ভালো ফলনে জীবনমান বদলে যাচ্ছে পাহাড়ি চাষীদের
এনামুল হক কাশেমী :: বান্দরবানের পাহাড়ে পাহাড়ে এবারও আশানুরূপ ফলন ফলেছে নানাপ্রজাতি আমের। পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসুমেও পাহাড়ের নানাস্থানে এবারও আম্রপালি, রাংগৈ এবং স্থানীয়জাতের আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে পাহাড়ি কৃষকদের জীবনমানও বদলে যাচ্ছে। তারা ক্রমেই স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন আর্থিকভাবেও।
বিশেষ করে বান্দরবান জেলার সদর, রুমা, থানচি এবং রোয়াংছড়ি উপজেলার নানাস্থানে চলতি মৌসুমেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাগানে আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। বান্দরবান সদর উপজেলায় বম ও মারমা, থানছি উপজেলায় মারমা ও ম্রো এবং রোয়াংছড়ি উপজেলায় মারমা ও তংচ্যঙ্গা সম্প্রদায় তাদের নির্ধারিত বাগানে আম্রপালি, রাংগৈ এবং দেশিজাতের রকমারী আমের আবাদ করে আসছে। বান্দরবান জেলার মাটি ও প্রকৃতির কারণে এখানে উৎপাদিত নানাপ্রজাতির আম খেতে সুস্বাদু এবং মিষ্টিও।
স্থানীয় আমচাষীদের তথ্য মতে, জেলায় উৎপাদিত কাঁচা ও পাকা আমের চাহিদা রয়েছে সারাদেশেই। বিষমুক্ত এসব আম পাইকারী ব্যবসায়ীরা আগাম অর্থ দিয়েই চাষীদের কাছ থেকে কিনে নেন। এখন আম সংগ্রহ ও বিক্রির ভরা মৌসুম।
কেবল জেলা সদরের ফারুক মুনপাড়া, কেৎসিমানি পাড়া, সারণপাড়া, লাইমীপাড়া এবং চিম্বুক এলাকা থেকে প্রতিদিনই ২০ থেকে ২৫টি ট্রাকযোগে আম সরবরাহ করা হচ্ছে দেশের নানাস্থানে।
বান্দরবান-রুমা ও থানছি সড়কের দুইপাশে এবং পাহাড়ের পাদদেশে শত শত একর পাহাড়ি (তৃতীয়-দ্বিতীয় শ্রেণীর জমি) জমিতে সৃজিত বাগান থেকে আম সংগ্রহ করার কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বম, মারমা, ম্রো এবং তনচংগ্যা উপজাতীয় চাষীরা। তারা প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ আম জেলার বাইরে সরবরাহ করা ছাড়াও স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ করছেন। সুবিধামত সময়ে সংরক্ষণ করা আম জেলার বাইরে সরবরাহ করা হচ্ছে নিয়মিত।
গেৎসিমানি পাড়ার আমচাষী ও ইউপি সদস্য লাল হাই বম বলেন, এবারে বাগানে বাগানে বাম্পার ফলন হয়েছে রাংগৈ ও আম্রপালি আমের। জেলা সদর থেকে ১২ মাইল দীর্ঘ প্রধান সড়কজুড়েই দুইপাশের শত শত বাগানে এবার বিপুল পরিমাণ আমের ফলন হয়েছে। কেবল এসব এলাকায় প্রায় ১ হাজার একর পাহাড়ি জমিতে হাজারও চাষী এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বাগান থেকে আমসংগ্রহের কাজে। রুমা উপজেলার মিরজিরি এবং আমতলীপাড়ার আমচাষী চিংপ্রু মারমা এবং শৈচিং মারমা বলেন, তাদের বাগানেও এবারে আমের বিপুল ফলন হয়েছে। তারা উচিত দাম পাচ্ছেন পাইকারী ও খুচরা ক্রেতাদের কাছ থেকে। থানচি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এবং আদর্শ আমচাষী খামলাই ম্রো বলেন, এবারে তার আম বাগানে বিপুল পরিমাণ রাংগৈ এবং আম্রপালি আমের ফলন হয়েছে। কাঁচা আম প্রতিমণ ১২ শ” টাকা এবং পাকা আম প্রতিমণ ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা দামে বিক্রি করা হচ্ছে। পাইকার ব্যবসায়ীরাও বাগানস্থল থেকে আম ক্রয় করে নিচ্ছেন বলেও তিনি জানান। এবার তিনি বাগান থেকে উৎপাদিত আম বিক্রি করে ৫ লাখ টাকা আয় করবেন বলে আশাবাদী। তবে আমচাষীরা বলছেন, জেলা সদর কিংবা উপজেলা সদরে সরকারি পর্যায়ে এখনও পর্যন্ত কোন হিমাগার গড়ে না উঠায় আমচাষীরা ফি বছরই বিপুল অংকের নিশ্চিত অর্থ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সংরক্ষণের অভাবে। কারণ বর্ষার সময় বা অতিগরমের সময়ই বাগানে আম পাকা শুরু হয়। তাই পাকা আম সংর ণ করা সম্ভব হয় না। ফলে চাষীরা সময় মতে আম বিক্রি করতে না পারায় পঁচে যায় বিপুল পরিমাণ আম।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, নিজেদের উদ্যোগ ছাড়াও পার্বত্য জেলা পরিষদের সহায়তায় ৭টি উপজেলায় ৪ হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে আম্রপালি ও রাংগৈ আম, ৭হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে নানাপ্রজাতির কলা, ৬ হাজার ৫ হেক্টর জমিতে পেঁপে, ৪হাজার ৭৮০ হেক্টর জমিতে আনারস, ৩হাজার হেক্টর জমিতে কাঁঠাল, ২ হাজার ৭৫ হেক্টের জমিতে কমলা, ১হাজার ১০হেক্টর জমিতে লিচু, ১৪ হাজার ৬৪১ হেক্টর জমিতে অন্যান্য মৌসুমী ফলের চাষ হয়েছে।
জেলার কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো.আলতাফ হোসেন বলেন, জেলায় মারমা, ম্রো এবং বম আদিবাসীদের মিশ্র ফলচাষ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে তাদের জীবনমানও উন্নতি হচ্ছে। তারা আর্থিকভাবেই লাভবান হচ্ছেন বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, জেলার পাহাড়ি মাটি আমসহ নানা মৌসুমী ফল উৎপাদনে খুবই উপযোগী। অধিকতর লাভজনক হওয়ায় জুমচাষ ছেড়ে অনেকেই আমচাষে এগুচ্ছেন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ থেকে আমচাষীসহ ফলদ চাষীদের টেকসই আবাদসহ কৃষি-খামার গড়ে তোলার বিষয়ে সাধ্যমত সাধারণ ও বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে।
পাঠকের মতামত: