ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

তামাকের মরণ থাবা (১)

পরোক্ষ ধূমপানে ক্ষতি ৪০০০ কোটি টাকা

শামীমুল হক :: ভয়ঙ্কর তথ্য। পরোক্ষ ধূমপানে দেশে ক্ষতি হচ্ছে চার হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষতির মধ্যে রয়েছে চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো। আর তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করে। এ তথ্য সামনে আসার পর প্রশ্ন আসে- তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন কতটুকু সুরক্ষা দিচ্ছে মানুষকে? অধূমপায়ীদের রক্ষায় আইনটি কতটুকু ভূমিকা রাখছে? তামাক মৃত্যু ঘটায়। এটি করোনাভাইরাস সংক্রমণ সহায়কও। পরোক্ষ ধূমপায়ীর ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে তামাক এটি প্রমাণিত। দেশে বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের আওতায় সকল পাবলিক প্লেস এবং পরিবহনে ধূমপানমুক্ত রাখা হয়েছে।

কিন্তু কতটুকু তা পালন হচ্ছে? তা তদারক করার কোনো আলামতও নেই। আর এ কারণেই পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতি থেকে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এর ধারা ৮ ও এ সংক্রান্ত গাইডলাইন অনুযায়ী, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষায় ‘পূর্ণাঙ্গ ধূমপানমুক্ত নীতিমালা’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এফসিটিসি’র সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। আর এজন্য তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধন প্রয়োজন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী পরোক্ষ ধূমপানের কারণে পৃথিবীতে বছরে ১২ লাখ মানুষ অকালে মৃত্যুবরণ করেন। তামাকপণ্যের ধোঁয়ায় আক্রান্ত হওয়ার নিরাপদ কোনো মাত্রা নেই। তামাকের ধোঁয়ায় রয়েছে ৭,০০০টি রাসায়নিক পদার্থ। যার মধ্যে ৭০টি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী। ফুসফুস ক্যান্সার, স্ট্রোক ও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ পরোক্ষ ধূমপান। বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে পাবলিক প্লেসে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ রাখার সুযোগ থাকায় পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষায় আইনটি কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না।

গ্লোব্যাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে কর্মস্থলে কাজ করেন এমন প্রাপ্ত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর ৪২.৭ শতাংশ লোক পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। ১৪.৭ শতাংশ রেস্তরাঁয় এবং ৩৬.২ শতাংশ চা-কফির স্টলে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হলো প্রায় ৩৯ শতাংশ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ যার সংখ্যা ৪ কোটি ৮ লাখ লোক বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। প্রতিবছর প্রায় ৬১,০০০ শিশু পরোক্ষ ধূমপানজনিত বিভিন্ন অসুখে ভোগে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, পরোক্ষ ধূমপানের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ মোট তামাক ব্যবহারজনিত অর্থনৈতিক ক্ষতির প্রায় ১০ শতাংশ। বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ‘ইকোনমিক কস্ট অব টোব্যাকো ইউজ ইন বাংলাদেশ: এ হেলথ কস্ট অ্যাপ্রোচ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পরোক্ষ ধূমপানের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির (চিকিৎসা ব্যয় এবং উৎপাদনশীলতা হারানো) পরিমাণ প্রায় ৪ হাজার ১শ’ কোটি টাকা।
ওদিকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ অনুযায়ী চতুর্দিকে দেয়াল দিয়ে আবদ্ধ রেস্টুরেন্টসহ অধিকাংশ আচ্ছাদিত পাবলিক প্লেস এবং কর্মক্ষেত্রে ধূমপান নিষিদ্ধ রয়েছে। তবে মাত্র কয়েকটি স্থান যেমন- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, গ্রন্থাগার, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র ও থিয়েটার হলের অভ্যন্তরে, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ এক কক্ষবিশিষ্ট রেস্টুরেন্ট, শিশুপার্ক, খেলাধুলা ও অনুশীলনের জন্য নির্ধারিত আচ্ছাদিত স্থান এবং এক কামরাবিশিষ্ট পাবলিক পরিবহন ছাড়া বেশির ভাগ পাবলিক প্লেস এবং একাধিক কামরাবিশিষ্ট পাবলিক পরিবহনে (ট্রেন, স্টিমার ইত্যাদি) ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বা ‘ডেজিগনেটেড স্মোকিং জোন’ রাখার সুযোগ রয়েছে।

ফলে অধূমপায়ীদের পাশাপাশি এসব স্থানে সেবা প্রদান করতে গিয়ে সেবাকর্মীরাও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন। কাজেই বিদ্যমান আইনটি কোনোভাবেই পরোক্ষ ধূমপান থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৮ এর গাইডলাইন এবং অসংখ্য গবেষণায় এটা স্বীকৃত যে, আচ্ছাদিত ধূমপান এলাকার আশপাশের স্থানসমূহ কখনই ধোঁয়ামুক্ত হয় না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়া কোনো ব্যক্তির মারাত্মক করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি একজন ধূমপায়ীর মতোই। পরোক্ষ ধূমপান ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এবং ক্ষতিগ্রস্ত ও দুর্বল ফুসফুসে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। এ ছাড়াও তামাকের কারণে বিভিন্ন জটিল অসংক্রামক রোগ যেমন, হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে যা কোভিড-১৯ সংক্রমণেও ঝুঁকিপূর্ণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই সতর্কতা আমলে নিলে দেশে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী মারাত্মকভাবে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।

অধূমপায়ীদের রক্ষায় বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বা ‘ডেজিগনেটেড স্মোকিং জোন’ বিলুপ্ত করা এখন সময়ের দাবি। চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ নয় এমন রেস্তরাঁসহ সব ধরনের হোটেল, পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র এবং একাধিক কামরাবিশিষ্ট যান্ত্রিক পরিবহন ও সকল অ-যান্ত্রিক গণপরিবহনে ধূমপান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। পাশাপাশি ধূমপানমুক্ত ভবন বলতে সেই ভবনের বারান্দাসহ সকল আচ্ছাদিত স্থানকে আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

শতভাগ ধূমপানমুক্ত আইন জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন সহায়ক। গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্র, রেস্তরাঁসহ সব ধরনের পাবলিক প্লেসকে শতভাগ ধূমপানমুক্ত করা গেলে কর্মীদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৮৫ শতাংশ হ্রাস পায়, শ্বাসতন্ত্র ভালো থাকে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকিও কমে যায়। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপানমুক্ত পরিবেশে ধূমপায়ী কর্মীর সিগারেট সেবনের মাত্রা দিনে গড়ে ২ থেকে ৪টা পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে। জনসাধারণকে রক্ষার্থে প্যারাগুয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে সকল আচ্ছাদিত পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান শতভাগ নিষিদ্ধ করেছে। বর্তমানে থাইল্যান্ড, নেপাল, পাকিস্তান, তুরস্ক, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ৬৭টি দেশ পূর্ণাঙ্গ ধূমপানমুক্ত আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছে।

পাঠকের মতামত: