১০২ কিমি এর মধ্যে ৯৫ কিমি লাইনের কাজ শেষ ।। পটিয়া স্টেশনে ট্রায়াল ট্রেন প্রস্তুত
নিজস্ব প্রতিবেদক ::
এ যেন বিশাল আকৃতির একটি ঝিনুক! ঝিনুকের পেটে মুক্তার দানা! তার চারপাশে পড়ছে স্বচ্ছ জলরাশি। এর মধ্যেই আসছে ট্রেন। ঝকঝকে আধুনিক এ স্টেশন অনেকটাই উন্নত বিশ্বের বিমানবন্দরের মতো। নির্মাণ কাজ শেষে এখন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে দেশের প্রথম আইকনিক রেলস্টেশন ভবনটি। ঝিনুকের আদলে অপূর্ব নির্মাণ শৈলীতে গড়ে ওঠা আইকনিক স্টেশন ভবন এখন পর্যটক বরণে প্রস্তুত। ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৯ একর জায়গাজুড়ে নির্মিত এই স্টেশন ভবনটি হয়ে উঠবে এই অঞ্চলের পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থানে।
এ ব্যাপারে দোহাজারী–কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মুহম্মদ আবুল কালাম চৌধুরী বলেন, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ঝিলংজা ইউনিয়নের প্রায় ২৯ একর জায়গাজুড়ে ঝিনুকের আদলে নির্মিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মানের এই স্টেশন ভবনটি। নান্দনিক ডিজাইন আর নির্মাণ শৈলীতে গড়া স্টেশনটির চারদিকে বসানো হয়েছে গ্লাস। ছাউনিটা পুরো কাঠামোকে ঢেকে রেখেছে। ওপরের ছাদ খোলা থাকায় থাকছে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা। দিনের বেলা বাড়তি আলো ব্যবহার করতে হবে না এই রেলস্টেশনে। ফলে সবসময় ভবনটি সহনীয় তাপমাত্রায় থাকবে। স্টেশনটির ছাদ ঝিনুক আকৃতির। এখন সামনে বসানো হচ্ছে ফোয়ারা। সেখানে বসানো হচ্ছে মুক্তা। ৬টি লিফট ও ২টি চলন্ত সিঁড়ি স্থাপনের কাজ শেষ করছেন শ্রমিকরা।
সুবিশাল এই চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলা থেকে নামতে হবে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। আর আসার সময় যাত্রীরা বের হবেন নিচ থেকে। পুরো ভবন দৃশ্যমান হয়েছে। তবে ভেতরে ৩য়–৪র্থ তলায় কিছু কাজ বাকি আছে। বাকি আছে সামনে গার্ডেনিংয়ের কিছু কাজও। ফ্লাটফর্মের শেডের কাজ চলছে। প্রকৌশলী মুহম্মদ আবুল কালাম চৌধুরী বলেন, কক্সবাজার স্টেশনের অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ শেষ হতে আরো ১৫ দিনের মতো লাগবে।
এদিকে ডুলাহাজারা এবং রামু স্টেশনের কাজও শেষ হয়েছে। দোহাজারী স্টেশনের কাজ শেষ হবে কিছু দিনের মধ্যে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার রেল লাইনের মধ্যে ৯৫ কিলোমিটার রেল লাইন বসে গেছে। এখন বাকি আছে মাত্র ৭ কিলোমিটার রেল লাইন। এটাও কিছুদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। আমাদের শ্রমিকরা দিনরাত কাজ করছেন। আমরাও দিন–রাত কাজ করছি।
আগামী ২৮ অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধন করবেন। একই দিন চট্টগ্রামের দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের (লালখান বাজার থেকে বিমান বন্দর পর্যন্ত) উদ্বোধনের কথা কথা শোনা যাচ্ছে। একই দিনে বহুল কাংখিত দোহাজারী–কক্সবাজার রেল লাইনেরও উদ্বোধন হতে পারে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। কারণ ২৮ অক্টোবরের পর নভেম্বরে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার পর আর কোনো প্রকল্প উদ্বোধন করবেন না প্রধানমন্ত্রী।
এ ব্যাপারে দোহাজারী–কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মুহম্মদ আবুল কালাম চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী ২৮ অক্টোবরে বঙ্গবন্ধু টানেল এবং লালখান বাজার থেকে বিমান বন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধনের জন্য চট্টগ্রাম আসলে একই দিনে দোহাজারী–কক্সবাজার রেল লাইনেরও উদ্বোধন করতে পারেন। দোহাজারী–কক্সবাজার রেল লাইন শুধু চট্টগ্রাম–কক্সবাজারবাসীর কাছে নয়, এটা পর্যটন প্রিয় সারাদেশের মানুষের কাছে খুবই আগ্রহের বিষয়। তাই প্রধানমন্ত্রী একই দিনে চট্টগ্রাম থেকে তিন মেগা প্রকল্পের উদ্বোধন করতে পারেন বলে জানা গেছে।
ইতোমধ্যে অবশিষ্ট ৭ কিলোমিটার রেল লাইন বসানো হলে ফিনিশিং ওয়ার্কসহ অবশিষ্ট কাজ শেষ করে অক্টোবরে আমরা ট্রায়াল রান উদ্বোধন করতে পারবেন বলে আশা করেন প্রকৌশলী মুহম্মদ আবুল কালাম চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রথমত আমরা এক জোড়া ট্রেন দিয়ে হলেও চালু করে দেব। আশা করছি, আগামী জুনে বাণিজ্যিক পরিচালনা শুরু করতে পারব।
এদিকে কালুরঘাট সেতুর মেরামত কাজ শুরুর আগে দোহাজারী–কক্সবাজার রুটের ট্রায়াল ট্রেনটি পটিয়া স্টেশনে নিয়ে রাখা হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে সুবর্ণ এক্সপ্রেসের অবমুক্ত ইনকা ৬টি কোচের একটি বিশেষ ট্রেন (২২০৪ ইঞ্জিন) দিয়ে ট্রায়াল দেয়া হবে দোহাজারী–কক্সবাজার রুটে। ট্রায়াল ট্রেনটিকে ঘিরে রেলওয়ে পুলিশ এবং আরএনবি কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।
দোহাজারী–কক্সবাজার রেলওয়ে প্রকল্পের কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার মো. আবদুল জাবের মিলন বলেন, আইকনিক এই স্টেশনটি নির্মাণের সময় চীন, বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, ইতালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক স্টেশনের সুযোগ–সুবিধা বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। পুরো প্রকল্পটিতে ১১০ জন বিদেশিসহ মোট ২৫০ জন প্রকৌশলী এবং শ্রমিক মিলে মোট ছয় শতাধিক লোকের চার বছরের শ্রম রয়েছে। এশিয়ার প্রথম শতভাগ পর্যটনবান্ধব কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছয় তলা বিশিষ্ট স্টেশনটির সম্পূর্ণ ফ্লোর এরিয়া ১ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুট করে। রয়েছে পর্যটকদের জন্য সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা। শুধু এই আইকনিক রেলস্টেশন নয়, এই প্রকল্পের আওতায় আরো ৮টি স্টেশনের মধ্যে তিনটির কাজ শেষ। অবশিষ্ট ৫টির কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে। কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের দিকে পরের স্টেশনটি রামু স্টেশন। এরপর পর্যায়ক্রমে রয়েছে ইসলামাবাদ, ডুলাহাজারা, চকরিয়া, হারবাং, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া ও দোহাজারী রেলওয়ে স্টেশন। এসব স্টেশনে থাকছে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগন্যাল সিস্টেম এবং ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম। চট্টগ্রামের দোহাজারী–কক্সবাজার রেললাইন, যা ছিল চট্টগ্রামবাসীর জন্য স্বপ্নের মতো। এখন এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে।
হোটেলের সুবিধা পাবেন আইকনিক স্টেশনে : প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, কক্সবাজারে পর্যটকদের অর্ধেকই আসেন একদিনের জন্য। পর্যটকরা যেন কক্সবাজারে দিনে এসে ঘুরে আবার ফিরে যেতে পারেন, সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এজন্য কক্সবাজারের ঝিলংজায় নির্মিত আইকনিক স্টেশনে থাকছে আকর্ষণীয় সুবিধা। কক্সবাজার রেল লাইন চালু হওয়ার পর তারা সকালে কক্সবাজার গিয়ে আইকনিক স্টেশনে লাগেজ রেখে সারাদিন সৈকতে ঘুরে আবার রাতের ট্রেনে চলে যেতে পারবেন। এজন্য হোটেল বুকিং করতে হবে না। হোটেল ভাড়া সাশ্রয় হবে।
দীর্ঘদিন থেকে কক্সবাজার ভ্রমণকারী পর্যটকরা নিজেদের মালপত্র রাখার নিরাপদ জায়গা পান না। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্পে আইকনিক স্টেশন ভবনটি নির্মাণের সময় রাখা হয়েছে যাত্রীদের লাগেজ ও লকার সিস্টেমের। এছাড়া থাকছে আধুনিক ট্রাফিক সুবিধা, বিশ্বমানের এ স্টেশনের নিচতলায় থাকছে টিকিট কাউন্টার, অভ্যর্থনা, লকারসহ নানা সুবিধা। দ্বিতীয় তলায় শপিংমল ও রেস্তোরাঁ। তিনতলায় থাকবে তারকা মানের হোটেল, যেখানে ৩৯টি রুমে থাকার সুযোগ পাবেন যাত্রীরা। স্টেশনের ভেতরেই থাকছে কেনাকাটার ব্যবস্থা। থাকছে হলরুম। আবার চাইলেই নির্দিষ্ট লকারে ব্যাগ রেখে পর্যটকরা ঘুরে আসতে পারবেন পুরো শহর। এমন ৫০০টি লকারের ব্যবস্থা থাকছে স্টেশন বিল্ডিংয়ে। থাকছে হোটেল ও গোসলখানা। থাকছে মসজিদ, শিশু যত্ন কেন্দ্র ও চলন্ত সিঁড়ি। থাকছে সাধারণ ও ভিআইপিদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ড্রপ এরিয়া, বাস, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস এবং থ্রি হুইলারের জন্য আলাদা পার্কিং এরিয়া, থাকছে এটিএম বুথ, পোস্ট অফিস, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন বুথ ছাড়াও বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় সেবাকেন্দ্র।
পাঠকের মতামত: