ঢাকা,শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

রেক্টর আল্লামা মুজহের আহমদ: কর্মে বেঁচে থাকবেন চিরদিন

Rector-mujaher coxমুহাম্মদ শামসুল হক শারেক :::
উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ও ইসলামী ঐক্যের প্রতীক, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মুর্দারেছীনের সাবেক সহ-সভাপতি, কক্সবাজার হাশেমিয়া কামিল মাদ্রাসার রেক্টর মরহুম আল্লামা মুজহের আহমদ (রেক্টর হুজুর)’র ১২তম ইন্তেকাল বার্ষিকী গেল গতকাল। ৮জুলাই ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ রেক্টর হুজুর ৯৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। দেখতে দেখতে এক যুগ বা ১২টি বছর পার হয়ে গেল। পারিবারিকভাবে বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে মরহুমের ইন্তেকাল বার্ষিকী পালিত হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে খতমে কুরআন, এতিমদের মাঝে খাবার বিতরণ, মরহুমের কবর জিয়ারত ও ৮জুলাই (আজ) বাদ আসর কক্সবাজার শহরের রুমালিয়ারছরা জামে মসজিদে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।

রেক্টর হুজুর আল্লামা মুজহের আহমদ ছিলেন একজন প্রথিতযশা মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, ফকীহ ও ওলামায়ে কেরামসহ সমাজে ইসলামী ঐক্যের প্রতীক। যে কোন সমস্যার ইসলামী সমাধানে তিনি ছিলেন নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্থ অভিভাবক। তিনি ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ একজন মনিষী।

রেক্টর হুজুর সম্পর্কে বায়তুশ শরফের সম্মানিত পীর বাহারুল উলুম আল্লামা কুতুব উদ্দিন (মদ্দাজজিল্লাহুল আলী) রেক্টর হুজুর সম্পর্কে বলেন ‘মানব জীবন ক্ষণস্থায়ী। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে এমন কতগুলো ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের আর্বিভাব হয়েছে, যাঁদের জীবনের বিভিন্ন র্কীতি ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এমনি একজন কীর্তিমান আলেমে দ্বীন হচ্ছেন হযরতুল আল্লামা মাওলানা মুজহের আহমদ (রহঃ)। যিনি ছিলেন কক্সবাজার হাশেমিয়া আলীয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ও রেক্টর। যিনি আজীবন শিক্ষকতার মহান পেশায় নিয়োজিত থেকে উপমহাদেশের লক্ষ লক্ষ ছাত্র সমাজের মাঝে প্রজ্জ্বলিত করেছেন দ্বীনি ইলমের চিরদীপ্ত মশাল। তিনি ছিলেন একজন প্রথিতযশা মুহাদ্দিস, ফকীহ ও মুফাস্সির। ফিক্হা শাস্ত্রে তাঁর ছিল বিশেষ বুৎপত্তি। ওলামায়ে কেরামের ঐক্যের প্রয়াসে বায়তুশ শরফের মরহুম হুজুর আল্লামা শাহ আব্দুল জব্বার (রহঃ) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মজলিসে ওলামা বাংলাদেশের তিনি ছিলেন কক্সবাজার জেলা সভাপতি। তিনি আলেমদের ঐক্যের ব্যাপারে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন।’

কক্সবাজারের কৃতি সন্তান সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহ উদ্দিন আহমদ রেক্টর হুজুর প্রসঙ্গে বলেছিলেন ‘ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন ও অনন্য সাধারণ প্রতিভার অধিকারী ইসলামী চিন্তাবিদ ও মহান শিক্ষাবিদ ছিলেন মাওলানা আবুল কালাম মুজহের আহমদ (রহঃ)।’

সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরীর মতে ‘তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান, একটি বিষ্ময়কর প্রতিভা। বহুমাত্রিক মেধা ও মননের এমন অপূর্ব মিলন খুব কম মানুষের মধ্যে ঘটে। সবচেয়ে বড় কথা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা এবং দ্বীনি সৈনিক তৈরির মত মহৎ প্রয়াসে তিনি ছিলেন অগ্রণী।’

সাবেক এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোঃ সহিদুজ্জামানের মতে ‘মরহুম মাওলানা ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ আলেম। তাঁর পান্ডিত্যের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছিল দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বর্হিবিশ্বেও। তাঁর আলোকময় ষ্পর্শে আলোকিত হয়েছিল সহস্র শিক্ষার্থী যারা নিজেরাই এখন তমসাচ্ছন্ন এ ভ্রান্ত সমাজে আলোর পথ দেখাচ্ছেন। তিনি বেঁচে আছেন। তিনি বেঁেচ থাকবেন তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ ও কর্মের মাঝে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. বদিউল আলম এর মন্তব্য ‘মরহুমের বর্ণাঢ্য জীবনের বিভিন্ন ঘটনা অনেকের অজানা। তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ বিজ্ঞ আলেম। ইসলামী শিক্ষার প্রচার ও প্রসা্ের তিনি নিজের জীবনকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ঈমানী শক্তি ছিল ইস্পাত কঠিন। তিনি ছিলেন একজন আদর্শবান ব্যক্তিত্ব।’

প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. মুঈন উদ্দীন আহমদ খাঁন রেক্টর হুজুর প্রসঙ্গে বলেন ‘তিনি দুনিয়াদারির প্রতি বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে দ্বীনের খেদমতের লক্ষ্যে মাদ্রাসায় শিক্ষকতা আরম্ভ করেন। তাঁর মেধা, গভীর জ্ঞান, পারদর্শীতা, আদর্শ জীবন ও ধর্মগুরু হিসাবে চারিত্রিক অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ রেক্টর হিসাবে নিয়োগ দান করে মানব সেবায় তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দেন। ইসলামের বর্তমান দুর্দিনে ধর্মকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁর মতো সৎ, সভ্য ও জ্ঞানী লোকের বেশী প্রয়োজন।’

হুজুরের ইন্তোকালের পর বাংলাদেশ জমিয়াতুল মুর্দারেছীনের সভাপতি ও দেশের বরেণ্য সাংবাদিক দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক আলহাজ্ব এ এম এম বাহাউদ্দিন হুজুরের কবর জিয়ারত করতে আসেন। এসময় তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে বলেছিলেন ‘বাংলাদেশের শীর্ষ আলেমরা একে একে চলে যাচ্ছেন। আল্লামা মুজহের আহমদও চলে গেলেন। তাঁর স্থান পুরণ হবার মত নয়। তাঁর ইন্তেকালে আমি একজন অভিভাবককে হারালাম।’

তৎকালীন যুগ্মসচিব একে মোহাম্মদ হোসেন বলেছিলেন ‘কক্সবাজার হাশেমিয়া আলীয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত আলেমকুল শিরোমণি হযরত মাওলানা মুজ্হের আহমদ ছিলেন অবিস্মরণীয় প্রতিভার অধিকারী। কোরআন-হাদিস ও ফিকাহ্ শাস্ত্রে তাঁর ছিল অসাধারণ জ্ঞান। ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে তাঁর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। সমাজ সেবায় তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ পুরুষ।’

পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আনসারুল করিমের মন্তব্য ‘মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি কক্সবাজার হাশেমিয়া আলীয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে ইসলামী শিক্ষা দান করে গেছেন। তাঁর জ্ঞানগর্ভ শিক্ষা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে উক্ত মাদ্রাসাকে অত্র অঞ্চলের তথা সমগ্র বাংলাদেশের একটি শ্রেষ্ঠ ইসলামী শিক্ষার বিদ্যাপীঠ হিসাবে শুধু প্রতিষ্ঠা করেননি, তিনি অগনিত শিষ্য সৃষ্টি করে এ অঞ্চলের জনগণকে ইসলামের শাণিত আলোতে আলোকিত করেছেন। ইসলাম ধর্ম বিষয়ে তাঁর অসাধারণ জ্ঞান ও ধর্মকে কেন্দ্র করে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ফেতনা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানের কারণে দলমত নির্বিশেষে তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা কক্সবাজারের জনগণ শুধু একজন শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদকে হারাইনি বরং মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঐক্য সৃষ্টিকারী একজন নিবেদিত প্রাণ সমাজকর্মীকেই আমরা হারিয়েছি।’

কক্সবাজার বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্সের মহা পরিচালক শিক্ষাবিদ আলহাজ্ব এম সিরাজুল ইসলামের মন্তব্য ‘মরহুম মাওলানা মোজহের আহমদ ছিলেন আমার পিতার প্রিয় শিক্ষক। বৃদ্ধ বয়সেও আমার পিতাকে দেখেছি রেক্টর হুজুরকে শ্রদ্ধাবনত হয়ে সম্মান করতে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষক না হলেও তিনি আমারও শিক্ষা গুরু। রেক্টর সাহেবের অসংখ্য গুণের মধ্যে দুটি অসাধারণ গুণ আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছে। ধর্মীয় কোন জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত দেয়ার সময় তাঁকে কখনো বিচলিত হতে কিংবা দ্বিধা করতে দেখিনি। বস্তুত: তিনি ছিলেন প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী ও দৃঢ় প্রত্যয়ী। অন্যদিকে তাঁর ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তার মাঝেও দেখেছি শিশুর মতো কোমলতা। এমনকি খুব সাধারণ একজন রিক্সাওয়ালাও যদি তাঁকে দাওয়াত করতো তিনি বিনা দ্বিধায় তা গ্রহণ করতেন। কোন অহংকার তাঁর মধ্যে ছিলনা।’

আল্লামা মোজহের আহমদ স্মৃতি সংসদের সভাপতি ও মরহুমের বড় সন্তান আবু মোহাম্মদ ইয়াহিয়ার মতে ‘তিনি ইসলামী শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলেন। অর্থ-বিত্ত, শান-সওকত তাঁর পছন্দ ছিলনা। নির্লোভ, নিঃস্বার্থ এক মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। তিনি নিজের জীবনকে একটি নির্দিষ্ট ছকে আবদ্ধ করেছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি আহার, নিদ্রা, কোরআন, হাদিস ও ফিকাহ্ অধ্যায়ন রুটিন মতো করার চেষ্টা করতেন। তিনি ছিলেন সদালাপী, সত্যনিষ্ঠ ও আপোষহীন এক শিক্ষাবিদ। শিক্ষা দানকে তিনি জীবনের ব্রত হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। তাফসীর এবং হাদিসের অগাধ জ্ঞানের অধিকারী এ মহান ব্যক্তির বিচরণ ছিল জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায়। ইল্মে হাদিস, ইল্মে তাসাউফ, ইল্মে মান্তিক ও ইল্মে কালাম প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল নজরকাড়া।’

‘মোহ, লোভ লালসা মোটেও গ্রাস করতে পারেনি তাঁকে। বাবা ছিলেন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মুর্দারেছীনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের হেড এক্সামিনার। মরহুম মাওলানা এম এ মান্নান ছিলেন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মুর্দারেছীনের সভাপতি। মাওলানা মান্নানের ধর্মমন্ত্রী থেকে পদত্যাগের ২৪ ঘন্টার মধ্যে বাবাকে বঙ্গভবনে ডেকে নিয়ে ধর্মমন্ত্রীর পদ গ্রহণের আনুরোধ করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। কিন্তু ধর্ম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বের মত লোভনীয় অফার গ্রহণে বাবার অসম্মতি ছিল সে দিন জাতীয় আলোচনার বিষয়। এহেন নজির বর্তমানে বিরল।’ ওই লোভনীয় অফারে দেশের ওলামায়ে কেরামের মাঝে অনৈক্যের গন্ধ ছিল বলেই তিনি তা গ্রহণকরতে অস্বীকার করেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন।

বিশিষ্ট আইনজীবী আলহাজ্ব এড. সালামত উল্লাহ বলেছিলেন, ‘তাঁর জ্ঞান সাধানা ভাল কাজের বরকতে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে দীর্ঘ জীবন দান করেছিলেন। তিনি মৃত্যুর অল্প কিছিুদন আগে স্বপ্নে তাঁর মৃত্যুর ইশারা পেয়েছিলেন। তখন থেকে তিনি মৃত্যুর প্রস্তুতি নেন। তিনি দুনিয়ার সকল হিসাব নিকাশ চুকিয়ে যান। তাঁর যা সহায় সম্বল ছিল তা অছিয়াতের মাধ্যমে ছেলে মেয়েদের মাঝে শরীয়াত ও ন্যায়মতে তিনি লিখিতভাবে বন্টন করে দেন।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান (ইতোমধ্যে তিনিও ইন্তেকাল করেছেন) প্রফেসার ড. আনোয়ারুল হক খতিবীর মতে ‘অসাধারণ মেধাবী ছাত্র মুজহের আহমদ ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের সরকারী কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা থেকে হাদীস গ্রুপে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে ‘ভাইসরয়’ স্বর্ণপদক লাভ করেন। অতঃপর তিনি কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসায় রিসার্চ স্কলার হিসেবে যোগদান করেন।

জ্ঞানের জগতের এই দীপ্তিমান সূর্য উসতাযুল আসাতিযা আল্লামা মুজহের আহমদ ৮ জুলাই ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ জুমাবার রাত ৮টায় ৯৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।’

বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত বিশিষ্ট অনুবাদক জাফর আলম এর মতে ‘মাওলানা মুজহের আহমদ যদিও মাদ্রাসায় শিক্ষিত একজন আদর্শ শিক্ষক ছিলেন, কিন্তু ধর্মীয় গোঁড়ামী, ধর্মান্ধতা তাঁর মাঝে কোন দিন দেখিনি। তিনি ছিলে উদারপন্থী ও আধুুনিক চিন্তা চেতনায় অভিষিক্ত মানুষ। তাঁর অমায়িক ব্যবহার সকলকে মুগ্ধ করতো। তাঁর কোন শত্রু ছিল না। তিনি ছিলেন একজন অজাত শ্রত্রু মানুষ। তাঁর মৃত্যু কক্সবাজারবাসীর জন্য অপুরনীয় ক্ষতি আর আমার জন্য পিতৃতুল্য শিক্ষক হারানোর চিরস্থায়ী বেদনা।’

কক্সবাজারের সিনিয়র সাংবাদিক, কক্সবাজার প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আলহাজ্ব বদিউল আলম এর মতে ‘আল্লাহর প্রতি অটল ঈমান রেখে সকল প্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, ন্যায়ের সংগ্রামে শরিক হওয়ার জন্য সভা সমিতির মাধ্যমে তিনি অত্র এলাকার জনগনকে উদ্বুদ্ধ করেন। কর্মজীবনের শুরুতেই জমিদারের জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করার জন্য বিভিন্নস্থানে সভার আয়োজন করে তিনি সাংগঠনিক নৈপুন্য প্রদর্শন করেন। বিশেষ করে ড. ফজলুর রহমান কর্তৃক পবিত্র কুরআনের অপব্যাখার প্রতিবাদে মৌলবী ফরিদ আহমদ ও খতীবে আজম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদের নেতৃত্বে সূচিত আন্দেলনেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। কক্সবাজারের জনগনের দাবী দাওয়া আদায়ে ও তিনি সোচ্চার ছিলেন। ১৯৮৩ সালে কক্সবাজারকে পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক জেলা করার দাবীতে আন্দোলনে তাঁর সংশ্লিষ্টতা প্রশংসার দাবী রাখে। (সাবেক মন্ত্রী মরহুম) মাওলানা এম এ মান্নানের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ জমিয়াতুল মুদার্রেছীনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এবং কক্সবাজার জেলা কমিটির সভাপতি পদে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। আরবী, ফার্সি, উর্দু, ইংরেজী ও বাংলা ভাষায় তাঁর দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। ধর্মীয় বিধি-বিধান নিয়ে কোন বির্তক সৃষ্টি হলে কুরআন-হাদীসের আলোকে সমাধান দিতে তিনিই একমাত্র নির্ভরশীল ব্যক্তি ছিলেন।’

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তৎকালীন কক্সবাজারের ডিডি আবুল হায়াত মুম্মদ তারেক আল্লামা মুজহের আহমদের বংশ পরিচয় সম্পর্কে বলেন ‘আবুল কালাম মুজহের বিন আমির হোসাইন বিন মুহাম্মদ আলী বিন ছমদ আলী বিন শওকত আলী বিন শরাফত আলী বিন শাহেদ আলী। চট্টগ্রাম জেলার মীরশ্বরাই উপজেলার জোরালগঞ্জ থেকে তাঁর পরদাদা ছমদ আলী কক্সবাজার জেলার চকরিয়ায় শাহার বিলে এসে বসতি স্থাপন করেন অষ্টাদশ শতকের ষষ্ট দশকের দিকে। পিতা মাওলানা আমির হোসাইন ও মাতা জোবায়দা হোসাইন বংশে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ১৩৩২ হিজরী পবিত্র রমজানের ২৭ তারিখ কদরের রাতে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন।’

মুফতি আব্দুল হক বলেন ‘রেক্টর হুজুরের প্রতিদিনের সময় সূচী ছিল-বাদ ফজর কুরআন তেলাওয়াত, পত্রিকা পড়া, ফতোয়া লেখা, অনুবাদ করা ইত্যাদি। দরস দিতেন বাদ মাগরিব। বাদ এশা ক্লাশের প্রস্তুতি, অধ্যয়ন ও ফতোয়ার কিতাব দেখা ইত্যাদি। এলমি জগতে তিনি খতীবে আজম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ রহঃ ও মাওলানা আশরফ আলী থানবী রহঃ’র ভক্ত ছিলেন। তা ছাড়া শাহওয়ালী উল্লাহ রহঃ, মুফতি শফি রহঃ, মাওলানা আবুল হাসান আলী নদবী রহঃ, ও মাওলানা তকী ওসমানীর লেখা আগ্রহ সহকারে পাঠ করতেন। মরহুম মাওলানা মওদুদী ও মরহুম মাওলানা আব্দুর রহিমের বইও গুরুত্ব সহকারে দেখতেন।’

বিশিষ্ট লেখক ও সাহিত্যিক নূরুল আজিজ চৌধুরী বলেন ‘কক্সবাজারের কৃতি সন্তান বহু পুরস্কার প্রাপ্ত বরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদ ও শিক্ষাবিদ মাওলানা মুজহের আহমদ এ যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে সমাজ দরদী, সুলেখক, সমাজ সংস্কারক, সৎ ও নির্ভীক ইসলামী চিন্তাবিদ।’

মুহাম্মদ আমির হোসাইন বলেন ‘রেক্টর হুজুর কয়েকটি প্রমান্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। প্রখ্যাত মুফাস্সির আল্লামা জালাল উদ্দিন সুয়ুতি রচিত ‘আল ইতকান ফি উলুমিল কুরআন’ এর ‘মুজহেরুল ইতকান’ নামে উর্দু অনুবাদ করেছেন তিনি। বইটি বর্তমানে মাদ্রাসার কামিল শ্রেণীর পাঠ্য তালিকাভূক্ত। বোখারী শরীফের একটি প্রমান্য ব্যাখ্যা গ্রন্থও রচনা করেছেন তিনি। এর নাম করণ করেছেন ‘ইজাহুল বোখারী’। ইমাম মালেক রহঃএর জীবনীর উপর একটি গবেষণা ধর্মী গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থটি কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা কর্তৃক প্রকাশিত হয়।

দেশে যুগ শ্রেষ্ঠ এই রকম মনিষী ও সমাজ সংস্কারকের আজ বড়ই অভাব অনুভূত হচ্ছে। মহান আল্লাহ তায়ালা রেক্টর হুজুরকে জান্নাতুল ফেরদাউসের উচুঁ স্থান দান করুন। তাঁর রেখে যাওয়া শিক্ষা এবং ফুইউজাত যেন আমাদের পথ চলার পাথেয় হয়-মহান আল্লাহ কবুল করুন আমাদের এই কামনা।

আল্লামা মুজহের আহমদ যেমন ছিলেন বাহারুল উলুম বা জ্ঞানের ভান্ডার, তেমনি ধন সম্পদের দিক থেকেও একেবারে পথের মানুষ ছিলেন না। সম্পদশালী একজন অলেমে দ্বীন ছিলেন। তাঁর ওয়ারিশরা তাঁকে নিয়ে গর্ববোধ করার মত অনেক কিছু রেখেগেছেন। কিন্তু এক যুগ পার হতে না হতেই নিরবে নিবৃত্তে তাঁর ইন্তেকাল বার্ষিকী পালনে দৈন্যতা দেখে তাঁর ভক্ত-অনুরক্তরা কিছুটা হতাশ হয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে।

পাঠকের মতামত: