একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়েছে।
আজ শনিবার রাতে জ্যেষ্ঠ জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক সাংবাদিকদের জানান, রাত সাড়ে ১০টার দিকে মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ১০ মিনিট পর অর্থাৎ ১০টা ৪০ মিনিটের দিকে কাসেম আলীর দেহ ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামানো হয়।
প্রশান্ত কুমার আরো জানান, এরপর সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মীর কাসেমের মরদেহ মানিকগঞ্জে নিজ গ্রামে পাঠানো হবে। মীর কাসেমের ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁর মরদেহ মানিকগঞ্জে পাঠানো হচ্ছে বলে জানান জেল সুপার।
মীর কাসেম জামায়াত নেতাদের মধ্যে পঞ্চম, যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসিতে ঝুললেন।
এর আগে বিভিন্ন সময়ে জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লার রায় কার্যকর হয়। এ ছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায় কার্যকর করা হয়েছে।
আজ দুপুরে রায় কার্যকরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী আদেশের কপি কারাগারে পৌঁছায়। এর অনুলিপি পাঠানো হয় জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার ও সিভিল সার্জনের কাছে। এরপর বিকেলে পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎ করতে যান মীর কাসেম আলীর সঙ্গে। এরপরই রটে যায় মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় রাতে বাস্তবায়ন হচ্ছে।
এর পরই একে একে কারাগারে প্রবেশ করেন কারা মহাপরিদর্শক, কারা উপমহাপরিদর্শক, ইমাম, জেলা প্রশাসক, জেলা নির্বাহী হাকিম ও সিভিল সার্জন। এ ছাড়া তিনটি অ্যাম্বুলেন্সও কারাগারে প্রবেশ করে। কারাগার এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়।
রায় কার্যকর হতে যাচ্ছে এমন খবর পেয়ে সেখানে জড়ো হতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধাসহ আশপাশের উৎসুক জনতা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎসুক মানুষের ভিড়ও সেখানে বাড়তে থাকে।
এর পরই গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে খবর আসে মীর কাসেম আলীর রায় কার্যকরের।
গত মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) মীর কাসেম আলীর রায় বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তাঁর পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে এ রায় দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান। এর মধ্যে দিয়েই শেষ হয়ে যায় আইনি লড়াই।
ওই দিন রাত ১২টা ৪৮ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মীর কাসেম আলীর রিভিউ খারিজ সংক্রান্ত রায়ের কপি কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার ২-এ পৌঁছানো হয়। রাত অনেক বেশি হওয়ায় তখন মীর কাসেম আলীকে তা পড়ে শোনানো হয়নি। পরদিন বুধবার সকাল সাড়ে ৭টায় আনুষ্ঠানিকভাবে রায় পড়ে শোনানো হয়। তারপর নিয়ম অনুযায়ী প্রাণভিক্ষার জন্য আবেদন জানানোর জন্য বলা হলেও তাতে সায় দেননি এই আলবদর নেতা।
মীর কাসেম ২০১২ সালের ১৭ জুন গ্রেপ্তারের পর থেকে কাশিমপুর কারাগারেই ছিলেন। ২০১৪ সালের আগে তিনি এ কারাগারে হাজতবাসকালে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দির মর্যাদায় ছিলেন।
পরে ২০১৪ সালের নভেম্বরে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হলে তাঁকে ফাঁসির সেলে পাঠানো হয়। তবে এর আগে ওই বছরই ২০ জুন তাঁকে কাশিমপুরের কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছিল। পরে ২৬ জুলাই আবার তাঁকে কাশিমপুর কারাগারে ফেরত পাঠানো হয়।
একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলে নয়া দিগন্ত কার্যালয় থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মীর কাসেমকে। পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর যুদ্ধাপরাধের বিচার।
মামলার সারসংক্ষেপ
২০১৪ সালের ২ নভেম্বর মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের রায়ে মীর কাসেমের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টি প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে দুটিতে (১১ ও ১২ নম্বর অভিযোগ) মীর কাসেম আলীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া চারটি অভিযোগে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়।
১১ নম্বর অভিযোগে রয়েছে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ ছয়জনকে আটক, নির্যাতন ও হত্যার বিষয়টি। এ অভিযোগে বিচারকরা সর্বসম্মতিক্রমে মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। ১২ নম্বর অভিযোগে রয়েছে রঞ্জিত দাস ও টুন্টু সেনকে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ। এ অভিযোগে বিচারকদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রায় দেওয়া হয়। ১১ ও ১২ নম্বর ছাড়া বাকি ১২টিই অপহরণের পর আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ মীর কাসেমের বিরুদ্ধে।
প্রমাণিত অভিযোগগুলোর মধ্যে ২ নম্বরটিতে মীর কাসেমকে ২০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। ৩, ৪, ৬, ৭, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে তাঁকে সাত বছর করে মোট ৪২ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া ১৪ নম্বর অভিযোগে ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। এই আটটি অভিযোগে তাঁকে ৭২ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। তবে ১, ৫, ৮ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে এসব থেকে খালাস (অব্যাহতি) দেওয়া হয়।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় মীর কাসেম আলীর পক্ষে আপিল করেন জয়নুল আবেদীন তুহিন। মীর কাসেমের পক্ষে ১৮১টি যুক্তি দেখিয়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস চেয়ে এ আপিল করা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম আলী মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রমাণিত হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলায় ট্রাইব্যুনালের আদেশে ২০১২ সালের ১৭ জুন মীর কাসেম আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেই থেকে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
এর আগে গত ৬ জানুয়ারি জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। এ মামলা এখন পূর্ণাঙ্গ রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। এটি আপিলের ষষ্ঠ রায়।
এ ছাড়া আপিলে চূড়ান্ত পাঁচটি রায়ের পর চারটিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
আপিলের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি গত ৩১ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়। রায় রিভিউ চেয়ে রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষ এরই মধ্যে আবেদন দাখিল করেছে।
পাঠকের মতামত: