই জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করেন। আওয়ামী লীগের সেই সরকারই দেশে প্রথম সামরিক শাসন জারি করে। ইতিহাসের এসব চির সত্য এবং নিজেদের ভুল রাজনীতি আওয়ামী লীগের স্বীকার না করাই হবে অতিমাত্রার ভণ্ডামি।
হাল আমলে জাসদ (ইনু) থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া অন্য জাসদ নেতা মঈন উদ্দীন খান বাদল অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে কোনো বিবৃতি দেননি। তবে তিনি ইতিপূর্বে দেশি-বিদেশি মিডিয়াতে বেশ খোলাখুলিভাবেই ১৯৭২-৭৫ সালে জাসদের কর্মকাণ্ডকে জাস্টটিফাইড করার চেষ্টা করেছেন। সম্প্রতি লন্ডনের এসএ চ্যানেলের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমরা মুজিবের রক্তাক্ত বিরোধিতা করেছিলাম এবং তার পতনও চেয়েছিলাম। ওই সময়ের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জনাব বাদল বলেন, জাসদ যখন মনে করল, এই সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিকভাবে আর কোনো মতেই এগোনো যাচ্ছে না তখন প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েই গণবাহিনী গঠন করা হলো এবং হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া হলো। আওয়ামী লীগের রক্ষীবাহিনী, মুজিব বাহিনীর সদস্যরা এবং অন্যান্য মিলিশিয়া অস্ত্র নিয়ে নিরস্ত্র জাসদ কর্মীদের নির্বিচারে হত্যা করা আরম্ভ করল, তখন পরিস্থিতির চাপে আমরা অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হলাম। শুরু হলো মারামারি, তারা আমাদের মেরেছে আর আমরাও মেরেছি। মুজিব বাহিনীর সদস্য কর্তৃক ৭২-৭৫ সময়ে ২০ হাজার জাসদ কর্মী মারা পড়েছে— বাংলাদেশের মাটি চাপ দিলে আমাদের রক্তও বেরিয়ে আসবে।
বিষয়টি নিয়ে পার্লামেন্টেও আলোচনা হয়। সরকারের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং সংসদে সরকার সমর্থিত বিরোধী দলের প্রভাবশালী সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করেন যে, সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য ঠিক আছে। তিনি জাসদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ তোলেন এবং বলেন, জাসদের লোকেরা এদেশে ২০ লাখ লোককে গুলি করে মেরেছে। সংসদের বাইরে রাস্তাঘাট, হোটেল রেস্তোরাঁ, ঘরোয়া আড্ডা এবং মিডিয়া ভুবনে সৈয়দ আশরাফের বক্তব্য এবং সেই বক্তব্যের জাসদীয় প্রতিক্রিয়া নিয়ে নানামুখী রসাল আলাপ শুরু হয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, এটা একটা পাতানো খেলা, জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য সরকার এবং তাদের মিত্র জাসদ অত্যন্ত সুকৌশলে এই খেলা খেলছে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে সোহাগী জাহান তনুর নির্মম হত্যাকাণ্ড, পুলিশ কর্তা বাবুলের স্ত্রী মিতু হত্যাকাণ্ড এবং এই দুই দুর্ঘটনার মাঝে ঘটে যাওয়া অনেকগুলো নির্মম, নিষ্ঠুর ও চাঞ্চল্যকর গুপ্ত হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশ-বিদেশে সরকারবিরোধী প্রবল সমালোচনার ঝড় বইছিল। সরকার কোনো হত্যাকাণ্ডের ক্লু বের করা তো দূরের কথা হত্যার মোটিভ সম্পর্কেও দেশবাসীকে প্রাথমিক ধারণা দিতে পারছিল না। ফলে দেশবাসীর মধ্যে গুপ্তহত্যার শঙ্কা এবং ভয় মারাত্মকভাবে ভাইরাস আকারে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে মিতু হত্যার পর সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে চাঞ্চল্যকর ভয়ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জঙ্গি, সন্ত্রাসী, অস্ত্রধারী অপরাধী এবং দাগি আসামিদের গ্রেফতার করার জন্য সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়।
চলমান রাজনীতি, গুপ্তহত্যা, সন্ত্রাস-মারামারি, যানজট, সড়ক দুর্ঘটনা ইত্যাদি নিয়ে দেশবাসীর নানামুখী হতাশা, আশঙ্কা এবং ক্ষোভের সঙ্গে হঠাৎ করে যুক্ত হয় ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট সংক্রান্ত নতুন সমস্যা। বাজেটে আরোপিত নতুন আয়কর নীতিমালার বেড়াজাল, ভ্যাট আদায়ের নিত্যনতুন ফন্দি এবং বিভিন্ন শুল্ক কাঠামো নিয়ে আমদানিকারক, শিল্পপতি, সাধারণ ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক এবং সাধারণ কর পরিশোধকারীরা চরম হতাশা ব্যক্ত করেন। এরই মধ্যে শুরু হয়ে যায় রমজান। এ সময়ের অসহনীয় যানজট, অতিরিক্ত ব্যয়, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং পানি সমস্যায় নাকাল হওয়া দেশবাসীর ওপর নতুন আজাব এসে উপস্থিত হয় পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানের নামে গণগ্রেফতার। মাত্র তিন দিনের মধ্যে পুলিশ ১২ হাজারেরও বেশি লোককে গ্রেফতার করে দেশের কারাগারগুলোতে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করে ফেলে। বিরোধী দল অভিযোগ করে যে, সরকার তাদের বেহাল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য গণগ্রেফতারের মাধ্যমে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর জুলুম চালিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করতে চায় এবং পরোক্ষভাবে সাধারণ মানুষকে সরকারের অপকর্মের ব্যাপারে চুপ থাকার জন্য সতর্ক সংকেত দিচ্ছে সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে।
পুলিশের নির্বিচার গণগ্রেফতার নিয়ে সর্বমহল থেকে সমালোচনার ঝড় উঠতে থাকে। সবাই এটাকে পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্য এবং মাল কামানোর ধান্ধা হিসেবে আজ্ঞা দিতে থাকে। কেউ কেউ বলতে থাকে, এটা হলো সরকারের পক্ষ থেকে প্রদত্ত বাড়তি ইনাম যার মাধ্যমে পুলিশ সদস্যরা মহাধুমধামে ঈদের আনন্দ ফুর্তি করতে পারবে। পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্য নিয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মুখ খোলেন এবং অত্যন্ত কঠোর ভাষায় পুলিশের সমালোচনা করেন। অন্যদিকে পুলিশের আইজিও তার বাহিনীর কর্মকাণ্ডের সাফাই গাইতে গিয়ে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানের বক্তব্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে অনেকের সমালোচনার পাত্র হন। পরিস্থিতি যখন সর্বকুলে বেসামাল অবস্থা পয়দা করছিল ঠিক তখনই আওয়ামী লীগ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের জাসদবিরোধী বোমা ফাটানো মন্তব্য পত্রপত্রিকার শিরোনাম হতে শুরু করল। চাপা পড়ে গেল গত কয়েক মাসের চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলো। ফলে এটা যে একটি সরকারি কৌশলপত্র এবং সাজানো নাটক তা প্রমাণের জন্য কিছু লোক দশমুখে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমরা সেদিকে না গিয়ে সৈয়দ আশরাফের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য এবং দলে তার বর্তমান অবস্থান নিয়ে কিছু যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনা করলেই সম্মানিত পাঠক আজকের শিরোনামের রহস্য উন্মোচন করতে পারবেন।
সৈয়দ আশরাফ বর্তমানকালের সবচেয়ে রহস্যময় অথচ জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ১/১১ থেকে আজ অবধি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত থাকা জনাব আশরাফের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো— তিনি কম কথা বলেন, অপ্রয়োজনীয় কথা বলেন আরও কম এবং দলের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে আলাদা এবং নিজস্ব বলয় সৃষ্টি করেন না। দলের সব শীর্ষ নেতাই আলাদা গ্রুপ তৈরিতে সচেষ্ট থাকেন এবং আপন মতাদর্শের নেতা-পাতিনেতা এবং কর্মী পরিবেশিষ্ট থেকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করেন। সেই দিক থেকে সৈয়দ আশরাফ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি এসব ঝক্কিঝামেলা এড়িয়ে চলেন এবং সর্বদাই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের বাইরে খুব একটা পা বাড়ান না। তার চরিত্রের অতি উত্তম দুটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো— তার বিরুদ্ধে কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত রাগারাগি, দুর্ব্যবহার এবং হুমকি-ধামকি বা ডাটফাটের অভিযোগ নেই। অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে কোনো আর্থিক অনিয়ম বা দুর্নীতির অভিযোগ তার শত্রুরাও করতে পারেননি।
সৈয়দ আশরাফের চরিত্রের রহস্যময়তা হলো— তিনি কেন এবং কীভাবে অথবা কোন ক্ষমতাবলে কিংবা জাদুবলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক রেখে এতদিন স্বপদে বহাল থাকতে পারলেন! তার সম্পর্কে আরেকটি রহস্যময়তা হলো তার প্রতিদ্বন্দ্বী অথবা তার শুভার্থীরা আসলেই জানেন না যে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সম্পর্কটি কি খুব ভালো নাকি খুব মন্দ। তারা এ কথাও বুঝতে পারেন না যে, প্রধানমন্ত্রী কি তাকে পছন্দ করেন নাকি করেন না। আমার মনে হয় প্রধানমন্ত্রী তাকে পছন্দ করেন। কারণ তিনি অন্যান্য আওয়ামী নেতার মতো নন। আবার প্রধানমন্ত্রী তাকে অপছন্দও করেন এ কারণে যে, তিনি অন্য সব আওয়ামী নেতার মতো নন। রহস্যের এই গোলকধাঁধা থেকে স্বয়ং সৈয়দ আশরাফও বিমুক্ত নন। কারণ তিনি নিজেও জানেন না, প্রধানমন্ত্রী কি তাকে সত্যিই পছন্দ করেন— নাকি করেন না! তিনি এ কথাও জানেন না যে, প্রধানমন্ত্রী তাকে কতটুকু পরিমাণ পছন্দ কিংবা অপছন্দ করেন। তার টিকে থাকার মূলমন্ত্র হিসেবে আমার কাছে মনে হয়, স্বপ্রণোদিত হয়ে তিনি কোনো কিছুই করেন না অনুরূপভাবে নির্দেশিত না হয়ে কোনো কিছুই বলেন না।
সৈয়দ আশরাফের সাম্প্রতিক বক্তব্য এবং নানামুখী প্রতিক্রিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতির রংধনুর সবগুলো রঙের দুর্বোধ্য মিশ্রণ যেমন থাকতে পারে তেমনি থাকতে পারে আবহমান বাংলার চিরায়ত রাজনীতির জটিল কোনো দাবার চাল। আমরা যারা আমজনতা তারা ওসব জটিল বিষয়ে না গিয়ে বরং মজাদার চটুল একটি কাহিনী শুনে বর্তমান সময়ে নিজেদের করণীয় কি তা বুঝে নেই। কাহিনীটি হলো— সমবয়সী তিন বন্ধু অনুরূপ সমবয়সী তিন বান্ধবীর কাছে বেশ ঘটা করে প্রেম নিবেদন করল। মেয়েরা গলায় বেশ ঢঙ্গি ঢঙ্গি ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল— তাহলে শোন! আমরা তিনজনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি কোনো কবি ছাড়া কাউকে বিয়ে করব না। তা তোমাদের যদি কাব্য প্রতিভা থাকে তবে তিনজনে তিনটে কবিতা রচনা করে পুনরায় আমাদের কাছে আস— তোমাদের কবিতা শুনে আমাদের পছন্দ হলে আমরা অবশ্যই ফুল দিয়ে বরণ করে নেব।
মেয়েদের কথা শুনে ছেলেগুলোর সে কি আনন্দ! তারা উল্লাস করতে করতে বাড়ি ফিরল এবং বিস্ময়কর কবিতা লিখে কীভাবে প্রেমিকাকে চমকিত করে দেবে এমন স্বপ্নে বিভোর হয়ে রাত পার করল। পরদিন তিন বন্ধু মিলে সারা দিন চেষ্টা করল— এরপর আরও কয়েক দিনের চেষ্টার পর বুঝল কবিতা রচনা বড়ই কষ্টের। কীভাবে কবি হব এবং কবিতা রচনা করব তখন প্রশ্নের জবাবে একজন তাদের বলল, সমুদ্রতীরে যাও, শুনেছি ওখানে গেলে নাকি কবি কবি ভাব আসে! তিন বন্ধু সমুদ্রতীরে গিয়ে সারা দিন কাটাল কিন্তু কবিতা আর হলো না। বালুতটে দাঁড়িয়ে তারা বিষণ্ন মনে সমুদ্রের ঢেউ এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্য দেখছিল। এমন সময় একজন চিৎকার করে বলল— ইউরেকা! মাথায় কবিতা এসে গেছে। এ কথা বলেই সে রচনা করে ফেলল— ‘ওই দ্যাখো! সূর্য যেন, ডুবিল যেন’, দ্বিতীয় বলল, আমারও এসেছে। তার কবিতার ছন্দ হলো— ‘এই দ্যাখো! সমুদ্রের ঢেউ যেন নদীর তরঙ্গ যেন।’ তৃতীয়জন কবি হওয়ার আনন্দে চিৎকার করে বলল— ‘আরে শোনো— আমরা তিনজন যেন, কুলুর বলদ যেন।’
লেখক : কলামিস্ট।
পাঠকের মতামত: