‘পড়ালেখা করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে।’ এই উক্তিটি লোকমুখে বহুল প্রচলিত। তবে পরিতাপের বিষয় সর্বোচ্চ পড়াশুনা (মাস্টার্স) শেষ করেও কর্মসংস্থানের সুযোগ না হওয়ায় বিশাল জনগোষ্ঠী বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত। বিশেষ করে, মানবিক ও ব্যবসায় শাখা থেকে পাশ করা ¯œাতক-¯œাতকোত্তরধারীদের ‘কর্মের বাজার’ করুণ অবস্থা। কর্মজীবন শুরু করতে তাদেরকে অতিরিক্ত ডিপ্লোমা (যেমন- লাইব্রেরী, কম্পিউটার, ফার্মাসী কিংবা মার্চেন্ডাইজিং কোর্স) সম্পন্ন করতে হয়। বর্তমান চাকরির বাজার মানবিক মূল্যবোধ কিংবা প্রতিভার চেয়ে বিনিময় মূল্য (আর্থিক / প্রভাবশালী পরিচিতজনের সুপারিশ) বেশি কার্যকরী ভূমিকা রাখে। আর বিজ্ঞান শাখায় পড়াশুনার খরচ ব্যয়বহূল হওয়াতে নি¤œবিত্ত/মধ্যবিত্তদের পক্ষে সম্ভবপর হয় না কিংবা এসএসসি’র পর বাণিজ্য বা মানবিক শাখায় ভর্তি হতে হয়। আর এভাবেই বলি হয়ে যায় এক একটা স্বপ্ন।
এখন মেধাসর্বস্ব সার্টিফিকেট এর চেয়ে তোষামুদ বা কারিগরি ডিপ্লোমার দাম অনেক বেশি। সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে তোষামুদে কর্তাব্যক্তিরাই পদবী-ভাতায় ভরপুর থাকেন। আর যেসব কর্তাব্যক্তি আদর্শের বা, নীতিবাক্যের কথা বলেন তাদেরকে ‘একঘরে’ করা হয়। তাদের পদোন্নতিরও কোনো সুযোগ থাকেনা। অথচ উপরি-ইনকাম করার লোভে নীতি-বিবর্জিত কর্তাব্যক্তিরা নিয়মের কোনো তোয়াক্কা করেননা। যেনো সকল নিয়ম-নীতি অসহায় বা দূর্বলদের জন্য প্রযোজ্য। আবার, তোষামুদকারীরা অসহায়ত্বের দিকে না গিয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করেননা। প্রকৃতপক্ষে মানবতার জন্য এসব ব্যক্তিত্বহীন ও দুর্নীতিবাজ কর্তাব্যক্তি খুবই ভয়ানক। তাই চলার পথে তাদেরকে চিহ্নিত করা ও নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করাটা জরুরী।
যে বিষয়টি নিয়ে পড়াশুনা ওই বিষয়ে চাকরি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দৃষ্টান্ত কম সৌভাগ্যের কপালেই জুটে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে শিক্ষার্থী যুক্তিবিদ্যা বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছে। দর্শন চর্চায় মশগুল থেকেছে। ‘রিসার্চ মেথডলজি’ নিয়ে বিস্তর পড়াশুনা করেছে। অধিবিদ্যা ও মনোবিদ্যায় ‘গ্রুপস্টাডি’তে অসংখ্য বিকাল-রাত পার করেছে। ওই ¯œাতকোত্তর ডিগ্রীধারীরা এখন এসএসসি / এইচএসসি লেভেলের চাকরিতে কষ্টকর দিনাতিপাত করছে। তাদের কাছে দেশ ও জাতিকে দেওয়ার মতো দিক-নির্দেশনামূলক অবারিত জ্ঞান থাকার পরও রাজনৈতিক (!) অভিজ্ঞতা কিংবা ‘বড় ভাইদের’ সুপারিশ না থাকার কারণে একটি মানসম্পন্ন চাকরিও জুটেনি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য একটি সরকারি (ন্যুনতম) চাকরি পাওয়ার জন্য মাস্টার্স পাশ শিক্ষার্থীরা চতুর্থ শ্রেণির পদে (সিকিউরিটি গার্ড) প্রতিযোগীতা করেও সফল হতে পারছেনা। লিখিত ও মৌখিক উত্তীর্ণ হওয়ার পর ভাইভা পরীক্ষায় তাদেরকে প্রশ্ন করা হয় ‘এতো পড়াশুনা ও এতোগুলো সার্টিফিকেট ওয়ালাদের চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই।’ ওই সময় সম্মানীত(!)পরীক্ষকবৃন্দ একে অপরের দিকে মুখ টিপে অট্টহাসি দেয়। বিষয়গুলো অত্যন্ত লজ্জ¦াজনক, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়াটি নিশ্চিত করতে না পারলে জাতীয় ভবিষ্যৎ কতটা অন্ধকার ও পথভ্রষ্ট হতে পারে তা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই বিবেচ্য।
এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষিত বেকারগোষ্ঠীর নৈতিক বিস্ফোরণ ঘটাবে। তাদেরকে জাগ্রত করতে হলে, সুপথে আনতে হলে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রটি ফিরিয়ে আনতে না পারলে এ মরণব্যাধিকে প্রতিকার বা প্রতিরোধ করাটা দু:সাধ্য হবে। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে উচ্চ মহলের সুদক্ষ টিমের সমন্বয়ে ‘মনিটরিং সেল’ গঠন করতে হবে। দুর্নীতি দমনে ‘জিরো টলারেন্স’ এর প্রমাণ দিতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতাগুলো দূর করতে হবে। বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোগ দিতে হবে। বিশেষ করে ‘শিক্ষক সমাজ’কে ঢেলে সাজাতে হবে। সব পেশা মতো ‘শিক্ষকতা’ পেশাকে গুলিয়ে ফেললে হবেনা। অন্তত: এই একটি পেশা (শিক্ষকতা) যেনো মেধা ও নৈতিকতা সমৃদ্ধ হয়, তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। কারণ এই শিক্ষক সমাজের হাতেই জাতি গঠনে গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত থাকে। তাই কোনো ধরনের তদবির বা জালিয়াতির মাধ্যমে ‘শিক্ষক’ হওয়ার সুযোগ কঠোরভাবে দমন করতে হবে। বিকশিত মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সময়োপযোগী কারিগরি দক্ষতা তথা সৃজনশীলতায় সমৃদ্ধ জনসম্পদের মাধ্যমেই শিক্ষক সমাজ গঠন করতে হবে। তবেই শিক্ষকবৃন্দ জাতিকে ‘আদর্শিক ও উন্নত মননের প্রজন্ম’ উপহার দিতে পারবে। সকলের ‘শুভ বুদ্ধি’র উদয় হোক। সমাজে ন্যায়-নৈতিকতার প্রতিষ্ঠা আজ সময়ের দাবি।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
ংযধযরফৎঁংংবষ১৯৭১@মসধরষ.পড়স
পাঠকের মতামত: