কক্সবাজারের রামু উপজেলার সন্ত্রাস কবলিত জনপদ ঈদগড় ইউনিয়নে আইনশৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। বিগত ২৪ ঘন্টায় এ ইউনিয়নে বসত বাড়িতে আওয়ামীলীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা, সিএনজি চালকসহ ২ জনকে অপরহরণ এবং একটি বাড়িতে শসস্ত্র ডাকাতদল লুটপাটের চেষ্টা চালিয়েছে। এরমধ্যে অপহৃত সিএনজি চালককে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দিলেও অপর অপহৃত যুবককে ছেড়ে দেয়ার আশ্বাসে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করছে অপহরণকারিরা।
এরআগে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চমেক হাসপাতালে নেয়ার পথে বৃহষ্পতিবার (১৬ জুন) সকালে প্রাণ হারান ঈদগড় ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের প্রচার সম্পাদক মহিউদ্দিন (৪৮)। পেশায় পল্লী চিকিৎসক মহি উদ্দিন স্থানীয় ফয়েজ আহমদ মিয়াজীর ছেলে।
বুধবার (১৫ জুন) দিবাগত রাত দুইটায় রামুর ঈদগড় ইউনিয়নের শরীফপাড়া এলাকায় নিজ বাড়িতে মহি উদ্দিনকে দূর্বৃত্তরা গুলি করে। বৃহষ্পতিবার রামু থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) প্রভাষ চন্দ্র ধর ঘটনাস্থলে যান। এ ঘটনায় পুলিশ ওই এলাকার প্রবাসী আছাদুজ্জামানের স্ত্রী দেলোয়ারা বেগমকে (৪২) আটক করেছে।
এদিকে একই রাতে ঈদগড় ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের কুলারপাড়া এলাকায় রেজাউল করিমের বসত বাড়িতে ডাকাতদল হানা দিয়েছে। ডাকাতদল দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে। তবে বিষয়টি জানাজানি হলে স্থানীয় জনতা এগিয়ে আসায় ডাকাতদল মালামাল লুট না করে সটকে পড়ে।
এছাড়া একইদিন (বৃহষ্পতিবার) সকাল আটটায় ঈদগড়-ঈদগাও সড়কের হিমছড়ি ঢালা নামক এলাকায় একদল অস্ত্রধারি সন্ত্রাসী নুরুল আজিম নামের এক অটোরিক্সা (সিএনজি) চালককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। অপহৃত নুরুল আজিম ঈদগড় বড়বিল এলাকার বদিউল আলমের ছেলে। তার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, অপহরণকারিরা তাদের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, মুক্তিপণ দিয়ে অপহৃত নুরুল আজিমকে ছেড়ে দেয়ার কথাবার্তা চলছিলো।
এসব ঘটনার রেশ না কাটতেই শুক্রবার (১৭ জুন) দিবাগত রাত দেড়টায় সশস্ত্র অপহরণকারি চক্র ঈদগড় ছগিরাকাটা এলাকার নিজ বাড়ি থেকে সৌদি ফেরত জিয়া উদ্দিন বাবুল নামের এক যুবককে অপহরণ করে নিয়ে যায়। অপহৃত জিয়া উদ্দিন বাবুল (৩০) ওই এলাকার কৃষক হাফেজ আহমদের ছেলে।
অপহৃত বাবুলের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, অপহরণকারিরা তাকে (বাবুল) গভীর বনাঞ্চলে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে অপহরণকারিরা তাদের মোবাইল ফোনে কল করে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে আসছে। দাবিকৃত মুক্তিপণ না দিলে তাকে হত্যা করার হুমকী দিচ্ছে। স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. মনিরুজ্জামান অপহরণের বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
ঈদগড় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এএসআই শাহ আলম জানিয়েছেন, অপহরণের বিষয়টি জানার পর থেকেই অপহৃত ব্যক্তিকে উদ্ধারে পুলিশ অভিযান শুরু করেছে।
২৪ ঘন্টার ব্যবধানে ঈদগড় ইউনিয়নে একজনকে গুলি করে হত্যা, সড়কে সিএনজি চালককে অপহরণ করে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়া, আরো এক যুবককে অপহরণ করে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি এবং একটি বসত বাড়িতে ডাকাত দলের হানা দেয়ার ঘটনায় পুরো ইউনিয়নে জনমনে আতংক বিরাজ করছে।
শরীফ পাড়ায় নিহত আওয়ামীলীগ নেতা মহি উদ্দিনের বাবা ফয়েজ আহমদ মিয়াজী জানিয়েছেন, সন্ত্রাসীরা রাতে বাড়ির দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে তার ছেলেকে গুলি করা হয়েছে। ঘটনার পর মহি উদ্দিনকে প্রথমে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে চমেক হাসপাতালে নেয়ার পথে সকাল আটটায় (বৃহষ্পতিবার) সে প্রাণ হারায়।
তিনি আরো জানান, পরিকল্পিতভাবে তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি এ ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে গ্রেফতার করে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে আইনশৃংখলা বাহিনীর প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নিহত মহি উদ্দিনের সাথে স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তির সাথে জমি নিয়ে বিরোধ ছিলো। সম্প্রতি তা প্রকাশ্যে রূপ নেয়। এ বিরোধের জের ধরেই সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে মহি উদ্দিনকে বাড়িতে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতে পারে।
ঈদগড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ ভূট্টো জানিয়েছেন, মহি উদ্দিন হত্যা নিয়ে এলাকায় জনমনে ধু¤্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। ৬ মাস পূর্বে মহি উদ্দিনের সাথে বিরোধের জের ধরে খুন হন স্কুল শিক্ষক নুরুচ্ছাফা। এখন শোনা যাচ্ছে, সেই নুরুচ্চাফার লোকজনই তাকে হত্যা করতে পারে। আবার কেউ কেউ বলছেন, মহি উদ্দিন এলাকার একটি সংঘবদ্ধ ডাকাত চক্রকে ১০ লাখ টাকার বিনিময়ে নুরুচ্ছাফাকে হত্যা করেছিলো। পরে চাহিদামত অর্থ না দেয়া ডাকাতদলটি ক্ষিপ্ত হয়ে মহি উদ্দিনকে হত্যা করেছে। এছাড়া নিরীহ লোকজনকে হয়রানির উদ্দেশ্যে তৃতীয় পক্ষও এ হত্যাকান্ড ঘটানো আশংকা রয়েছে। এমন হলে এ মামলায় অনেকে বলির পাঠা হতে পারেন। তিনি আরো জানান, নিহত মহি উদ্দিনের বিরুদ্ধে ডাকাতি, অপহরণ সহ বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে। কয়েকবার তিনি গ্রেফতার হয়ে কারাভোগও করেন।
জানা গেছে, এ ঘটনায় আটক হওয়া দিলোয়ারা বেগম ৬ মাস পূর্বে খুন হওয়া শিক্ষক নুরুচ্ছাফার বড় ভাইয়ের স্ত্রী। ঈগগড় ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বাঙ্গালী জানিয়েছেন, মহি উদ্দিন ঈদগড় ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। তাকে এলাকার প্রভাবশালী মহল পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। তিনি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান এবং দোষিদের শাস্তি দাবি করেন।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আলমগীর হোসেন জানিয়েছেন, এটি সুপরিকল্পিত হত্যাকান্ড। তিনি আরো জানান, এ ঘটনায় সুষ্ঠু বিচার না হলে এলাকায় আরো হত্যাসহ আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতির আশংকা রয়েছে।
রামু থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) প্রভাষ চন্দ্র ধর জানান, হত্যাকান্ডের প্রকৃত কারন উদঘাটনের চেষ্টা চলছে। পুলিশ এ ঘটনায় দেলোয়ারা বেগম নামের এক মহিলাকে আটক করেছে। তাকে জিজ্ঞাষাবাদ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে বৃহষ্পতিবার রাতে তারাবীর নামাজের পর মোহাম্ম শরীফ পাড়া জামে মসজিদ মাঠে নিহত মহি উদ্দিনের নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তাকে স্থানীয় কবর স্থানে দাফন করা হয়।
ঈদগড় ইউনিয়নের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে এলাকার আইনশৃংখলা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। লোকজন বাড়ির বাইরে যেতেও ভয় পাচ্ছে। আবার অনেকে বাড়ির ভিতরে নিরাপদ থাকতে পারছে না। বছরের পর বছর এভাবে হত্যা, অপহরণ, ডাকাতি, চুরি, ছিনতাই, অব্যাহত থাকলেও প্রশাসন তেমন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে মানুষের আতংকও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
পাঠকের মতামত: