নিউজ ডেস্ক ::
মিয়ানমারে বেসামরিক সরকার এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে দ্বন্দ্ব আগে থেকেই ছিল। নভেম্বরে নির্বাচন পর থেকেই মতদ্বৈততা প্রকাশ্যে চলে আসে। নির্বাচনে অং সান সু চির এনএলডি দল ৮৩ শতাংশ আসনে জয়লাভ করে। তখন থেকেই সেনাবাহিনী দাবি করছে, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে এবং পুননির্বাচন করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে একাধিকবার ব্যর্থ আলোচনা হয়েছে। সর্বশেষ রবিবার (৩১ জানুয়ারি) গভীর রাতে সু চিসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। কেন এই রাজনৈতিক অস্থিরতা, এই মুহূর্তে কেন হলো, চীনের ভূমিকা কী হবে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্বিধা এবং রোহিঙ্গা সমস্যায় এর প্রভাব কী পড়বে তা নিয়ে সামনে চলে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মিয়ানমারের নেতৃত্বে যে-ই থাকুক তাদের রোহিঙ্গা নীতিতে কোনও পরিবর্তন হবে না। এজন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ কোর্ট (আইসিসি) ও আন্তর্জাতিক বিচারিক কোর্টে (আইসিজে) আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে বাংলাদেশের।
কেন এই রাজনৈতিক অস্থিরতা
মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কূটনীতিক বলেন, ১৯৬২ থেকে শক্ত হাতে মিয়ানমার শাসন করেছে সেনাবাহিনী। ২০১১ সালের পর থেকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ওই বাহিনী ধীরে ধীরে তাদের প্রভাব হারিয়ে ফেলছিল।
উদাহারণ হিসেবে তিনি বলেন, আগে নির্বাচন কমিশন গঠন করতো সেনাবাহিনী। এখন সেটি করছে বেসামরিক সরকার গঠন করছে। সুপ্রিম কোর্টে ৯ জন বিচারকের মধ্যে ৬ জন আগে নিয়োগ পেতো সেনাবাহিনী থেকে, যা এখন কমে গেছে। এ ধরনের আরও অনেক জায়গায় সামরিক বাহিনী তাদের কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলছিল।
তিনি বলেন, ‘নভেম্বরের নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার জন্য একাধিকবার আহ্বান জানিয়েছে আর্মি। কিন্তু বেসামরিক নির্বাচন কমিশন সেটিতে কর্ণপাত করেনি। নির্বাচনের ফলাফল আর্মিদের পক্ষে না যাওয়ায় স্বভাবতই তারা খুশি ছিল না। এনএলডি ও আর্মির মধ্যে যে দূরত্ব সেটি আরও বেড়ে গিয়েছিল।’
আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে গত কয়েক বছরে এনএলডি ও সু চির চীনের প্রতি ঝুঁকে যাওয়ায় বিশেষ করে রোহিঙ্গা সমস্যা তৈরি হওয়ার পর থেকে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ থেকে শুরু বিভিন্ন জায়গায় চীন ঢাল হিসেবে মিয়ানমারকে রক্ষা করেছে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এবং এই অতিরিক্ত মাত্রায় ঝুঁকে পড়াটা আর্মি ভালো চোখে নেয়নি।’
এই মুহূর্তে কেন
১৯৮৮ সালে রাজনৈতিক জীবন শুরুর পর গত তিন বছরে সু চির আন্তর্জাতিক জনপ্রিয়তা সবচেয়ে কম। এছাড়া নভেম্বর নির্বাচনের ফলাফল নোটিফিকেশন এই সপ্তাহে হওয়ার কথা যা মিয়ানমার আর্মি গতে দিতে চায়নি।
এ বিষয়ে আরেকজন কূটনীতিক বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে সু চির যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল সেটি রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের কারণে এখন আর নেই। সু চি নিয়ে যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্বিধাগ্রস্থ সেই সময়টি বেছে নিয়েছে আর্মি।’
আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে নভেম্বর নির্বাচনের ফলাফল এই সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করার কথা ছিল যেটি আর্মি চায়নি বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, ৬ জানুয়ারি ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্যাপিটল হিলে বিক্ষোভ করতে তার সমর্থকদের আহ্বান করেছিল কারণ ওইদিন আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের নাম প্রকাশ করার দিন ছিল।
একইরকম ভাবে মিয়ানমার নির্বাচনের ফলাফলের আইনগত ভিত্তি দিতে রাজি ছিল না আর্মি এবং সেই কারণে তারা একাধিকবার নির্বাচন বাতিলের দাবি করেছিল।
কোভিড পরিস্থিতি ও যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকার আরেকটি কারণ পশ্চিমা বিশ্ব এখন অর্থনৈতিকভাবে চাপে আছে। অন্যদিকে মার্কিন প্রশাসন মাত্র কয়েকদিন আগে ক্ষমতা নিয়েছে যার কারণে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো অবস্থায় ওই দেশ নেই।
চীনের অবস্থান
আরেকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, এই খেলায় চীনের অবস্থানের ওপর নির্ভর করবে ভবিষ্যতে অন্য যারা রয়েছে তাদের অবস্থান কী হবে।
তিনি বলেন, চীন এখন বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে আবির্ভুত হতে যাচ্ছে এবং এই মুহূর্তে একটি অগণতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে সাবধান থাকবে ওই দেশ।
গত কয়েক বছর এনএলডি সরকারের সঙ্গে ঘণিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছে চীন এবং ক্ষমতা পালাবদলের পরে আর্মির সঙ্গেও একই ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইবে চীন তাদের নিজস্ব স্বার্থের জন্য বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, আশা করা যায় মিয়ানমার নিয়ে চীন হয়তো কোনও বিবৃতি দিতে পারে এবং এই বিষয়গুলি তখন পরিষ্কার হবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবস্থান
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সু চির অবস্থান আগের মতো নেই। রোহিঙ্গা নির্যাতনে সমর্থন দেওয়ার কারণে নিন্দিত হয়েছে মিয়ানমারের নেত্রী। কিন্তু তারপরেও মিয়ানমারের গুরুত্বের কারণে দেশটির বিরুদ্ধে শক্ত কোনও অবস্থানে যাওয়ার আগে চিন্তা করবে পশ্চিমা বিশ্ব।
এ বিষয়ে একজন কূটনীতিক বলেন, ‘পশ্চিমা বিশ্বের যেকোনও শক্ত অবস্থান মিয়ানমারকে চীনের দিকে ঠেলে দেবে এটি তারা জানে। এজন্য অবরোধ বা এ ধরনের কার্যক্রম সহসা দেখার কোনও সম্ভাবনা নেই বলে মনে হচ্ছে।’
অন্যদিকে মিয়ানমারের অগনতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে কিভাবে পশ্চিমা বিশ্ব যোগাযোগ ও সম্পর্ক বজায় রাখে সেটি এখন দেখার বিষয়।
তিনি বলেন, ‘প্রথম যে বিবৃতি দেওয়া হয় সেটি খুব সহজ কারণ সেখানে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে, মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে বা এধরনের মন্তব্য থাকে কিন্তু পরবর্তীতে সম্পর্ক কীভাবে রক্ষা করা হয় সেটি গুরুত্বপূর্ণ।’
রোহিঙ্গা সমস্যা
বেসামরিক সরকার ও আর্মির মধ্যে প্রায় সব বিষয়ে মতবিরোধ থাকলেও রোহিঙ্গা নীতিতে দুইপক্ষের অবস্থান ছিল এক এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে উভয়ই দোষী।
এ বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মোহাম্মাদ শহীদুল হক বলেন, ‘এই নীতির কোনও পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা কম।’
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনার কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই পালা বদলকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করতে পারে মিয়ানমার।’
পাঠকের মতামত: