চিকিৎসকের অবহেলায় মৃত্যর অভিযোগ ওঠেছে চমেক হাসপাতালের পূর্ব গেইটস্থ ‘চিটাগাং পেশেন্ট কেয়ার’নামের এক প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, ওই রোগীর মৃত্যুর কথা গোপন রেখে গতকাল শুক্রবার ভোরে নগরীর ওআর নিজাম রোডের চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে স্থানান্তর করে রোগীকে। কিন্তু চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নেয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করেন মেট্রোপলিটন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাই মেট্রোপলিটন হাসপাতাল তাকে আর ভর্তি করেনি। হতভাগী রোগীর নাম সায়মা শিকদার (২২)। তিনি নোয়াখালীর সহকারী জেলা জজ মোরশেদুল আলমের স্ত্রী। মৃত্যুর প্রায় ৫ ঘণ্টা আগে তিনি এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। সায়মা নাসিরাবাদ চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজে সমাজতত্ত্ব বিভাগের সম্মান ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী। তিনি নগরীর অক্সিজেন কাপ্তাই লিঙ্ক রোডের নয়াহাট এলাকার সাংবাদিক বিল্ডিংয়ের এমদাদ উল্লাহর মেয়ে। গত বছর ১৭ মার্চ সায়মা-মোরশেদ দম্পতির বিয়ে হয়।
নিহতের আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাক্সক্ষীরা এ ঘটনায় চিকিৎসকের অবহেলা ও রোগীকে অতিরিক্ত চেতনানাশক ঔষধ দেয়ার ফলেই সায়মার অকাল মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেন। এদিকে, স্ত্রীর মৃত্যুর খবর শুনে মোরশেদুল আলম প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ায় তাকে বিশেষ চিকিৎসার মাধ্যমে ঘুম পাড়ানো হচ্ছে বলে জানান তাঁর একাধিক সহকর্মী।
বৃহস্পতিবার রাতে সন্তান সম্ভবা সায়মার প্রসূতিকালীন ব্যাথা উঠলে সায়মার গাইনি চিকিৎসক কাজল রেখা রানীর পরামর্শে তাকে নগরীর ৫৭ কেবি ফজলুল কাদের রোডের মায়াবিনী বিল্ডিংস্থ পেশেন্ট কেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীকে তাৎক্ষণিক সিজারিয়ান অপারেশন করতে হবে বলে জানান রোগীর আত্মীয়কে। এরপর সার্জন ডাক্তার কাজল রেখা রানী ও এনেসথেটিস্ট ডা. দেবাশীষ তালুকদারের নেতৃত্বে অপারেশন করা হয়। সফল অপারেশনে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। যথাসময়ে মায়ের জ্ঞান না ফেরার ব্যাপারে ডা. দেবাশীষের কাছে জানতে চাইলে তিনি রোগীর স্বজনকে এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে বলেন। পুত্র সন্তান পুরোপুরি সুস্থ বলে জানান সায়মার পরিবার।
নিহতের ভাই এনামুল হাসান বাবু জানান, ডা. কাজল রেখা রানীর তত্ত্বাবধানে সায়মার প্রসূতিকালীন চিকিৎসা চলছিল। তার সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ ছিল ২০ জুন। কিন্তু বৃহস্পতিবার দিনগত রাতে সায়মার ব্যাথা উঠলে ডা. কাজল রানীকে ফোন করেন আমার মা। তিনি সায়মাকে দ্রুত প্যাশেন্ট কেয়ারে নিয়ে আসতে বলেন। এরপর রাত একটার দিকে পেশেন্ট কেয়ারে ভর্তির পর তাঁকে সিজারিয়ান করতে হবে বলে সায়মার পরিবারকে জানানো হয়। অন্যথায় মা ও সন্তান দুজনের ক্ষতি হতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন। অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করানোর পর রাত ২ টার দিকে আমার বোন এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। সন্তানটি সম্পূর্ণ সুস্থ রয়েছে। কিন্তু আমার বোনকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করা হচ্ছিল না। আমরা জানতে চাইলে ডাক্তাররা সন্তোষজনক কোন জবাব না দিয়ে চিন্তা করতে মানা করেন। ভোরে ডাক্তার কাজল রানী ও ডা. দেবাশীষ জানায় রোগীর অবস্থা খারাপ, তাকে আইসিইউ আছে এরূপ কোন হাসপাতালে ভর্তি করা দরকার। সকাল পৌনে ৭ টার দিকে তাকে মেট্রোপলিটন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। মেট্রোপলিটনের ডাক্তাররা নিহতের পরিবারকে জানান, এ রোগীর ঘণ্টাখানেক আগেই মৃত্যু হয়েছে। তাই তাকে ভর্তি করা যাচ্ছে না।
নিহতের পরিবার পূর্বকোণকে জানান, দুই চিকিৎসক ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে শিগগির মামলা দায়ের করা হবে।
মেট্রোপলিটন হাসপাতালের প্রেসক্রিপশনে ইংরেজিতে উল্লেখ করা হয়, ব্রট ডেথ, নট এডমিটেড। মৃত্যুর কারণের ডিজিসের কলামে লেখা রয়েছে তিনটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন, এরপর এইচ/ও এবং ক্যাপিটাল লেটারে এলইউসিএস (‘জিরো ’পিওডি)।
এখানে পিওডি’র অর্থ হচ্ছে, পোস্ট অপারেটিভ ডেলিভারি আর জিরো মানে অপারেশনের দিন মৃত্যু হয়েছে। এলইউসিএস সিজারিয়ান অপারেশনের উল্লেখ রয়েছে। তবে তিনটি প্রশ্নবোধক দিয়ে রোগের কারণ নির্ণয় হয়নি।
এ ব্যাপারে পেশেন্ট কেয়ার হাসপাতালের বক্তব্যের জন্য ফোন করা হলে, গতকাল শুক্রবার রাতে নার্স জান্নাতুল ফেরদৌস এ ব্যাপারে অবগত নয় উল্লেখ করেন। ডিউটি ডাক্তার মশিউর রহমান জানান, পেশেন্ট কেয়ারে কোন রোগীর মৃত্যু হয়নি।
পেশেন্ট কেয়ার হাসপাতালের সহকারী ব্যবস্থাপক মতিউর জানান, হাসপাতালে সায়মা নামের গর্ভবতী মহিলা ভর্তি হয়েছিলেন। তবে, তিনি এ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেননি। তাকে রাতে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে অন্য একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে জেনেছি।
এ ব্যাপারে ডাক্তার কাজল রেখা রানীর মুঠোফোনে দৈনিক পূর্বকোণ থেকে বারবার ফোন দেয়া হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কার্ডিয়াক সার্জারির রেজিস্ট্রার ডা. দেবাশীষ তালুকদার পূর্বকোণকে জানান, রোগীর চিকিৎসায় আমাদের কোন অবহেলা ছিল না। কোন চিকিৎসকই চান না তার রোগীর মৃত্যু হোক। কারণ এতে চিকিৎসকের সুনাম ক্ষুণœ হয়। তিনি বলেন, অতিরিক্ত ব্লাড প্রেশারের কারণে ব্রেইন স্ট্রোকেই রোগী মারা গেছে। তিনি আরো বলেন, রাত দুইটার দিকে একজন ডেলিভারি রোগী গুরুতর অসুস্থ শুনে হাসপাতাল ছুটে যাই। এরপর সিজারিয়ানের মাধ্যমে তার একটি পুত্র সন্তান জন্মে। কিন্তু রোগীর প্রেসার বেড়ে যায়। পরে আমাদের তত্ত্বাবধানে রোগীর উন্নতি করে। ঘণ্টা দুয়েক পর তার অবস্থার অবনতির কথা শুনে আমি আবার ছুটে যাই। এরপর ব্লাড প্রেসার বেড়ে যাওয়ায় আর শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়ায় তাকে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হয়। আমি নিজেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ’র প্রফেসর আক্তার সাহেবকে ডেকে নিয়ে যাই। তিনিই রাত ৪টার দিকে লাইফ সাপোর্ট দেন সাইমাকে। এরপরও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নিয়ে যাই। ডাক্তার আক্তার ও আমি নিজেও রোগীর সাথে যাই, সেখানে যাওয়া আমাদের প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু রোগীর প্রতি বেশি কেয়ার নিতেই একাজ করেছি। একজন বিচারকের স্ত্রী বলেই আমরা বাড়তি কেয়ার নিয়েছি। তিনি বলেন, ওই রোগীর মেট্রোপলিটন হাসপাতালেই মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু হাসপাতালের বিল বাঁচানোর জন্যেই তাকে ভর্তি দেখাইনি। আমি নিজেও বিলের পরিমাণ বাঁচানোর জন্য মেট্রোপলিটনকে অনুরোধ করেছি। যদি, রোগী বেঁচে যেতেন তাহলে তাকে ভর্তি দেখানো হতো। তাছাড়া পেশেন্ট কেয়ার হাসপাতালের বিল পরিশোধ করেছেন ডাক্তার কাজল রেখা রানী এবং মেট্রোপলিটন হাসপাতালের বিল পরিশোধ করেছি আমি নিজেই। রোগীর পরিবারের মানসিক অবস্থা বিবেচনা করেই মানবিক কারণে আমরাই এ বিল পরিশোধ করি। অতিরিক্ত এনেসথেটিক ডোজ দেয়ার অভিযোগ তিনি অস্বীকার করে বলেন, স্ট্রোক করেই রোগীর মৃত্যু হয়েছে। আমার বা অন্য কোন চিকিৎসক কিংবা হাসপাতালের কোন অবহেলা ছিল না।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি ট্রাইবুনালের রেজিস্ট্রার ও সহকারী জজ মো. শোয়াইব উদ্দিন খান পূর্বকোণকে জানান, পেশেন্ট হাসপাতাল সায়মাকে অতিরিক্ত এনেসথেটিক ডোজ দিয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত ডোজ দেয়ার বিষয়টি গোপন রেখে নিজেদের অক্ষমতা প্রকাশ করতে চায়নি। এরপর সায়মার মৃত্যু হওয়ার বিষয়টি গোপন রেখে তাকে পেশেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মেট্রোপলিটন হাসপাতালে ভর্তি করেছে। যা খুবই দুঃখজনক।
সহকারী জজ শোয়াইব খান আরো জানান, মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ডা. দেবাশীষকে মেট্রোপলিটনের এক সিনিয়র ডাক্তার ভর্ৎসনা করে বলেন, ওভারডোজ দেয়ার বিষয়টি গোপন করেছেন কেন। যখন জ্ঞান ফিরছিল না তখন নিয়ে এলেতো রোগীকে বাঁচানো যেত। এরপর ডাক্তার দেবাশীষ নিহতের স্বামী মোরশেদের কাছে ভুল হয়ে গেছে উল্লেখ করে ক্ষমা চান।
জানতে চাইলে নোয়াখালী অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলমগীর ফারুকী পূর্বকোণকে বলেন, একজন সুস্থ মাকে পেশেন্ট হাসপাতাল ভুল চিকিৎসা দিয়ে মেরে ফেললো। আর ভুল চিকিৎসার বিষয়টি গোপন না করে তাৎক্ষণিক অন্যত্র স্থানান্তর করলে তিনি বেঁচে যেতেন। তিনি আরো বলেন, স্ত্রীর মৃত্যুর সংবাদে মোরশেদ আলম অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তাকে এখন ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়ানো হয়েছে।
একজন সহকারী জজ পূর্বকোণকে জানান, পেশেন্ট কেয়ার হাসপাতালটির অভ্যন্তরভাগ খুবই অপরিচ্ছন্ন। কিন্তু অবহেলা করে সায়মার মৃত্যুর পর গতকাল শুক্রবার সকাল থেকেই হাসপাতালটি পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতায় নিয়োজিত রয়েছে হাসপতাল কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, গতকাল শুক্রবার বিকেল ৫ টায় পাঁচলাইশ নাসিরুদ্দিন মহিলা কলেজ মাঠে মরহুমের নামাজে জানাজাশেষে পারিবারিক কবরস্থানে তার দাফন সম্পন্ন করা হয় বলে মরহুমের নিকটাত্মীয় এক্সিম ব্যাংকের অফিসার আলমগীর কবির নাফিস পূর্বকোণকে জানান।
পাঠকের মতামত: