নব্বইয়ের দশকে দেশে সক্রিয়ভাবে শুরু চিকিৎসকদের রাজনীতি। তাদের কাছে জিম্মি চিকিৎসাসেবা, সাধারণ রোগীরা। সরকার বদলের সঙ্গে ছড়ি ঘোরানোও বদল হয়। মন্ত্রণালয় থেকে হাসপাতাল—সর্বত্রই প্রভাব বিস্তার করে সরকার সমর্থক চিকিৎসক সংগঠন। কখনো ড্যাব, আবার কখনো স্বাচিপ। রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে থাকা দক্ষ চিকিৎসকরাও অসহায় তাদের কাছে। ড্যাব-স্বাচিপের চিকিৎসা রাজনীতি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন জুলকার নাইন, মাহমুদ আজহার, গোলাম রাব্বানী, জিন্নাতুন নূর ও রফিকুল ইসলাম রনি :::
সংবেদনশীল পেশায় থাকা চিকিৎসকরা এখন রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। কারণ বর্তমান সময়ে স্বাস্থ্য খাতের সবকিছুর নিয়ন্ত্রক রাজনীতি। চিকিৎসকের ব্যক্তিগত যোগ্যতা বা ক্যারিশমার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি। একজন চিকিৎসকের যত বেশি গবেষণা বা কর্মক্ষেত্রে সুনাম থাকুক না কেন রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়া পদোন্নতি, নিয়োগ, বদলি, উচ্চ শিক্ষার সুযোগ কোনোটাই মিলছে না। পুরো স্বাস্থ্য খাতই পালাক্রমে জিম্মি হয়ে থাকছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুটি চিকিৎসক সংগঠনের কাছে। আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় সাত বছর ধরেই স্বাস্থ্য খাতের ভাগ্যবিধাতা হয়ে আবির্ভূত হয়েছে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)। রাজত্ব কায়েম হয়েছে স্বাচিপ নেতাদের। বিগত সময়ে বিএনপি সমর্থিত ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) নেতারাও ঠিক একই কাজ করেছেন। যখন যে দল ক্ষমতায় তারাই সর্বেসর্বা। এটাই যেন এখন স্বাস্থ্য খাতের নিয়তি। ফলে স্বাস্থ্য খাতের বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না কিছুতেই। প্রান্তিক মানুষের চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করতে সরকারের উদ্যোগও বারবার যাচ্ছে ভেস্তে। কোণঠাসা হয়ে পেশাদার ডাক্তাররা হারাচ্ছেন সেবার আগ্রহ। আবার চিকিৎসকদের সুবিধা নিশ্চিত করার অঙ্গীকারে স্বাচিপ-ড্যাবের জন্ম হলেও সাধারণ ডাক্তারদের অধিকার রক্ষায় এ দুই সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে আছে প্রশ্ন। কিন্তু সে বিষয়ে কথা বলার সাহসও হারিয়ে ফেলেছেন অধিকাংশ সাধারণ চিকিৎসক। দেশের চিকিৎসকরা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত ও বাম ভাবধারার চারটি গ্রুপে বিভক্ত। সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৯৯০ সালে বিএনপি সমর্থিত ড্যাবের জন্ম হয়। অন্যদিকে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ ফ ম রুহুল হকের নেতৃত্বে ১৯৯৫ সালে যাত্রা শুরু করে স্বাচিপ। এ ছাড়া ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম বা এডিএফ নামে জামায়াত সমর্থিত একটি চিকিৎসক সংগঠন আছে। বামধারার সমর্থক চিকিৎসক সংগঠনের নাম ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট। আকারে ক্ষুদ্র হলেও জাসদ ইনুর সমর্থকদেরও একটি চিকিৎসক সংগঠন আছে। তবে আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বাচিপ ও বিএনপির ড্যাবই আছে মুখ্য ভূমিকায়। চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে এ পেশায় নিয়োজিত থেকে এখন আর কেউ আওয়ামী লীগ-বিএনপির দুই সংগঠনের বাইরে থাকতে পারেন না। এর পেছনে মূলত কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত— বদলি, দ্বিতীয়ত— প্রমোশন, তৃতীয়ত— চিকিৎসকদের উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তথা ভর্তি পরীক্ষা না দিয়েই উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ। চতুর্থত— আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া তথা সরকারি বেতনের পাশাপাশি নানা সুযোগ পাওয়া যায়। যেমন অন্য ডাক্তারদের তদবির করা। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে প্রাকটিস করাসহ স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন আর্থিক সুযোগ মেলে রাজনীতি করলে। এমনকি রাজনীতিবিদ কোনো চিকিৎসকের হাতে ভুল চিকিৎসার কারণে রোগী মারা গেলেও তাদের বিচার বা সমস্যা হয় না। প্রশাসন থেকে চিকিৎসক নেতা সবাই থাকেন তার পক্ষে। একইভাবে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে শিক্ষকতার সুযোগ পাচ্ছেন এই দুই দলের সমর্থক ডাক্তাররাই। যেখানে পেশাদার ডাক্তারদের পরীক্ষায় পাস করা অন্য অনেক পরীক্ষার চেয়ে কঠিন, সেখানে স্বাচিপ বা ড্যাবের পরিচয়ে পরীক্ষা ছাড়াই পাওয়া যায় নিয়োগ। ক্ষমতাসীন দল সমর্থক চিকিৎসকদের পরীক্ষার আগে প্রশ্ন হাতে পাওয়ার অভিযোগও বেশ পুরনো। হাসপাতাল সূত্রগুলো জানিয়েছে, বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল সমর্থক স্বাচিপের বিভিন্ন পর্যায়ের বাড়াবাড়িতে স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্বপূূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প ফাইলবন্দি হয়ে রয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্পে স্বাচিপের ক্ষমতাধর নেতারা ‘টোল কালেক্টর’ হিসেবে কতিপয় নেতাকে নিয়োগ দিয়েছেন। কোনো কোনো নেতাকে স্বাস্থ্য অধিদফতরে নিয়োগ দিয়ে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রাখা হয়েছে। প্রকল্পের টাকা নানাভাবে হাতিয়ে নেওয়ার জন্যই এ নিয়োগ। এ ছাড়া স্বাচিপ নেতাদের ক্ষমতার দাপটে অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কার্যক্রমও হয়ে গেছে স্থবির। স্বাচিপের আশীর্বাদপুষ্ট, দলবাজ ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারাই স্বাস্থ্য প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল। এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা স্বাচিপকে কাজে লাগিয়ে হচ্ছেন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। সূত্র মতে, ২০১০-১১ সালে যে সাড়ে চার হাজার চিকিৎসককে এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে তিন হাজারের বেশি বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা। কেউ কেউ প্রাইভেট মেডিকেল থেকে ইন্টার্নি শেষ করার আগেই নিয়োগ পেয়েছেন। অভিযোগ আছে, স্বাচিপ নেতা ও মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা প্রাইভেট মেডিকেলের পাস করা চিকিৎসকদের কাছ থেকে প্রকাশ্যেই টাকা নিয়ে নিয়োগ দিয়েছেন। সরকারের মেয়াদের শেষ সময়ে দেওয়া গণপদোন্নতি নিয়েও চিকিৎসকদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। কারণ সিনিয়র চিকিৎসককে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক পরিচয়ে জুনিয়র চিকিৎসককে দেওয়া হয়েছে পদোন্নতি। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক বললেন, যেভাবে প্রাইভেট মেডিকেল থেকে চিকিৎসক বেরিয়ে আসছে, তাতে সরকারি মেডিকেলের এমবিবিএস পাস করার পর বিসিএস সার্ভিস রুল মেনে আসারা বিপাকে পড়ছেন। প্রাইভেটের শিক্ষার্থীদের টাকার দাপটের কাছে অসহায় হয়ে যাচ্ছেন মেধাবীরা। আবার টাকার বিনিময়ে এডহকে নিয়োগ পাওয়াদের বেশির ভাগ চিকিৎসকই এখন রাজনীতিতে সরব। এফসিপিএস করা চিকিৎসক রেখে ডিপ্লোমাধারীদের দেওয়া হচ্ছে পদোন্নতি।
স্বাচিপের সাবেক এক নেতা বলেন, সরকারি বিধি অনুযায়ী কোনো স্বাচিব বা ড্যাব নেতার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুষ্ঠানে বিশেষ করে নীতিনির্ধারণী কোনো বৈঠকে উপস্থিত থাকার বিধান নেই। তারপরও যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, সে দলের নেতারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী বৈঠকগুলোতে অংশ নেন। বিধি অনুসারে একমাত্র স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা উপস্থিত থাকতে পারবেন। কিন্তু এখন স্বাচিপ নেতারাই সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছেন। যার সর্বশেষ উদাহরণ ঢাকা মেডিকেল কলেজের এক স্বনাম খ্যাত অধ্যাপককে নির্বাচনে স্বাচিপের বর্তমান শীর্ষ নেতাকে সমর্থন না করায় উত্তরাঞ্চলের একটি জেলায় বদলি করা। সাধারণ চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। এ সংগঠনের বাইরে দলীয় সংগঠন সৃষ্টি হওয়াই স্বাস্থ্য প্রশাসনে বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী। কারণ চিকিৎসকদের সংগঠনের স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতি এখন সরকারের উন্নয়নকেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অবশ্য স্বাস্থ্য বিভাগে এ অরাজক পরিস্থিতি দীর্ঘকাল ধরেই চলে আসছে। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে একই কাজ করে গেছে বিএনপি সমর্থিত ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)-এর দুই গ্রুপ। এদিকে ডাক্তারদের এই রাজনীতির শিকার হচ্ছেন সাধারণ রোগীরা। অনেক সময়ে তাদের দলাদলির কারণে বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন অনেক রোগী। আবার তারা রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ঠিকঠাকভাবে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন না। বিশেষ করে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালের ডাক্তাররা রোগী দেখা বাদ দিয়ে স্বাচিপের নেতাদের অনুষ্ঠানে যোগ দিতেই বেশি উদ্যোগী থাকেন। এমনকি স্বাচিপের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আড্ডাবাজি করাও অনেক সময় রোগীর চিকিৎসার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ প্রসঙ্গে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রাকিবুল ইসলাম লিটু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, চিকিৎসকদের রাজনীতির কারণে অনেক সময় রোগীদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগদান করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুর অভিযোগও পাওয়া যায়।
ডাক্তারদের দলীয় রাজনীতি শুরু : ১৯৮৯ সালের ৬ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় চিকিৎসক রাজনীতি। রাজধানীর মগবাজারে একটি ক্লিনিকে গঠন করা হয় বিএনপি সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)। বিএনপি ও ছাত্রদল সমর্থিত চিকিৎসকদের নিয়ে অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী এ সংগঠন গঠন করেন। বর্তমানে এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুই বিএনপি নেতা অধ্যাপক ডা. আজিজুল হক ও অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। ১৯৯ সদস্যের কমিটি চলছে প্রায় ১০ বছর ধরে। বর্তমানে ড্যাব সমর্থিত চিকিৎসকের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার। বিএনপির পাশাপাশি সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী রুহুল হকের নেতৃত্বে ১৯৯৫ সালে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) যাত্রা শুরু হয়। ২০১৫ সালে অধ্যাপক ডা. এম ইকবাল আর্সলানকে সভাপতি এবং অধ্যাপক ডা. আ. আজিজকে মহাসচিব করে স্বাচিপের নতুন কমিটি হয়। বর্তমানে এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ১৩ হাজারেরও বেশি। এর আগে থেকেই ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট নামে বামধারার এবং জাসদ হাসানুল হক ইনু সমর্থিত আরও একটি পৃথক চিকিৎসক সংগঠনের কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। সারা দেশে তাদেরও বেশ কিছু সদস্য রয়েছেন। এ ছাড়া ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরাম এনডিএফ নামে জামায়াত সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন রয়েছে। তাদেরও সদস্য সংখ্যা কম নয়। চিকিৎসকদের রাজনীতি প্রসঙ্গে ড্যাব সভাপতি অধ্যাপক আজিজুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুধু চিকিৎসক নন, কোনো পেশাজীবীরই দলীয় রাজনীতি করা উচিত নয়। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশে এ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলে আসছে।
তথ্য সুত্র :: বাংলাদেশ প্রতিদিন
পাঠকের মতামত: