ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

পাহাড় কাটার মামলা বাড়ে তবুও থামেনা!

এম. বেদারুল আলম, কক্সবাজার ::

# পিএমখালী রেঞ্জে ১০জনের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা
# ৭৮ টি পাহাড়ের মাটি কেটে সাবাড়
# অভিযানের আগেই জেনে যায় পাহাড়খেকোরা
# ২ বছরে শুধু শহরেই প্রাণহানি ১১ জন

বর্ষা সবে শুরু। শুরু হয়েছে পাহাড় কাটার প্রতিযোগিতা। কর্মকর্তা আসে যায়। থামেনা পাহাড় কাটা। অভিযানে গেলে কচকচে নোট। না হলে ডাম্পার আটক। অফিসে ডাম্পার আটক করে এনে মোটা টাকায় আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। বছরে মাটি ভর্তি একই ডাম্পার ৭/৮ বার আটক হয় আবার টাকার বিনিময়ে ছাড়। এ যেন আটক-ছাড়ের খেলা। মাঝে মধ্যে বন বিভাগের উঠানে বসে আটককৃত ডাম্পার মালিকদের দেন দরবার। সিওআর মামলার নামে কয়েকবার জরিমানা আবার ছাড়। ডাম্পার মালিকদের সব পথ চেনাজানা। তাই দেদারছে পাহাড় সাবাড় করলেও সমস্যা নেই। পাহাড় খেকোদের নামে ডজন মামলা। মামলা দিয়ে ফলাফল শূন্য। টাকায় ছাড় পেলে র্নিভয়ে আবার পাহাড় কাটে। এভাবেই চলছে পাহাড় কাটার মহোৎসব। বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন তারা প্রভাবশালী। জনবল সংকট। অভিযান চলে নিয়মিত। তাদের আটকের পর জামিনে বের হয়ে যায়। খোদ পাহাড়খেকোদের কাছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অসহায়। পরিবেশ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে রয়েছে এন্তার অভিযোগ।

কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন সরকার বলছেন পাহাড় কাটা বন্ধে চেষ্টা চালাচ্ছি। মামলা দেওয়ার পর জামিনে এসে পুণরায় কাটছে পাহাড়।

পাহাড় কাটার কয়েকটি স্পট ঘুরে দেখা যায়, পাহাড়ের উপর থেকে মাটি কেটে দিলেই পানিতে নেমে আসে মাটি। খালি হয়ে যায় জায়গা। তারপর দখল। জমাট বাধা মাটি শুকালে তা ডাম্পার করে বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করে। এভাবেই চলছে কক্সবাজারের বর্ষা মওসুমে পাহাড়ি এলাকার অবস্থা। যার কারণে প্রতি বছর পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে। শূন্য হচ্ছে অনেক মায়ের বুক। বর্ষা এলেই টনক নড়ে প্রশাসনের। তবে ক্ষয়ক্ষতির আগে তা বেমালুম ভুলে যায় কর্তা ব্যক্তিগণ।

মাঝে মাঝে মামলা হয় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে। যারা পাহাড় কাটছে তারা থাকে নিরাপদে। গত ২ বছরে শুধুমাত্র পাহাড় ধসে মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের। তাও আবার শহরের মধ্যে ৯ জনের। এরপর ও যারা পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি প্রশাসন। ফলে কোন মতেই থামানো যাচ্ছেনা পাহাড় কাটা। বৃষ্টি হলেই কোন না কোন এলাকায় ঘটছে পাহাড় ধস। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। অথচ বন বিভাগ- পরিবেশ অধিদপ্তর- এবং প্রশাসন কে মাসোহারা দিয়েই চলছে নির্বিচারে এ সব পাহাড় কাটা। বর্ষা, গ্রীষ্ম, পাহাড় ধস, কোন কিছুই তোয়াক্কা করছেনা উক্ত শক্তিশালী চক্র। শহরের কলাতলি, লাইট হাউজ, ঘোনার পাড়া, টার্মিনাল এলাকা, রামুর ১১টি পয়েন্ট রাজারকুল, মিঠাছড়ি, কাইম্যারঘোনা, কচ্ছপিয়া কোন পয়েন্ট বাদ যাচ্ছেনা উক্ত পাহাড় খেকোদের কবল থেকে।

জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা, পাহাড় কাটা বন্ধের নোটিশ, স্থানিয় প্রশাসনের সকল বাধা ডিঙ্গিয়ে দেদারছে পাহাড় কাটছে চক্রটি। সদর উপজেলা ও রামুর ১৭টি স্পটে ৪০টি পাহাড় কেটে সাবাড় করেছে চক্রটি। পাহাড়ের মাটি বিক্রি করে ডাম্পারের মালিক হয়েছে এ সিন্ডিকেটের ৬ জন। প্রতিদিনই হরদম চলছে পাহাড় কেটে মাটি বিক্রি। সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটা হয়েছে কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালীর ছনখোলা ,পরানিয়াপাড়া, জুমছড়ি ও কাঠালিয়ামুরায়।

এ ছাড়া তোতকখালী, খুরুস্কুলের তেতৈয়া, তাহের মোহাম্মদের ঘোনা, মুহসিনিয়া পাড়া, ধাওনখালীর ঘোনার পাড়া, ছনখোলার মালি পাড়া, ডিগিরঘোনার বিট, তোতকখালী বিট, পিএমখালী সদর বিটের ২৫টি স্পটে বিনা বাঁধায় চলছে এ পাহাড় কাটা। রাত দিন হরদম পাহাড় কাটলেও অজ্ঞাত কারণে বন্ধ করা যাচ্ছেনা পাহাড় কাটা। মাঝে মধ্যে অভিযান পরিচালিত হলেও মাঠেই টাকার কাছে অসহায় আত্মসর্মপণ করে দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে। আবার বন বিভাগের নিচু সারির কয়েকজন কর্মকর্তা সিন্ডিকেট এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের লোক দেখানো অভিযানের কারণে উল্টো পাহাড় কাটা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকে শুধুমাত্র পাহাড়ের মাটি বিক্রি করেই ২/৩টি ডাম্পারের মালিক হয়েছে।

পিএমখালীর পাহাড়কাটা বন্ধে প্রশাসনের তৎপরতা প্রশংসনীয় হলেও রক্ষা পাচ্ছেনা পাহাড়গুলো। রেঞ্জ কর্মকর্তা মোঃ আবদুল জব্বারের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে পাহাড় কাটা ও মামলার ভয়াবহ চিত্র। মাত্র ১ বছরেই পাহাড়খেকোদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২শতাধিক। এরমধ্যে মাত্র ১২ জনের বিরুদ্ধে রয়েছে শ’খানেক মামলা। পিএমখালী রেঞ্জের পাহাড়খেকোদের মধ্যে অন্যতম হল পরানিয়াপাড়ার বাবুলের ৭টি, তোতকখালীর শমসুল আলমের বিরুদ্ধে ৭টি, ডেহেরিয়া ঘোনার ২ ভাই কায়েশ ও বেলালর বিরুদ্ধে রয়েছে ৮টি করে মামলা, তেতৈয়ার বাবুলের বিরুদ্ধে ৬টি, খরুস্কুলের মনিউল হকের বিরুদ্ধে রয়েছে ৮টি, নবাব মিয়ার রয়েছে ৫টি, ছনখোলার জাহাঙ্গিরের বিরুদ্ধে ৩টি মামলা। এলাকায় এবার চিহ্নিত পাহাড় খেকো এবং মাটি বিক্রি করে ৩/৪টি ডাম্পারের মালিক হয়েছে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে। রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুল জব্বার বলছেন আমরা বন আইনের ৩৩/১(ক)(গ) ধারায় মামলা হচ্ছে নিয়মিত। কিন্তু তারা জামিনে এসে পুণরায় পাহাড় কাটছে। আবার অনেকে পলাতক রয়েছে। কৌশলে পুণরায় পাহাড় কাটায় যুক্ত হচ্ছে।

এদিকে নির্বিচারে পাহাড় কাটা নিয়ে জাতীয় ও স্থানীয় কয়েকটি পত্রিকায় বেশ কয়েকবার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশের পর তৎকালিন চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ জগলুর রহমান এবং কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের তৎকালিন কর্মকর্তাসহ একটি টিম পিএমখালীর ভয়াবহ পাহাড় কাটা পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি সিন্ডিকেট প্রধানদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহন করার নির্দেশ দিলেও কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি। ফলে পুণরায় পাহাড় ধস হয়ে বিশাল ক্ষয়ক্ষতির আশংকা করা হচ্ছে। কোন প্রশাসনের বারণ নির্দেশনা তাদের থামাতে পারেনি ১২ বছরে ও। মামলা, প্রশাসনের কোন আইন যেন তাদের কাছে মামুলি ব্যাপার।

দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ ডাম্পার দিয়ে পাহাড় কাটায় আলোচিত সিন্ডিকেটের অন্যতম হলো কক্সবাজার সদরের পরানিয়াপাড়ার বাবুল, নয়াপাড়ার নাসির, মোহাম্মদ আলম, কলাতলির সুমন, ডিকপাড়ার আমান, বাংলাবাজারের মনসুর, আমিন কোম্পানি, নয়াপাড়ার আবদুল্লাহ, হারুন, জানার ঘোনার সজল, তোতকখালীর কায়েস, তার ভাই বেলাল, শমসু, ছনখলার জাহাঙ্গির, খুরুস্কুলের মনিউল হক, নবাব মিয়া, জয়নালসহ ১৪/১৫ জনের বিশাল সিন্ডিকেট।

এদিকে বন বিভাগের মাসোহারার কারণে তথা রক্ষকগন ভক্ষকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার কারণে উত্তর ও দক্ষিন বন বিভাগের উচু পাহাড় আজ বিরান ভুমিতে পরিনত হচ্ছে। শুধুমাত্র পি এমখালী রেঞ্জের ৪টি বিটের ৩৪ টির মত পাহাড় এখন বিরাণভূমি।

পরিবেশ অধিদপ্তর, বন বিভাগ এবং কিছু অসাধু প্রভাবশালী মিলে একাকার হয়ে পাহাড় কেটে বিরাণভুমি করার কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দিয়েছে বলে স্থানিয়দের অভিমত। সর্ষে ভূত থাকার কারণে পাহাড় কাটা বন্ধ করা যাচ্ছেনা কোন মতেই। পুরো জেলা জুড়ে বিশাল এবং চিহ্নিত সিন্ডিকেট ১০/১২ বছর যাবৎ পাহাড় কাটলেও প্রশাসন কোন মতেই থামাতে পারছেনা শুধুমাত্র বন বিভাগের চিহ্নিত মাসোহারা নেওয়া কয়েকজন কর্মকর্তার কারণে। সবুজ পাহাড় বাচাঁতে জরুরি ভিত্তিতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন কক্সবাজারবাসী।

পাঠকের মতামত: