এম.আর মাহমুদ
সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার দৈনিক সমকালের সাংবাদিক শিমুলের নিতর দেহ ও রক্তমাখা পরিচয়পত্রটি সংবাদপত্রে দেখে মানুষের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। দেশের আমজনতা অবাক। দেশবাসী এখন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চায়। কে দেবে মৃত্যুর গ্যারান্টি আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। মানুষ মরণশীল। তবে শিমুলের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। ঘাতক পৌর মেয়র হালিমুল হক মিরুর গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছে শিমুল। এ ঘাতকের বিচারের বাণী রাষ্ট্রীয়ভাবে শোনা গেলেও অনন্তকাল অপেক্ষায় থাকতে হবে। অসহায় শিমুলের পরিবার কোনদিন তাদের অভিভাবককে ফিরে পাবে না।
আবদুল হাকিম শিমুল একজন পেশাদার ও সৎ সাংবাদিক। শাসক দলের দু’গ্র“পের সংঘাতের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে পৌর মেয়রের গুলিতে আঘাত প্রাপ্ত হয়ে শিমুল না ফেরার দেশে চলে গেছে। সাথে শিমুলের একমাত্র অভিভাবিকা ৯০ বছর বয়সের নানীও নাতীর করুণ মৃত্যুর সংবাদ শোনে স্ট্রোক করে মারা গেছে। একসাথে সাংবাদিক শিমুল ও নানী রোকেয়া বেগমের জানাযা ও দাফন হয়েছে। কি হৃদয় বিদারক! শিমুল ঘাতকের গুলিতে মরে গেলেও রেখে গেছে তার বিধবা স্ত্রী, ১১ বছরের পুত্র সন্তান সাদিক ও ৬ বছরের কন্যা সন্তান তামান্না। পৃথিবীতে তাদের আর কেউ নেই। সহায় সম্পদ বলতে নানী কর্তৃক দান করা ৪ কড়া জমি। কিভাবে পরিবারটি বেঁচে থাকবে আল্লাহই ভাল জানে। ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসন তার পরিবারের কাছে নগদ ২৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। পৌর মেয়র হালিমুল হক মিরু আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাকে এখনও পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। এছাড়া দল থেকেও বহিস্কার করা হয়নি। সম্প্রতি একজন উপজেলা চেয়ারম্যান শিশুদের কাঁধে চড়ে মানব সেতু পার হওয়ার অপরাধে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। শিশুদের কাঁধে চড়ার বিষয়টি অমানবিক। কিন্তু ওই উপজেলা চেয়ারম্যান কাউকে হত্যা করেনি। তারপরও দলীয়ভাবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে একজন সৎ ও সাহসী সাংবাদিককে গুলি করে হত্যার পরও শাসক দল তাকে বহিস্কার না করার হেতু কি দেশবাসীর মাথায় আসছে না। মুনির চৌধুরীর আলোচিত একটি উক্তি ‘মরে গেলে পঁচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়’ এভাবেই ঘাতক পৌর মেয়রের গুলিতে নিহত সাংবাদিক শিমুলের মরদেহ ক’দিন পরে পঁচে যাবে। হয়তো ঘাতকও পার পেয়ে যাবে। এমন আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। ইতিপূর্বে অনেক সাংবাদিক ঘাতকদের হাতে প্রাণ দিয়েছে। বিচার এখনও শেষ হয়নি। কবে শেষ হয় তা আদালতেই জানে। সাগর ও রুনির হত্যার কূল-কিনারা এখনও হয়নি। কবে হয় তদন্ত সংস্থায় ভালো জানে। দেশবাসী এসব হত্যাকান্ডের বিচার দেখার আশায় তীর্থের কাকের মত বসে আছে। রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতার কথা স্মৃতির মানসপটে বার বার ভেসে উঠে ‘রাণী রাজ পরিবার থেকে বের হয়ে নদীতে গোসল সেরে শীতে কাবু হয়ে গেলে, সাথে থাকা দাসীদের নির্দেশ দিলেন, শীত নিবারণের জন্য একটি জীর্ণ কুঠিরে আগুন দিতে। দাসীরা রাণীর হুকুম পালন করতে গিয়ে জীর্ণ কুঠিরে আগুন দেয়। এ সময় ওই এলাকার বেশক’টি জীর্ণ কুঠির আগুনে পুড়ে যায়। বিষয়টি রাজাকে অবহিত করার পর রাজা রাণীর কাছে জানতে চাইলে রাণী বলেন, শীতে কাবু হয়ে আগুনের উত্তাপ নেয়ার জন্য জীর্ণ কুঠিরে আগুন দিতে বলেছি। এ তো সামান্য ক্ষতি। রাজা তখন রাণীকে রাজ প্রসাদ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তখন রাণী বুঝেছিল গরিবের জীর্ণ কুঠিরের মর্ম বেদনা। এভাবে পৌর মেয়রের হালিমুল হক মিরু সাংবাদিক আবদুল হাকিম শিমুলের মাথায় গুলি করে হয়তো মনে করেছে এ যেন সামান্য ক্ষতি। কিন্তু শিমুল চলে গেছে না ফেরার দেশে। তার পরিবারের ক্ষতি কে পুষিয়ে দেবে। তার স্ত্রী ও দু’সন্তানের অন্ন ও লেখাপড়ার দায়িত্ব কেই নেবে? রাষ্ট্রীয়ভাবে কি নিহত সাংবাদিকের পরিবারের এ তিন সদস্যকে পুনর্বাসন করবে? ক্ষমতা কারো জন্য চিরস্থায়ী নয়। মেয়র মিরু আওয়ামীলীগের নেতা। তার পরিচয় সে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক। এক সময় জাসদের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। এখন আ’লীগের সুদিনে বসন্তের কোকিলের মত ঢুকে পড়েছে। শুধু দলের নাম ভাঙ্গিয়ে গত পৌর নির্বাচনে বিজয় লাভ করেছে। ভোটারবিহীন ভোটে নির্বাচিত পৌর মেয়রের কাছ থেকে এর বেশিকিছু আশা করা বাতুলতা ছাড়া কিছুই নয়। ভোটারদের মন জয় করে জয়ী হতে হলে, একজন সাংবাদিককে গুলি করে হত্যার ধৃষ্টতা কোনদিন দেখাতো বলে মনে হয় না। গ্রামের একটি প্রবাদ না বললে হয় না ‘শকুন প্রতিনিয়ত মাংস ছাড়া কিছু খায় না, তবে শকুন খায় মরা পশুর মাংস’ বাজার থেকে ৫‘শ টাকা কেজিতে মাংস ক্রয় করে খেতে হলে শকুন কোনদিন মাংসের পাশ দিয়ে হেঁটেও যাবে না। যতদিন জনপ্রতিনিধিরা জনগণের মন জয় করে নির্বাচিত হবে না, ততদিন আমজনতার রায়ের মূল্যও প্রতিষ্ঠিত হবে না।
স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ পরিবারের সিংহভাগ সদস্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালোরাতে একদল বিপদগামী সৈনিকদের হাতে নির্মমভাবে শহিদ হয়েছিল। দেশে ছিলেন না বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহেনা বেঁচে আছে। কিন্তু ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধু পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করলেও তারা আদর্শকে হত্যা করতে পারেনি। অনুরূপভাবে শিমুলকে হত্যা করলেও এদেশের সৎ সাংবাদিকতা রুদ্ধ হবে না। সমকাল পরিবার জানিয়ে দিয়েছেন, শিমুলের পরিবারের পাশে থাকবে। তার বিধবা স্ত্রী এস.এস.সি পাশ, বড় সন্তান শাহজাদপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। সাংবাদিক শিমুলের ইচ্ছা ছিল ছেলেটিকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করাবে। ঘাতকের বুলেটের আঘাতে তার ছেলের সাফল্য দেখে যেতে পারেনি। আল্লাহ চাইলে তার আশা পূরণ করতে পারে। শিমুলের পরিবারটির উপর একন নেমে এসেছে ঘোর অন্ধকার। জাতি ও সমগ্র সাংবাদিক সমাজ ঘাতক মেয়রের ফাঁসি দাবি করছে। এছাড়া তার স্ত্রীকে দু’সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যুগিয়ে দু’মুটো অন্ন যোগাড়ের জন্য যোগ্যতা অনুপাতে একটি চাকুরীর ব্যবস্থা করলে জাতির জনকের যোগ্য উত্তরসূরী প্রধানমন্ত্রী বিশাল হৃদয়ের প্রতি দেশবাসী কৃতজ্ঞ থাকবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর পিতা-মাতা, ভাই-ভাবীসহ অনেক নিকট আত্মীয় ঘাতকের হাতে প্রাণ দিয়েছে। এ নির্মমতার কথা মনে পড়লে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এখনও আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি কি শিমুলের পরিবারের জন্য একটু সহানুভূতিশীল হতে পারে না! তিনি ইতিমধ্যে টুঙ্গি পাড়ার এক অসহায় ভ্যান চালককে যেভাবে বিমান বাহিনীর অধীনে বেকারীতে চাকুরীর ব্যবস্থা করেছে, অনুরূপভাবে শিমুলের পরিবারের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা হার প্রসারিত হবে বলে সাংবাদিক সমাজ আশা করেন। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার আসামীদের দ্রুত বিচারের মাধ্যমে যেভাবে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে, সেভাবে শাহজাদপুরের পৌর মেয়রের বিচারের প্রত্যাশায় আছে দেশের সর্বস্তরের মানুষ।
পাঠকের মতামত: