লামা-আলীকদম প্রতিনিধি :: বান্দরবানের সবচেয়ে বড় ও জনবহুল উপজেলা লামা। প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষের বসবাস এই উপজেলায়। উপজেলার উত্তরে চট্টগ্রাম জেলা ও বান্দরবান সদর উপজেলা, দক্ষিণে নাইক্ষ্যংছড়ি ও আলীকদম উপজেলা, পশ্চিমে কক্সবাজার জেলা ও পূর্বে রুমা, থানচি ও আলীকদম উপজেলা অবস্থিত।
লামা উপজেলার মোট আয়তন ৬৭১.৮৪ বর্গকিলোমিটার। উপজেলার পূর্ব-উত্তর সীমানাস্থ রূপসীপাড়া, লামা সদর, গজালিয়া ও সরই ইউনিয়নের সীমানা ঘেঁষে রয়েছে রুমা, থানচি ও আলীকদম উপজেলা। এই সীমানা অঞ্চলটি দুর্গম, পাহাড়ি ও সড়ক যোগাযোগবিচ্ছিন্ন। নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায় ও ব্যবসা-চাষাবাদের জন্য যাওয়া কিছু বাঙালি লোকজন ছাড়া তেমন কোন বসবাস নেই এই এলাকাটিতে। লামার রূপসীপাড়া ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের আলীয়াং বাবু পাড়া থেকে শুরু করে পোপা, ঘিলাপাড়া, ছোট বমু, বড় বমু হয়ে লেমুপালং ও লুলাইং পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার পাহাড়ি সীমানা পুরোই রয়েছে অরক্ষিত।
উপজেলা সদর থেকে রূপসীপাড়া ইউনিয়নের মংপ্রু পাড়া, লামা সদর ইউনিয়নের বৈল্যারচর পাড়া, গজালিয়া ইউনিয়নের তুলাতুলি পাড়া এবং সরই ইউনিয়নের লুলাইং বাজার পর্যন্ত গ্রামীণ কাঁচা রাস্তা রয়েছে। যে এলাকায় নেই সেনা বা সরকারি অন্য কোন বাহিনীর ক্যাম্প। এতে করে ফাঁকা পেয়ে এই অঞ্চল দখলে নিয়েছে কিছু পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপ।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, এই জনপদে জেএসএস, ইউপিডিএফ ও এমএনপিসহ বিচ্ছিন্ন কয়েকটি সংগঠন রয়েছে। যাদের হাতে এতদাঞ্চলে বসবাসরত মানুষ জিম্মি হয়ে পড়েছে। এই এলাকায় গাছ, বাঁশ, ফল ও সবজি ব্যবসায়ীদের নিয়মিত চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করতে হয়। যদিও বিষয়টি ওপেনসিক্রেট। এছাড়া প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিল-মে এই তিন মাসে তামাক পোড়ানো ও বিক্রি মৌসুমে তামাকচুল্লী ঘিরে জমে উঠে চাঁদা সংগ্রহের হিড়িক। দুর্গম রূপসীপাড়ার তামাক চাষি নুরুন্নবী, কুতুব উদ্দিন, লামা সদর পোপা এলাকার জামাল মাঝি, এনায়েত হোসেন বলেন, তামাক পোড়ানো শুরু হলে তামাকচুল্লী প্রতি পাহাড়ি গ্রুপকে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। বিকাশ-নগদ-রকেটে টাকা পাঠাতে হয়। যেহেতু আমরা দুর্গমে চাষাবাদ করি, তাদের টাকা না দিলে নিরাপদে থাকতে পারি না। টাকা না দিলে শুরু হয় নির্যাতন-নিপীড়ন।
বিভিন্ন সময় প্রকাশিত সংবাদ ও স্থানীয়দের বরাত দিয়ে জানা যায়, গত ১০ বছরে এই অরক্ষিত অঞ্চলে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে নিরীহ ব্যবসায়ী ও চাষি মিলে কমপক্ষে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। একাধিকবার পাহাড়ি সন্ত্রাসী গ্রুপের সাথে সরাসরি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গোলাগুলি হয়েছে। ঝরেছে প্রচুর তাজা প্রাণ। চাঁদার জন্য ১৬ জনকে অপহরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকে দফারফা করে ছাড়া পেয়েছিল। এর মধ্যে সরোয়ার আলম, বসন্ত বড়–য়া, মংক্যাচিং মার্মা খুন এবং রূপসীপাড়া নাইক্ষ্যংমুখ বাজার ও লামা সদর ইউনিয়নের মেরাখোলা বাজারে দিনেদুপুরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের গোলাগুলির ঘটনা আলোচিত।
রূপসীপাড়া ইউনিয়নের নাইক্ষ্যংমুখ বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা অন্য কোন দেশে আছি। যেখানে নেই কোন সরকারি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ। নাইক্ষ্যংমুখ থেকে সরই ইউনিয়নের লুলাইং পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার এলাকা চলে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে। কখনও কোন ঘটনা ঘটলে অনেক পরে দেখা মিলে সরকারি বাহিনীর। অপারেশন শেষ হলে তারা ফিরে যায় তাদের ক্যাম্পে, আর বরাবরের মত আমরা রয়ে যাই অরক্ষিত। এই অঞ্চলটির নিরাপত্তার কথা ভেবে রূপসীপাড়া ইউনিয়নের নাইক্ষ্যংমুখ বাজার, সদর ইউনিয়নের পোপা ঘিলাপাড়া ও গজালিয়া ইউনিয়নের লুলাইং এলাকায় তিনটি ছোট ছোট সেনা ক্যাম্প স্থাপনে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন এলাকার পাহাড়ি-বাঙালি শান্তিপ্রিয় জনগণ।’
রূপসীপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান ছাচিং প্রু মার্মা ও সরই ইউপি চেয়ারম্যান ইদ্রিস কোম্পানী বলেন, নিরাপত্তার কথা চিন্তা করলে সেনা ক্যাম্প বাড়ানো ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।
থানার অফিসার ইনচার্জ শহীদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, উপজেলার পূর্ব সীমানায় সেনা ক্যাম্প স্থাপনে নিরাপত্তা বাড়বে। তিনি সরকারি উপর মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অনেকবার চিঠি লিখেছেন বলে জানান।
পাঠকের মতামত: