ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

রিকশাওয়ালা থেকে অভিনেতা হওয়ার গল্প শোনালেন শামীম

বিনোদন ডেস্ক ::

অভিনেতা শামীম আহমেদ। ১৭ বছর ধরে অভিনয় করে চলেছেন। পেয়েছেন জনপ্রিয়তাও। কমেডি চরিত্রে টিভি নাটকে শামীম নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অনন্যতায়। সম্প্রতি উত্তরায় শুটিং স্পটে তিনি কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। আলাপচারিতায় জানান অনেক অজানা গল্প।

শামীম আহমেদের অভিনয়ের পথচলার শুরু ১৯৯৯ সালে ‘বন্ধন’ ধারাবাহিক দিয়ে। অভিনেত্রী আফসানা মিমির আগ্রহেই মহিলা সমিতির পিওন শামীম হয়ে উঠলেন অভিনেতা। শামীমের ভাষায়, ‘বন্ধন নাটকের প্রোডাকশন ম্যানেজার ছিলাম আমি। আমার একটা গুণ ছিল, কোন কোন আর্টিস্ট কখন ওষুধ খাবেন, কোন আর্টিস্ট কখন ডায়াবেটিসের ইনসুলিন নেবেন আর নেওয়ার কতক্ষণ পর সে খাবার খাবেন, কোন নায়ক কখন খাবেন- এ বিষয়গুলো মনে রাখতে পারতাম। কাজটা ঠিকমতো করতাম।

আমি খুব পরিছন্ন ছিলাম। সেটেও জনপ্রিয় ছিলাম। ওই নাটকে আফসানা মিমি আপা ছিলেন। এই নাটকে একটা চরিত্র ছিল ‘লোকমান’। লোকমান চরিত্রটা করার জন্য যে ছেলেটাকে সিলেক্ট করা হয়েছিল দুদিন শুট করার পর সে আর আসেনি। কারণ তার কী একটা পরীক্ষা চলছিল।

তখন শুটিংয়ের আগের দিন রাতে মিমি আপা, পান্থ ভাই, অম্লান বিশ্বাস, অমিতাভ ভাই, মুরাদ ভাই এরা আড্ডা দিচ্ছিলেন একসঙ্গে। হঠাৎ মিমি আপা আমাকে ডেকে বললেন, শামীম তুই লোকমান ক্যারেক্টারটা পড়ছস? আমি কইছি, হ পড়ছি। তখন আপা কইলেন, তুই এই দুইটা সিন পড়ে রাখ, এই দুইটা তুই করবি। আমি তো ভয়েই শেষ। অনেক অনেক বড় অভিনেতা চোখের সামনে দেখেছি। উনাদের দেখে বুঝেছিলাম অভিনয় জিনিসটা এত সহজ নয়। তাই না করছিলাম। কিন্তু সবাই অনেক বলার পর, সাহস দেয়ার পর চরিত্রটা আমি করি। বাকিটুকু ইতিহাস।’

শামীম বলেন, ‘বন্ধন নাটকটা করতে গিয়ে অনেক প্রশংসা পেলাম। মাছরাঙা প্রোডাকশন হাউসের মালিক অঞ্জন চৌধুরী পিন্টু স্যার আমাকে ২০ হাজার টাকা দিলেন। তুষার ভাই দিলেন আরও ৫ হাজার টাকা শুধুমাত্র একটা দৃশ্য করার জন্য।

তখনই ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল আমি অভিনয় করবো। জীবনে অনেক অভিজ্ঞতা আছে আমার। অভাবী ঘরের মানুষ। অভাব ছিল। নানাভাবে জীবন ধারণের চেষ্টা করেছি। পকেটমার হয়েছি, রিকশা চালিয়েছি। খোদা আমাকে সুন্দর এই পথে নিয়ে এসেছে। আমি পরিশ্রম করে খেতে পারছি। অতীতের কথা বলতে আমার কোনো লজ্জা নেই। কারণ এটা সত্য। সত্য লুকানো যায় না।

আমি দেখেছি সত্য শুনে মানুষ অবাক হলেও সেটাকে সবাই খুব সহজে গ্রহণ করে ও মেনে নেয়। সম্মান করে সত্যকে। পিন্টু স্যার একবার আমাকে ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন আমার সত্যবাদীতার জন্য। আমি তার কাছে অকপটে আমার অতীতের সব কথা বলেছিলাম। তিনি খুশি হয়েছিলেন আমার সততায়।’

অভিনয়ে কেউ প্রভাবিত করে কী জানতে চাইলে শামীম আহমেদ জানান, ‘আমি ১৯৮৬ সালের দিকে মহিলা সমিতি অফিসের পিওন ছিলাম। সেখানে ক্যান্টিনে থাকতাম। আর অভিনয়টা আসলে আমি শিখি হুমায়ূন ফরিদী ভাইকে দেখে দেখে। যখন অভিনেতা হলাম উনার অভিনয় আমাকে প্রভাবিত করল।

অভিনয়ে আরেকজন ম্যাজিশিয়ান আছে আমাদের। এটিএম শামসুজ্জামান নানা। আমার খুব প্রিয়। তার মতো অভিনেতা হতে ইচ্ছে করে। আবার তার কথা ভাবলে মনটাও খারাপ হয়ে আসে। প্রায় ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি এই লাইনে। অভিনয়, লেখা, পরিচালনা, প্রযোজনা-কতকিছু করেছেন। বিরাট বটবৃক্ষ।

কিন্তু এই লোকের মূল্যায়নটা কী হচ্ছে? ২০-৩০ হাজার টাকা পায় এখন নাটকে। সেটাও কতো কাহিনি করে। এই দেশে অভিজ্ঞতার দাম নেই। গ্ল্যামার আর নায়ক-নায়িকা হওয়াটাই বড় কথা। নইলে যেখানে নতুন একটা ছেলে-মেয়ে হুট করে এসেই দিনে ৩০ করে পারিশ্রমিক নেয় সেখানে ষাট বছর ধরে অভিনয় করা একজন মানুষের পারিশ্রমিক তার চেয়ে কম কী করে হয়! তার নাম নিলেই তো ৫০ বলা উচিত। এসব সিস্টেম নেই বলেই এই দেশে নাটকের মান বাড়ে না।

তবে শান্তির ব্যাপার হলো হুট করে আসে যারা হুট করে চলে যায় পয়সা-পাতি, বাড়ি-গাড়ি, স্বামী কামিয়ে। কিন্তু আমরা যারা কম খাই, বেশি দিন বেঁচে আছি। একজন এটিএম শামসুজ্জামান হওয়া ওদের মুখের কথা নয়। আমি তো আমার ক্ষুদ্র ১৭ বছরের ক্যারিয়ারেই দেখলাম কতো গ্ল্যামার এলো গেল। কী নামডাক আর চাহিদা। তাদের অনেককে আজকাল দূরবীন দিয়েও মিডিয়াতে দেখা যায় না। এটিএম শামসুজ্জামান এখনও অভিনয় করে খাচ্ছেন। আমার মতো ছোট মানুষও টিকে আছি।’

শামীম আহমেদ এক হাজারেরও বেশি নাটকে কাজ করেছেন। প্রায় ২৬টা চলচ্চিত্রেও দেখা গেছে তাকে। তার প্রথম সিনেমা ছিল ‘জীবন মরণের সাথী’। শাকিব খানের বন্ধু চরিত্রে কাজ করেছিলেন। এরপর একে একে শাকিবের সঙ্গে আরও অনেক ছবিতে কাজ করেছেন। সিনেমাতে অনেক প্রস্তাব থাকার পরও নিয়মিত হননি তিনি।

কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘শাকিব খান অনেক বড় তারকা। তার সঙ্গে কাজ করার মজা আছে। সেটা আমি পেয়েছি। কিন্তু একটা সময় বাধ্য হয়ে তার সঙ্গে কাজ করা ছাড়তে হলো। অনেক প্রস্তাব ছিল তার ছবিতে অভিনয়ের।

কিন্তু কি করবো। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমার মতো শিল্পীর টিকে থাকা অসম্ভব। ‘মাই নেইম ইজ সুলতান’ ছবির জন্য আমি ২৫ দিন শিডিউল দিয়েছিলাম। পরে দেখা গেলো আমার শিডিউল নিলো ভালো কথা আজ শাকিব অসুস্থ, কাল মাথা ব্যথা, পরশু আসতে দেরি হলো এই করতে করতে চলে যায়।

আজকাল করে শিডিউল নিয়ে ঠিকমতো কাজটা হয় না। পরিচালক ফোন দিয়ে বলে আজ তো হচ্ছে না, কাল আসো। কোনো প্রশ্ন আর করতে পারি না। করলে বলে, বোঝোই তো হিরো। কিছু বলা যায় না। তাকে হয়তো কিছু বলা যায় না, কিন্তু আমার যে একটা দিন নষ্ট হলো সেটার পারিশ্রমিক তো পরিচালক বা শাকিব খান আমাকে দেয় না। প্রযোজকরা তো ছোট শিল্পী ভেবে পাওনা টাকাই ঠিকমতো দেয় না।

এসব কারণেই শাকিব খানের সাথে আর ছবি করি না। আজ ব্যাংকক, কাল মালয়েশিয়া, আজ ঢাকা তো সেটে আসবে ৩টার পর। এভাবে করে তো কাজ করা যায় না। আমি গরিব মানুষ। আমাকে কাজ করতে হয় নিয়মিত। অন্যের শিডিউলের উপর জীবন আমার চলবে কেমন করে।’

অবমূল্যায়নের আক্ষেপ নিয়ে শামীম বলেন, ‘আমার মতো আরও অনেকেই আছেন যাদেরকে পরিচালকরা দুর্বল চোখে দেখেন। পরিচালকদের বলি ভাই, আমাদের ডেটের বিষয়টা ১৫-২০ দিন আগে জানায়েন। আসলে আমারা তো আর নায়ক না, তাই পরিচালকরা আমাদের এতটা গুরুত্ব দেয় না। মনে করে যখন খুশি চাইলেই ডেট পাওয়া যাবে। এমন করে কত ডেট যে খেলো কতজন ঠিক নাই।

তারপর আমাদের টাকা দিতে গিয়েও তাদের কত সমস্যা। টাকা চাইলেই বলে, তোমরা তো নিজেদের লোক পেয়ে যাবা। অথচ নিজেদের লোক হলে তো আগে পাওয়ার কথা। কিন্তু তার আর খবর থাকে না। বলতে থাকি, ভাই আমাদেরও তো পরিবার আছে ,বউ বাচ্চা আছে। অভিনয় করেই তো খাই। অন্যকিছু তো করি না। তাহলে আমাদের সাথেই কেন এমন করা হবে?

ডিরেক্টর, প্রডিউসারকে বাঁচাব তবে আমি বাঁচব- এই চিন্তা নিয়ে যখন তাদের সাথে কাজ করতে যাই তখন তাদের এই চিন্তা থাকে না। তারা অন্যদিকে তাকিয়ে বলে শামীম আইছস! ব…।

কষ্টের তো অনেক জায়গা আছে কয়টা বলবো। আমাদের মতো শিল্পীদের তারা সবসময় এভয়েড করে চলে। আমাদের গুরুত্ব দিতে চায় না।

কলকাতার কিছু শিল্পীদের সাথে কাজ করেছি, অনেক কিছু শিখেছি। ওম, রনি দা তাদের থেকে শিখেছি। তারা শিল্পীদের সম্মান দিতে জানে। কে কি চরিত্র করছে সেটা বিষয় না বিষয় হচ্ছে জায়গাটাতে কে কত সিনিয়র সে হিসেবে তারা সম্মানটাও করে। এরকম অনেক বিষয়ই আছে। কিন্তু আমাদের এখানে হয় না। আমরা সেই গুরুত্বটা পাই না।

সেটে গেলে আমাদের কজন খোঁজ রাখে। অথচ হিরো আসলে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায় কি লাগবে না লাগবে সেজন্য। প্রত্যেকটা হিরোর পেছনে তিনজন চারজন লোক। আর বাকিরা সব মরে যাক। ভাবটা এমন। অথচ সিনেমা বা নাটক কী শুধু হিরোর, হিরোইনের?

‘বেদের মেয়ে জোসনা’ কত বিখ্যাত ছবি। সেটা কী কেবল ইলিয়াস কাঞ্চন আর অঞ্জু ঘোষের জন্যই সফল হয়েছে? দিলদার, সাইফুদ্দিন, শওকত আকবর, রওশন জামিলের অভিনয় কী গুরুত্বপূর্ণ ছিল না? সেগুলো কী দর্শকের মনে দাগ কাটেনি?

যদি তাই হতো তবে রওশন জামিল ওই সিনেমার পরে জোসনার দাদি হিসেবে আলাদা পরিচিতি পেতেন না। শওকত আকবরকে গ্রামের মানুষরা ইলিয়াস কাঞ্চনের বাপ বলে ডাকতেন। কারণ ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ছবিতে তারা বাপ বেটা ছিলেন।

আর পুরো ছবিতে হিরোর সাথে থেকে বিনোদন দিয়ে দর্শক মাতিয়ে রেখেছিলেন দিলদার। দর্শক ওই বিনোদনটাই দেখেছে, আর দেখতে চায়ও। কিন্তু আমরা যাদের সঙ্গে কাজ করি তারা সেটা উপলব্দি করে না। হিরো-হিরোইনের বাইরে তারা আর কিছুই ভাবেন না। এজন্য নাটক-সিনেমার গল্পে কোনো টেস্ট নেই আজকাল। চরিত্রই তো নাই, টেস্ট আসবে কোথা থেকে!

শামীম বলেন, ‘এতসব আক্ষেপের মধ্যেও অনেক আশা আছে। অনেক নির্মাতারা আছেন যারা আদর করেন। পাওনাটা ঠিকমতো দেন। মামুনুর রশীদ স্যারের মতো অনেক সিনিয়ররা আছেন যারা ছেলের মতো কাছে টানেন। অভিনয় শেখান। সাহস দেন। আমি ও আমার শিল্প এসব মানুষদের নিয়েই। যতদিন বাঁচি সবার ভালোবাসা নিয়ে বাঁচবো।’

পাঠকের মতামত: