সমাজের প্রতিটি শ্রেণীপেশার মানুষ তাদের সন্তানদের মানুষের মতো মানুষে পরিণত করার জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠান। পাশের বাড়ির লোকজনের প্রভাবে সন্তানদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নামেন। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, নাচ-গানের স্কুল, কম্পিউটার ও ছবি আঁকা প্রশিক্ষণ, সুন্দর হাতের লেখা প্রভৃতি আয়ত্তে বাবা-মায়ের দৌঁড় যেনো শেষ হওয়ার নয়। আধুনিকতার বলয়ে সন্তানদের গড়ে তোলতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত কতিপয় ব্যতিত অধিকাংশই এক একটা যন্ত্রমানব তৈরি হয়। এসব তথাকথিত আধুনিক প্রজন্মের কাছে সমাজ, সংসার, প্রতিবেশি, বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের তেমন কোনো মূল্য থাকেনা। ছোটবেলা থেকে পারিপার্শ্বিক নানান চাপে তাদের মনন বিকশিত হওয়ার পরিবর্তে সংকোচিত হয়ে পড়ে।
শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হলো জীবন সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা অর্জন করা, জীবনকে মননে ধারণ ও লালন করা। কিন্তু বাস্তবতার নেতিবাচক মানসে এখন চারপাশের সবকিছুই যেনো এনিমেটেড, এখানে জীবনের দেখা মেলা ভার। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করাই এখন শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে, আর আয়-উপার্জনের পথ বিবেচনায় উচ্চশিক্ষার বিষয় নির্ধারিত হচ্ছে। জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য এখানে নির্বাসিত। ব্যস্ততার জীবনে কেবল কাজের মূল্যায়ন দিতে গিয়ে মানুষের কথা, আলাপন, আড্ডা সবই অপ্রয়োজনীয় প্রতীয়মান হচ্ছে। আর পারস্পরিক সম্পর্কগুলো ক্রমেই নিষ্প্রাণ, অসাড় হয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষামূলক, সেবামূলক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার তেমন কোনো বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ধীরে ধীরে সবক্ষেত্রে বাণিজ্যিকীকরণের মরণফাঁদ। ফলে শুরুতে যে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয় একসময় তা না-ই হয়ে যায়। মনুষ্যত্বের চাষাবাদ করার ক্ষেত্রগুলো সীমিত হয়ে আসছে। ঠিকে থাকার নেশায় মানুষের আসল চেহারাগুলো ভয়ঙ্কররূপে আবির্ভূত হচ্ছে। ফায়দা হাসিল করার উদ্দেশ্যে কথা দেয়া, আর শক্তিমান অভিনেতায় মুখোশ পরিধান জীবনকে করে তুলছে কঠিন থেকে কঠিনতম। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হবে মানুষই। তখন অন্য প্রজাতি পৃথিবীর শাসনভার গ্রহণ করলেও অবাক হওয়ার লোক খোঁজে পাওয়া যাবে না।
শিক্ষিত সমাজ গঠনে আধুনিক ও আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন শিক্ষকের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। এধরনের আলোকিত মানবের সংস্পর্শে যেকোনো শিক্ষার্থী তার ভবিষ্যৎ জীবনের একটি ছায়া দেখতে পায়। শিক্ষকের আদর্শ হয়ে উঠে তার পথচলার অনুপ্রেরণা। কিন্তু একজন ব্যক্তিত্বহীন ও সাইনবোর্ডধারী শিক্ষকের নেতিবাচক প্রভাবে তছনছ হয়ে যেতে পারে একটি জাতি তথা ছাত্রসমাজের উন্নয়নের মানচিত্র। তাই একটি সুসভ্য ও অনুকরণীয় জাতি গঠনে শিক্ষক নির্বাচনকে বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অটুট রাখতে হবে। আর সুষ্ঠু ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। শিক্ষকের দক্ষতা ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।
আদর্শবিচ্যুত শিক্ষকের শাস্তির ব্যাপারে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শাস্তি বহাল রাখতে হবে। আইন সবার জন্য সমান ও সমভাবে প্রযোজ্য। আধুনিক মননের মানুষ গঠনে বিশ্বায়নের ধারণাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। গণমাধ্যমের নীতিমালায় সময়োপযোগী সংশোধনের ব্যবস্থা করতে হবে। একটি শুদ্ধতম ও প্রগতিশীল গণসাংবাদিকতার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। জবাবদিহিতার মাপকাঠিকে সর্বদা সমুন্নত রাখতে হবে। ব্রান্ড আর সুনামই যেনো শেষ কথা না হয়। গুণগতমান ও অবকাঠামোগত সক্ষমতার সমন্বয়ে বিচার ব্যবস্থাকে নিয়ত প্রয়োগ, জরুরীভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। ভুল স্বীকার করার সংস্কৃতি চালু করতে হবে। আর অনুশোচনাই যেনো কারো একমাত্র অবলম্বন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মনে রাখা দরকার, সত্য ও সুন্দরের আহ্বান করাই একজন মানুষের প্রধানতম কাজ।
শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির অর্থ সবাইকে অনুধাবন করতে হবে। কেবল লোক দেখানো আদর্শের বুলি দিয়ে জাতি গঠন করা যায় না। জ্ঞান অর্জনের খাত গুলোকে সহজলভ্য ও সহজবোধ্য করতে গবেষকদের দিনরাত পরিশ্রম করতে হবে। শিক্ষার্থীদেরকে সম্পদের প্রয়োজনীয়তা, সদ্ব্যবহার ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করতে হবে। বাস্তবতার নির্মম চেহারায় তারা যেনো যন্ত্রে পরিণত না হয় সেদিক খেয়াল রেখে একটি সুন্দরতম জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারলেই ন্যুনতম জ্ঞানের আলোকপাত সূর্যসম হবে। বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে চির উন্নত শিরে অটুট থাকুক। জয় বাংলা।।
কবি ও সাংবাদকি।।
পাঠকের মতামত: