নিউজ ডেস্ক :: তৃণমূলের কমিটিতে ত্যাগী ও পরীক্ষিত কর্মীদের জায়গা দিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলার প্রভাবশালী নেতাদের নিজস্ব বলয় ভাঙতে চায় আওয়ামী লীগ। বিগত সময়ের মতো এবার যাতে ‘পকেট কমিটি’ গঠন না হয় তার জন্য সতর্ক ক্ষমতাসীন দলটি। এবার দলটির নীতিগত অবস্থান হলো, কমিটিতে বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে পরীক্ষিতদের স্থান দিতে হবে। যার কারণে জমা পড়া জেলা কমিটিগুলো অতীতের মতো ঢালাওভাবে অনুমোদন না দিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তৃণমূলের কমিটির মতো দলের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য মনোনয়নের ক্ষেত্রেও একই পন্থা অবলম্বন করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বাংলা ট্রিবিউনকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
জানা গেছে, গত ১৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সভায় জেলা কমিটি অনুমোদন এবং কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য মনোনয়ন নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সভায় দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিলেন, বিতর্কিতদের দলে স্থান দেওয়া যাবে না। দুঃসময়ের পরীক্ষিত ও ত্যাগীদের দলের নেতৃত্বে আনতে হবে। এ সময় তিনি জমা পড়া কমিটিগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কথাও বলেন।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, অতীতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলার প্রভাবশালী নেতারা তাদের ‘মাইমেন’ বা অনুগতদের জেলা ও উপজেলাসহ তৃণমূলের কমিটিতে স্থান দিয়েছে। এই সুযোগে বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীরা আওয়ামী লীগের অবস্থান পোক্ত করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই স্ত্রী-সন্তান ভাই-বোনসহ আত্মীয়-স্বজনদের তৃণমূলের আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাতে দেখা গেছে। এতে ক্ষোভে-দুঃখে-হতাশায় তৃণমূলের পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতারা সংগঠন বিমুখ হয়ে পড়েন। যার কারণে আওয়ামী লীগের ‘মাইটোকন্ড্রিয়া’ খ্যাত তৃণমূল সংগঠন ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। অপরদিকে বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে দল ও সরকারকে বারবার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগ তার একটি অন্যতম উদাহরণ বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।
অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে তৃণমূলের নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ এবার সতর্কতা অবলম্বন করছে। যাচাই-বাছাই করছে কেন্দ্রের কাছে জমা পড়া তৃণমূলের কমিটিগুলো। পর্যালোচনা করছে কেন্দ্রীয় উপকমিটির সদস্য এবং সহযোগী সংগঠনের নতুন কমিটির তালিকাও।
জানা গেছে, দলের নিজস্ব ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় এসব কমিটি যাচাই-বাছাই করা হবে। প্রতিটি বিভাগের জন্য বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, প্রতি দুটি বিভাগের জন্য একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং প্রতিটি বিভাগের জন্য সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করবেন। এছাড়া দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে যাদের বাড়ি যে এলাকায় তারা ওই এলাকার যাচাই-বাছাইয়ে সহযোগিতা করবেন।
আওয়ামী লীগ গত বছর ২০ ও ২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে ২৬ অক্টোবর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩১ জেলায় সম্মেলন শেষ করে। একই সময় শেষ হয় ছয়টি সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সম্মেলনও।
জেলা সম্মেলনগুলোতে বক্তব্যকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের পকেট কমিটি গঠন না করতে তৃণমূল নেতাদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ঘরের মধ্যে ঘর করে, মশারির মধ্যে মশারি, আত্মীয়করণ করে চৌদ্দপুরুষকে নিয়ে আওয়ামী লীগের পকেট কমিটি করে। পকেট কমিটি চলবে না। পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চাই, কমিটি করতে গিয়ে দল ভারি করার জন্য খারাপ লোক টেনে আনবেন, এটা চলবে না। বসন্তের কোকিল আমরা চাই না, দুঃসময়ের ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে।’
যেসব জেলা সম্মেলন সম্পন্ন হয়েছে কেন্দ্রের নির্দেশে তার প্রায় সব পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা জমা পড়েছে। ইতোমধ্যে বেঁধে দেওয়া সময় ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বৃষ্টির মতো তালিকা জমা পড়ে বলে আওয়ামী লীগের দফতর সূত্রে জানা যায়। ওই তালিকা নিয়ে ১৬ সেপ্টেম্বর এর সভাপতিমণ্ডলীর সভায় পর্যালোচনা করা হয়। একই সঙ্গে ওই সভায় বাকি কমিটির তালিকা জমা দেওয়ার জন্য এক সপ্তাহ সময় বেঁধে দেওয়া হয়। গত কয়েক দিনে আরও কয়েকটি কমিটি জমা পড়েছে বলে জানা গেছে।
শনিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) একটি অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কমিটি গঠন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘যেসব কমিটি জমা হয়েছে তা আমরা হঠাৎ করে দিয়ে দেবো না। যাচাই-বাছাই করে পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা আছেন কিনা সেটা দেখা হবে।’
জমা পড়া কমিটি প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘অনেক জায়গায় দেখা গেছে স্বজনপ্রীতি করা হয়েছে। নিজস্ব লোকজন দিয়ে কমিটি ভর্তি করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে দীর্ঘদিনের ত্যাগী কর্মীরা, পরীক্ষিত কর্মীরা কমিটি থেকে বাদ পড়েছেন। এটা কোনও অবস্থাতেই হতে পারে না। সেটা আরও খোঁজখবর নিয়ে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।’
পরবর্তীতে ওয়ার্ড থেকে শুরু করে জেলা-মহানগর পর্যায়ে যেসব কমিটি হবে সেখানেও অবিতর্কিত, ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে বলে শনিবার তিনি আশ্বাস দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যোগ্য ও ত্যাগীরা যাতে কমিটিতে স্থান পায় এবং বিতর্কিতরা যাতে আসতে না পারে তার জন্য আমরা যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অতিথি কমিটি নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কোনও কোনও কমিটিকে আপনারা সাংবাদিকরা পকেট কমিটি বলেছেন। আমি সেভাবে বলতে চাই না। তবে একক কোনও ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে কমিটি চলে যাবে, এমনটা যে না হয় আমরা সেটা চাইবো।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, ‘যাচাই বাছাইয়ের মাধ্যমে জেলা কমিটি অনুমোদনের সিদ্ধান্ত হয়েছে সভাপতিমণ্ডলীর সভায়। দলের মধ্যে যারা নিবেদিত তারা যাতে কমিটিতে আসতে পারে তার জন্য এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
যাচাই-বাছাই করে বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে যোগ্যদের অন্তর্ভুক্তি কঠিন কাজ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষে তৃণমূলে যাচাই-বাছাই করা সত্যিই কষ্টসাধ্য। এক্ষেত্রে আমাদের জেলা নেতাদের তালিকার ওপর ভর করতে হয়। তবে জেলা থেকে যে কেউ যদি অভিযোগ অনুযোগ করেন, আমরা সেটা যাচাই করে দেখতে পারবো।’
পাঠকের মতামত: