অনলাইন ডেস্ক ::
দুর্নীতির শীর্ষে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এই সংস্থার কাছে ঘুষের শিকার হয়েছে দেশের ৬০ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সেবা খাতের সাম্প্রতিক দুর্নীতি জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে। জরিপে বলা হয়েছে,২০১৭ সালে তিনটি খাতে সর্বোচ্চ দুর্নীতি হয়েছে। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ৭২ দশমিক ৫ শতাংশ, পাসপোর্ট ৬৭ দশমিক ৩ শতাংশ ও বিআরটিএ ৬৫ দশমিক ৪ শতাংশ দুর্নীতি করেছে। জরিপ অনুযায়ী ২০১৭ মাথাপিছু ঘুষের পরিমাণ ৬৫৮ টাকা। যা ২০১৫ সালে ছিল ৫৩৩ টাকা।
‘সেবাখাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০১৭’ শীর্ষক ও প্রতিবেদন প্রকাশকালে ব্যক্তিস্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহারকে দুর্নীতির সংজ্ঞা হিসেবে উল্লেখ করেছে টিআইবি। সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী, সেবা নিতে গিয়ে সাধারণ মানুষ যেসব দুর্নীতির শিকার হয়েছেন সেগুলো হচ্ছে– ঘুষ, সম্পদ আত্মসাৎ, প্রতারণা, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি ও প্রভাব বিস্তার। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তাদের। চট্টগ্রামে সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড মিডিয়ার কল্যাণে জনসম্মুখে আসায় টিআইবির রিপোর্টটি সাধারণ জনগণের কাছে আরো বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
দুর্নীতির তালিকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষে উঠে আসার বিষয়টি নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা তাৎক্ষণিক কোন মন্তব্য করে নি। সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, টিআইবি‘র রিপোর্ট পর্যালোচনা করে বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে একটি আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেওয়া হবে।
অভিযোগ রয়েছে ঘুষ, দুর্নীতি ছাড়াও নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এক শ্রেণির অসাধু পুলিশ সদস্য। এদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ প্রমাণিত হলেও নানাভাবে তদবির করে তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠছেন। অপরাধ প্রমাণ হলে পুলিশের নিম্নস্তরের সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যান বড় কর্মকর্তারা। কতিপয় অসাধু অর্থলোভী দুর্নীতিবাজের কারণে পুলিশ বাহিনীর ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। সৎ ও আদর্শবান অনেক পুলিশ কর্মকর্তা এদের জন্য বিপাকে পড়ছেন বলে একাধিক পুলিশ কর্মকর্তাই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত করতে গিয়ে ‘অপরাধ’ খুঁজে পায় না পুলিশ। কথিত ইমেজ রক্ষার নামে আড়াল করা হচ্ছে পুলিশের অপরাধ কর্মকাণ্ড। অথচ গুটি কয়েকজনের জন্য পুরো বাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এক হিসেবে দেখা গেছে, প্রতিমাসে সাড়ে ৩শ‘ থেকে ৪শ‘ অভিযোগ জমা হচ্ছে পুলিশ সদর দপ্তরে। রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে অনেকেই নানাভাবে দ্রুত আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে, আবার অনেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে বেপরোয়া হয়ে নানা অপরাধ করছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ, পোস্টিং ও পদোন্নতির কারণেই এমনটা হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। সিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডমিন) মো: মাসুদ উল হাসান আজাদীকে বলেন, অপরাধ একটি রোগ। এতে যে কেউ সংক্রমিত হতে পারে। যেকোনো কমিউনিটিতে যে কেউ অপরাধ করতে পারে। পুলিশের কেউ কেউ অপরাধে জড়ায়। অপরাধ প্রমাণের পর, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়।
অন্যদিকে পুলিশ সদস্যদের এ ধরণের নৈতিক অবক্ষয় চলতে থাকলে আইনের ভিত্তি ভেঙে পড়ার পাশাপাশি সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা নেমে আসবে বলে মনে করেন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন। তিনি আজাদীকে বলেন, ‘যাদের আইন রক্ষা করার কথা তারা যদি আইন ভঙ্গ করেন তাহলে সমাজে প্রচন্ডরকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে এবং সমাজে অন্যায় অপরিসীমভাবে বেড়ে যাবে।
চলতি বছর পুলিশ সপ্তাহ শুরুর প্রেক্ষাপটে পুলিশের মহাপরিদর্শক বলেছিলেন, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে তুলনামূলক অপরাধ পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে এই সময়ে ডাকাতি, খুন, নারী নির্যাতন, অপহরণের মতো অপরাধের ঘটনার হার কমেছে। ভালো কাজের পুরস্কার স্বরূপ আইজিপি পদকও পেয়েছেন এবার ৩২৯ জন পুলিশ সদস্য। তারপরও এই পুলিশ বাহিনীকে নিয়েই প্রচন্ড অসন্তোষ রয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে।
টিআইবি’র জরিপের বাস্তবতা নিয়ে গত শুক্র ও শনিবার মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের সাথে কথা হয় আজাদীর পক্ষ থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে পুলিশের একাধিক অপরাধমূলক কর্মকান্ড সমালোচিত হওয়ায় জরিপটি যথার্থ বলে মন্তব্য করেছেন বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ।
নগরীর মোমিন রোডে সদ্য সমাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ সপ্তাহের একটি ফেস্টুন মনোযোগ সহকারে পড়ছিলেন এক ব্যক্তি। নাম জানতে চাইলে ভড়কে গেলেন। পুলিশ কতোটা জনবান্ধব জানতে চাইলে চলে যেতে উদ্যত হলেন। পরে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে জানালেন, ‘পুলিশের কাছে গেলেই টাকা লাগে, ঘুষ লাগে। এই কারণে আমি সেই ভরসার জায়গাটা পাইনা’। তিনি আরো বলেন, নগরীর বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক পুলিশের এ ধরণের ফেস্টুন, ব্যানার শোভা পাচ্ছে। তবে পুলিশ সম্পর্কে জানাতে গিয়ে প্রায় সকলের চোখে মুখেই ভয়ের ছাপ দেখেছি। একজন বললেন তিনি শহরে নতুন এসেছেন। আরেকজন বললেন, তিনি কোনদিন থানায় যাননি, তাই পুলিশের সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। পুলিশের কথা শুনে ভয়ে কোন মন্তব্য করতেই রাজি হলেন না। তবে চেরাগীর মোড়ে এসে এক রিকশা চালককে পাওয়া গেল, যিনি পুলিশ সম্পর্কে সরাসরি মন্তব্য করলেন। আহমেদ নূর নামে চকরিয়ার সেই রিকশা চালক বললেন, ‘পুলিশ চাইলি এক ঘণ্টাত গোডা দ্যাশ সোজা গড়ি ফেলিত ফারে। কিন্তু গইড়তু ন। গইড়লি পকেট ফুলিবু ক্যানে? ব্যাক দুই নম্বর কাম ত ইতারাই গড়ের।’
টিআইবির রিপোর্ট অনুযায়ী সার্বিক পর্যবেক্ষণে সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্থ খাত হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থায় দুর্নীতির শিকার হয়েছেন ৭২.৫ শতাংশ মানুষ। ঘুষ দিয়েছেন ৬০.৭ শতাংশ মানুষ, যার পরিমাণ ২ হাজার ১শ ৬৬ কোটি টাকা। জরিপে দেখানো হয়েছে, ৮৯ শতাংশ ঘুষ প্রদানকারী ঘুষ দেয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন ‘ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না’ অর্থাৎ ঘুষ আদায়কে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছে। হয়রানি বা জটিলতা এড়াতে ঘুষ দিয়েছেন ৪৭.১ শতাংশ সেবাগ্রহীতা, নির্ধারিত ফি জানা না থাকায় অতিরিক্ত অর্থ দিয়েছেন ৩৭ শতাংশ, নির্ধারিত সময়ে সেবা পেতে ২৩.৩ শতাংশ, আরও দ্রুত সময়ে সেবা পেতে ঘুষ দিয়েছেন ৪.৩ শতাংশ, অবৈধ সুবিধা বা সুযোগ প্রাপ্তির জন্য ঘুষ দিয়েছেন ২ শতাংশ সেবাগ্রহীতা।
ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, জরিপে অংশ নেওয়া ৮৯ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, ঘুষ না দিলে দেশের সেবা খাত থেকে কোন সেবা পাওয়া যায় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্থাগুলো দুর্নীতির শীর্ষে থাকার কথা উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যাদের কাছে মানুষ সার্বক্ষণিক সেবা আশা করেন, জনগণ যাদের কাছে যান তারাই দুর্নীতিগ্রস্ত। তারা দুর্নীতির শীর্ষ খাত হিসেবে জরিপে উঠে এসেছে।
জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, সেবাগ্রহীতাদের সবচেয়ে বেশি হয়রানি করেছে থানা পুলিশ। সেবাগ্রহীতাদের অধিকাংশই বলেছে,আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা তাদের ঘুষ দিতে বাধ্য করেছে। এ ছাড়া মিথ্যা মামলায় জড়ানো, সাধারণ ডায়েরি বা প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণে অবহেলা বা সময়ক্ষেপণ, অসদাচরণ ও ভয়ভীতি দেখানো, আসামিকে গ্রেপ্তার না করা, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন,সময়মতো সঠিকভাবে অভিযোগপত্র না দেওয়া ও বিনা কারণে গ্রেপ্তারের মতো অভিযোগ আছে এই সংস্থার বিরুদ্ধে।
টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, ঘুষ অনিয়ম দুর্নীতির সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের বসবাসের নিয়ম হয়ে গেছে। এটা অমর্যাদাকর। ঘুষ না দিলে সেবা পাওয়া যায় না এই মানসিকতা আমাদের মধ্যে চলে এসেছে। ঘুষ ও দুর্নীতি মেনে নেওয়া সার্বিকভাবে আমাদের জীবনের সংস্কৃতিতে পরিণত হচ্ছে, যার ফলে জাতি হিসেবে আমরা আমাদের আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মানবোধ হারাচ্ছি। তিনি বলেন, দেশের ৮টি বিভাগের ৬৪টি জেলার গ্রাম ও শহরাঞ্চলের ১৫ হাজার ৫৮১টি খানা বা পরিবারের উপর চূড়ান্তভাবে এই জরিপ চালানো হয়। তাতে সেবা খাতে ব্যক্তিস্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহারকে দুর্নীতি হিসেবে ধরা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেই মানুষ সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার হচ্ছে। এই বাহিনীগুলোর কাছে গত বছর গ্রামাঞ্চলের ৭৬ ও শহরাঞ্চলের প্রায় ৭১ ভাগ খানা প্রধান বা পরিবারের কর্তা দুর্নীতির শিকার হয়েছেন।
পাঠকের মতামত: