ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় অন্যায়ভাবে নেওয়া ১ হাজার ২৩২ কোটি টাকা আজও ফেরত পাননি ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। এই টাকা ফেরত দিতে গত সাত বছরে সরকার কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অনেক ব্যবসায়ী ওই সময়ে টাকা দিয়ে সংকটে পড়েছেন। অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডাররা মুনাফা বঞ্চিত হয়েছেন। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অনেক প্রতিষ্ঠানে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এমনকি ব্যবসায়ীদের ওই টাকা ফেরত দিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা আজও উপেক্ষিত।
ব্যবসায়ীদের সূত্র বলছে, ওয়ান-ইলেভেনের সরকার ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের চোখ কালো কাপড়ে বেঁধে হুমকি-ধমকি দিয়ে নেয় ১ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তত্কালীন সরকারের ওই আচরণের ভাষাকে মূল্যায়ন করে কেউ কেউ বলেন, ‘সন্ত্রাসীমূলক আচরণ’। তারা তাদের জীবন বাঁচাতে ওই সময়ে বন্দুকের নলের মুখে টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ১/১১ সময়ে ব্যবসায়ীদের ওপর অহেতুক বিশাল চাপ দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীদের ওপর সেই চাপে দেশ ২০ বছর পিছিয়ে গেছে। ১/১১ সরকারের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুচিন্তিত সিদ্ধান্তে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ১/১১ ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব গ্রহণের পর আমাদের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ দিয়েছেন। এরপরও যখন রাজনৈতিকভাবে দেশ অশান্ত করার চেষ্টা হয়েছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিপূরণ দিয়ে ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যমতে, সেই ১২৩২ কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে ওই টাকা ফেরত চেয়ে আবারও আবেদন-নিবেদন করে আসছেন সে সময়ের নির্যাতিত ব্যবসায়ীরা। এরপর দীর্ঘ সাত বছরেও ওই টাকা ফেরত না পেয়ে হতাশ তারা। গত মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর ওই টাকা ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। তখন প্রধানমন্ত্রীর সে প্রতিশ্রুতিতে আপত্তি তোলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ফলে গত সাত বছরেও সে টাকা ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সরকার। এই টাকা ফেরত দিতে উচ্চ আদালত নির্দেশনা দিলেও তাতে সায় দেয়নি অর্থ মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, ২০০৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০০৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত একটি গোয়েন্দা সংস্থা এবং তত্কালীন টাস্কফোর্স ইন্টেলিজেন্টস (টিএফআই) কর্মকর্তারা প্রায় ৪০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১২৩২ কোটি টাকা আদায় করে। এই টাকা দুই শতাধিক পে-অর্ডারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ০৯০০ নম্বর হিসাবে জমা হয়। শুধু টাকা আদায়ই নয়, অনেক ব্যবসায়ী তখন জেলও খাটেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গত মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন সময় মন্ত্রী-এমপিদের অনেকেই এভাবে অর্থ আদায়ের ওই ঘটনাকে অনৈতিক এবং বেআইনি বলে মন্তব্য করেছিলেন। বর্তমানে ওই টাকা কী অবস্থায় আছে, জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, টাকাগুলো কীভাবে আছে, তা সরকার জানে। তবে চলতি হিসাবে টাকাগুলো জমা হওয়াতে এ টাকার কোনো সুদ হয়নি। টাকাগুলো সরকার ফেরত দেওয়ার চিন্তা করতে পারে বলে মত দেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা। এ সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের কনসোলিটেড ফান্ডে জমা হওয়া ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের ১২৩২ কোটি টাকা সরকার গত মেয়াদে জরুরি প্রয়োজনে খরচ করে ফেলেছে। এখন সে টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়। এ কারণেই অর্থমন্ত্রী টাকা ফেরত দিতে আপত্তি তুলেছেন। তবে সরকারকে ব্যবসায়ীদের টাকা ফেরত দিতে হলে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ দিতে হবে বলেও মনে করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখেন এফবিসিসিআইর এমন একজন সাবেক সভাপতি ও শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ওই টাকা ফেরত দেওয়া উচিত। কেননা, এই টাকা জোর করে নেওয়া হয়েছে। এ জন্য তিনি ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইকে আবারও উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। বিতর্কিত ১/১১’র অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর প্রথম সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ব্যবসায়ী নেতা আবুল কাসেম আহমেদ। তিনি সারা দেশের সব ব্যবসায়ী চেম্বারের পক্ষ থেকে তত্কালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কাছ থেকে ১/১১’র সরকারের টাকা নেওয়া প্রসঙ্গে আবুল কাসেম আহমেদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ১/১১’র সরকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যে টাকা নিয়েছে, তা আমি জানি না। তবে তিন বাহিনী প্রধানকে সংবর্ধনা দিয়েছিলাম মূলত তখন চার মাসের মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র কাজ সমাপ্ত করার জন্য। এফবিসিসিআইর তত্কালীন সহ-সভাপতি আবু আলম চৌধুরী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তখন ব্যবসায়ীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। কেউ সাহস করে প্রতিবাদ করতে পারেননি। তখন ব্যবসায়ীরা থমকে গিয়েছিলেন। সালমান এফ রহমান ও আ হ ম মুস্তফা কামাল গ্রেফতার হয়েছিলেন। এ কে আজাদকে গ্রেফতারে তত্কালীন সরকার সরব হয়ে ওঠে। তখন আমাদের সভাপতি আনিসুল হক ব্যবসায়ীদের রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এতে অনেক ব্যবসায়ী নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পান। সে সময়ে নির্যাতিত এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু মনে করেন, ১/১১ সরকার অবৈধভাবে টাকা নিয়েছে। আর এই সরকার সেই টাকা ফেরত না দিয়ে অবৈধ কাজ করছে। তিনি এই টাকা সুদে-আসলে ফেরত দিতে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ চান। সূত্র জানায়, ১/১১ সরকার ব্যবসায়ীদের জরিমানার নামে শুধু হয়রানিই করেনি, শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনও করা হয়। সেই নির্যাতনের বিচার ও জোর করে নেওয়া অর্থ ফেরত চান ভুক্তভোগীরা। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের নির্যাতনের শিকার হওয়া দেশের অন্যতম জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের দাবি, মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনের সরকার অন্যায়ভাবে তার কাছ থেকে ৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ওই ব্যবসায়ীর ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তি এই প্রতিবেদককে বলেছেন, তিনি বন্দুকের নলের মুখ থেকে জীবন বাঁচাতে ওই সময়ে টাকা দিতে বাধ্য হয়েছেন। ওই সময় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সন্ত্রাসীমূলক আচরণ করা হয়েছে। কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে হুমকি দিয়ে টাকা নেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক টাকাগুলো প্রকৃত মালিকদের ফেরত দেওয়া। কিন্তু সরকার সেটা না করে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছে।
ওয়ান-ইলেভেনে নির্যাতনের শিকার আরেক ব্যবসায়ী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ওয়ান-ইলেভেনের তত্কালীন সরকার আমাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে চাপ প্রয়োগ এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা নিয়েছে। এর মধ্যে আমার ব্যক্তিগত ১৬ কোটি টাকা এবং ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের ৯ কোটিসহ মোট ২৫ কোটি টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছে। এই পুরো অর্থ সাদা (কালো টাকা নয়) দাবি করে তিনি ২৫ কোটি টাকা ফেরত চেয়েছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিন :
পাঠকের মতামত: