ঢাকা,বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪

৮ বছরে ২১ সাংবাদিক খুন

jaur khunঅনলাইন ডেস্ক :::

‘সাংবাদিকেরা জাতির বিবেক’ কথাটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দায়িত্বশীল লোকের কণ্ঠে শোনা যায়। সমাজের তৃণমূল থেকে রাষ্ট্রের দায়িত্বরত সর্বোচ্চপর্যায় পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রের প্রচার, প্রসার, দুর্নীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি, সফলতা, সব কিছুরই উপস্থাপন প্রকাশ হয় সাংবাদিকের কলমের মাধ্যমে। এ জন্যই সাংবাদিকেরা জাতির বিবেক। যে জাতি তার বিবেককে হত্যা করে বা খুন করে সে জাতি বিশ্বদরবারে কিভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে? এটা একবারও দায়িত্বশীল লোকেরা ভেবে দেখেছেন কি? সুশীলসমাজের অনেকেই বলেন, ‘রাষ্ট্রে যখন টেরোরিজম হয়, তখন সমাজের এলিট ও অ্যারিস্টোক্রেট পারসনরা কোণঠাসা হয়ে যান।’
গত আট বছরে বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে দেশে ২১ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে খুন হওয়া ১৮টি চাঞ্চল্যকর ঘটনার আজ পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি। সর্বশেষ ২ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে দিনদুপুরে পৌরমেয়র হালিমুল হক মিরুর গুলিতে দৈনিক সমকালের সাংবাদিক আবদুল হাকিম শিমুল খুন হন। সাগর-রুনিসহ চাঞ্চল্যকর জোড়াখুনের কোনো প্রকৃত আসামি আজ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়নি।
বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে তিন বছরে প্রায় ৬০০ সাংবাদিক নির্যাতন ও বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। দুই বছরে ৫৫৫টি ঘটনায় ১৮২ জন সাংবাদিক আহত ও ৩৪ জন সাংবাদিক লাঞ্ছিত হয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র ও অধিকারের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। উদ্ধৃত তথ্যানুযায়ী ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশে মোট ২০ জন প্রখ্যাত সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার রাজাবাজারে ভাড়াবাসার তৃতীয়তলায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনির ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সাগর মাছরাঙ্গা টিভি ও রুনি এটিএন বাংলার সিনিয়র সাংবাদিক হিসেবে কাজে ছিলেন। বিগত চার বছরে এ মামলার তদন্ত থানা পুলিশ থেকে গোয়েন্দা পুলিশ হয়ে র‌্যাব পর্যন্ত পৌঁছে। যদিও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা দেন, ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যেই প্রকৃত আসামিদের গ্রেফতার করা হবে’। পুলিশ ও গোয়েন্দাদের ব্যর্থতার জন্য প্রথম থেকেই আদালতের নির্দেশে র‌্যাব পাঁচ বছর ধরে এ মামলার তদন্ত করছে। ২৪ ঘণ্টা তো দূরের কথা, প্রায় পাঁচ বছর সময়েও কোনো আসামিকে চিহ্নিত বা আটক করতে পারেনি, আর কেনই বা তারা খুন হন বা এর মোটিভ কী তারা আজো জানে না। র‌্যাবের তদন্ত, কবর থেকে বেশ ক’দিন পরে লাশ তুলে রাসায়নিক/ভিসেরা পরীক্ষা ও নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য (ফরেনসিক পরীক্ষা) যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণাগারে পাঠানোতেই সীমাবদ্ধ থাকে। ২০০৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর নিখোঁজ হওয়ার তিন দিন পর ধলেশ্বরী নদী থেকে সাংবাদিক আরওঙ্গজেবের লাশ উদ্ধার করা হয়। আরওঙ্গজেব সজীব ইন্ডিপেনডেন্ট টিভি ও বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ অনেকগুলো মিডিয়ার মেডিক্যাল প্রতিনিধি ছিলেন।
২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদকে দুর্বৃত্তরা গুলি করে হত্যা করে আর এ হত্যার জন্য নিহতের পরিবার সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের দায়ী করে। ঠিক তার ক’দিন আগে ১৬ জানুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন সাপ্তাহিক অপরাধ দমন পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক দুর্জয় চৌধুরী দীপু তার নিজ অফিসে। ২০১২ সালের ১৬ জুন যশোরের শার্শায় খুন হন দৈনিক গ্রামের কাগজের শার্শা প্রতিনিধি জামাল উদ্দীন। ১০ জুলাই খুন হন দৈনিক বিবিয়ানার হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ প্রতিনিধি স্টাফ রিপোর্টার জুয়েদ আহমেদ জুনেদ। ২৮ জানুয়ারি ২০১২ নিজ বাসায় খুন হন প্রবীণ সাংবাদিক ও দৈনিক জনতার সম্পাদক ফরহাদ খাঁন (৬০) ও তার স্ত্রী রহিমা খাঁন (৫৫) ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কুরাইল এলাকায় গলা কেটে হত্যা করা হয় দৈনিক ভোরের ডাকের প্রতিনিধি ফরিদুল ইসলাম রঞ্জুকে। একই বছর ৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের দৈনিক আজকের প্রত্যাশা, সাপ্তাহিক সংবাদচিত্র ও আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার সাংবাদিক মাহবুব টুকুল এবং ঢাকার উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের সাপ্তাহিক বজ্রকণ্ঠের সাংবাদিক আলতাফ হোসেনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
২০১০ সালের ৯ মে গুপ্তহত্যার শিকার হন এটিএন বাংলার ক্যামেরাম্যান শফিকুল ইসলাম, একই বছরের ১৮ এপ্রিল হামলায় আহত সাংবাদিক ফাতেহ ওসমানী ২৮ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সাপ্তাহিক ২০০০-এর সিলেট প্রতিনিধি ছিলেন। ২৩ ডিসেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে নিহত হন বরিশালের মুলাদী প্রেস ক্লাবের সভাপতি মনির হোসেন। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীতে খুন হন এনটিভির ভিডিও এডিটর আতিকুল ইসলাম আতিক, জুলাইয়ে খুন হন ঢাকার পাক্ষিক মুক্তমনের স্টাফ রিপোর্টার নুরুল ইসলাম রানা, আগস্ট মাসে গাজীপুরে নিহত হন ঢাকার সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক সময় পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক এম এ হাসান হাবিব, ডিসেম্বরে দৈনিক ইনকিলাবের রূপগঞ্জ সংবাদদাতা ও রূপগঞ্জ প্রেস ক্লাবের সভাপতি আবুল হাসান আসিফ খুন হন। পুলিশের দাবি ছিল আসিফ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, যদিও এটা পুলিশ প্রমাণ করতে পারেনি।
ইউনেস্কো (জাতিসঙ্ঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সংস্থা) থেকে প্রকাশিত ‘প্রতিরোধ ও শান্ত’ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতার মোকাবেলা ও সমাধানের সন্ধান শীর্ষক প্রতিবেদনে সাংবাদিক খুনের সংখ্যার বিবেচনায় বিশ্বের ২০টি প্রধান দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে ১২তম স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ১৯৯২ থেকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ও খুনের শিকার হওয়া ২০টি দেশের নাম তালিকাভুক্ত করা হয়। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মৃত্যু এবং খুন উভয় তালিকার শীর্ষে ইরাকের নাম যুক্ত করা হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে গত দুই যুগে ১৬৭ জন সাংবাদিক মারা গেছেন। এদের মধ্যে ১০৪ জন খুন হয়েছেন। পরে রয়েছে সিরিয়া, ফিলিপাইন, আলজেরিয়া, সোমালিয়া, পাকিস্তান, রাশিয়া, কলম্বিয়া ও ভারতের নাম। একই সময়ে ভারতে ৩৫ জন সাংবাদিক মারা গেছেন, খুন হয়েছেন ২২ জন। এর কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি। উল্লিখিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশে গত দুই যুগে বাংলাদেশে ১৮ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মারা গেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে খুন হয়েছেন ১৭ জন। ১৪টি খুনের ঘটনার এখন পর্যন্ত বিচার হয়নি।
বিভিন্ন সময়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিসহ দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বিদেশে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের সাথে করে নিয়ে যান রাষ্ট্রীয় এবং নিজেদের উন্নয়নকার্যক্রম সারা বিশ্বে এবং নিজ দেশের জনগণের দৃষ্টিগোচরে আনার জন্য। সাংবাদিকেরাও এ কাজটি নির্বিঘেœ করে যান। এ কথা মাথায় রেখে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও সাংবাদিক হত্যাকারীদের প্রকৃত বিচার করে দেশ ও জাতির বিবেক সমুন্নত রাখা জরুরি।

 

পাঠকের মতামত: