ঢাকা,সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪

বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে মায়ের মৃত্যুর পর বেপরোয়া সম্রাট

নিউজ ডেস্ক :: ঘন জঙ্গলে রাখা ৩০ বর্গফুট আয়তনের একটি খাঁচার ভেতর হুংকার ছাড়ছিল ৯ বছর বয়সী সম্রাট। মাঝেমধ্যে করছিল লাফালাফি। মানুষ দেখলেই তেড়ে আসছিল। এরপর আবার শুরু করছিল গর্জন-হুংকার। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যতক্ষণ দর্শনার্থীরা থাকেন, ততক্ষণ গর্জন-হুংকার থাকে সম্রাটের।

সম্রাট হচ্ছে পশুর রাজা একটি পুরুষ সিংহের নাম। এই সিংহ এখন আছে কক্সবাজার শহর থেকে ৫২ কিলোমিটার দূরে চকরিয়ার ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে। পার্কের সিংহ খাঁচা বা প্রকোষ্ঠে (মিনি এনক্লোজার) সম্রাটের বেড়ে ওঠা।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর দুপুরে পার্কে গিয়ে দেখা গেল, প্রকোষ্ঠের ভেতরে একাকী হুংকার ছাড়ছিল সম্রাট। লোহার শেকলের ফাঁক দিয়ে ছবি তোলার সময় তেড়ে এল সিংহটি। পশ্চিম পাশে লাগোয়া আরেকটি প্রকোষ্ঠে শুয়ে আছে রাসেল ও টুম্পা নামে আরও দুটি সিংহ। তারা আবার শান্ত। গর্জন-হুংকার কোনোটাই নেই। সিংহগুলোর লালনপালনকারী মো. নুরুজ্জামান ডাক দিলেন রাসেল ও টুম্পাকে। সঙ্গে সঙ্গে সিংহ দুটো লোহার জালের কাছে চলে এল। তারপর দুজন খুনসুটিতে লেগে গেল। কিন্তু ওপাশের প্রকোষ্ঠে সম্রাটের থামাথামি নেই, হুংকার দিয়েই যাচ্ছে সে।

সম্রাটের এমন গর্জন কত দিন ধরে চলছে জানতে চাইলে সিংহ ও বাঘের সংরক্ষক মো. নুরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক মাস ধরে সম্রাটের এমন আচরণ দেখা যাচ্ছে। এখন তার যৌবনকাল। থাকে একাকী। সম্ভবত এ কারণে তার হুংকার বেড়েছে।

প্রকোষ্ঠের ভেতরে সম্রাট একাকী কেন—এ খবর কমবেশি সবার জানা। পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে সাফারি পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত ২৩ এপ্রিল নদী নামের একটি সিংহী মারা গেলে সম্রাট একা হয়ে যায়। এর আগে সম্রাট আর নদী এই প্রকোষ্ঠে ছিল। নদীর পেটেই জন্ম সম্রাটের। সম্পর্কে মা-ছেলে হলেও ঝগড়া-বিবাদেই কাটত দুজনের সময়। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নদীর গলা ও পেটে কামড় বসিয়ে দেয় সম্রাট। এরপর নদীকে চিকিৎসার জন্য বন্য প্রাণী হাসপাতালে নেওয়া হলে সম্রাট একা হয়ে পড়ে। নদীর বয়স ছিল ১৫ বছর।

পার্কের কর্মকর্তারা বলেন, একই প্রকোষ্ঠে ২২ বছর বয়সী আরেক সিংহ সোহেলের সঙ্গে ১১ বছরের সংসার ছিল নদীর। তাদের সংসারে জন্ম নেয় টুম্পা (১০) ও সম্রাট (৯) নামের দুই সন্তান। সোহেলের প্রথম সংসার ছিল হীরার সঙ্গে। হীরার পেটে জন্ম রাসেল (১৫) নামে সিংহটির। রাসেলকে রেখে বেষ্টনীতে মারা যায় হীরা। ২০০৪ সালে ৪ বছর বয়সী সোহেলকে এই পার্কে আনা হয়েছিল। নদীর মৃত্যুর পর রাসেল ও টুম্পার অবস্থা স্বাভাবিক দেখা গেলেও সম্রাটের মেজাজ খিটখিটে হয়ে পড়ে।

প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা সুপন নন্দী বলেন, স্বাভাবিক অবস্থায় সিংহ বাঁচে ১৫ থেকে ১৮ বছর। সাফারি পার্কে মারা যাওয়া সোহেলের বয়স ছিল ২২ বছর। নদীর বয়স ছিল ১৫ বছর। অসুস্থ এবং বার্ধক্যজনিত কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছিল। তিনি বলেন, প্রকোষ্ঠের পূর্বপাশে তৈরি হচ্ছে ১১১ একরের বিশাল সিংহ বেষ্টনী। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বেষ্টনীতে ছেড়ে দেওয়া হবে রাসেল, টুম্পা ও সম্রাটকে। তখন সম্রাটের হুংকার কিছুটা কমতে পারে।

সিংহ প্রকোষ্ঠের পাশে আলাদা দুটি বাঘের প্রকোষ্ঠ আছে। সেখানে আছে চারটি বাঘ। একটিতে থাকে জয় আর জুঁই। আরেকটিতে আছে আঁখি আর বড়ুয়া। সিংহ বেষ্টনীর পাশে বাঘের জন্যও ৯০ একরের পৃথক বেষ্টনী তৈরি হচ্ছে।

প্রকোষ্ঠে বাঘগুলো সব সময় চুপচাপ থাকে জানিয়ে পার্কের কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম বলেন, বাঘ ও সিংহগুলোকে প্রতিদিন বিকেলে ৬ কেজি করে গরুর মাংস খাওয়ানো হয়। তবে সপ্তাহের এক দিন মঙ্গলবার তাদের মাংস সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়।

পার্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০১ সালের ১৯ জানুয়ারি ২ হাজার ২৫০ একর বনাঞ্চলে গড়ে তোলা হয় দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। এর আগে ১৯৮০ সালে এটি ছিল হরিণ প্রজননকেন্দ্র। বর্তমানে পার্কে আছে জেব্রা, জলহস্তী, ময়ূর, অজগর, কুমির, হাতি, বাঘ, ভালুক, সিংহ, হরিণ, লামচিতা, শকুন, কচ্ছপ, রাজ ধনেশ, কাক ধনেশ, ইগল, সাদা বক, রঙ্গিলা বক, সারস, কাস্তেচরা, মথুরা, নিশিবক, কানিবক, বন গরুসহ ৫২ প্রজাতির ৩৪১টি প্রাণী। এগুলো আবদ্ধ অবস্থায় আছে। উন্মুক্তভাবে আছে ১২৩ প্রজাতির ১ হাজার ৬৫টি প্রাণী। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গুইসাপ, শজারু, বাগডাশ, মার্বেল ক্যাট, গোল্ডেন ক্যাট, ফিশিং ক্যাট, খ্যাঁকশিয়াল ও বনরুই।প্রথম আলো

পাঠকের মতামত: