ঢাকা,সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

১/১১ সেই খলনায়করা কে কোথায়

1অনলাইন ডেস্ক ::

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ওয়ান-ইলেভেনের খলনায়করা বহাল-তবিয়তেই আছেন। দুই নেত্রীসহ শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতারে সরাসরি সম্পৃক্ত এ কুশীলবদের এ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো আইনি প্রক্রিয়া মোকাবিলা করতে হয়নি। তাদের আইনের আওতায় আনার কথা বিভিন্ন সময়ে উঠলেও তা আর হয়ে ওঠেনি। এখন তারা নির্বিঘ্নে নিজেদের মতো করে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছেন। বেশির ভাগই আছেন বিদেশে। এর মধ্যে প্রধান কুশীলব ফখরুদ্দীন আহমদ ও মইন উ আহমেদ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে সেখানেই আছেন। সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল চৌধুরী ফজলুল বারী  (অব.)ও থাকছেন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে। মৃত্যুবরণ করেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। তবে রাজনীতিকদের গ্রেফতার-নির্যাতনে মুখ্য ভূমিকায় থাকা সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী (অব.) টানা ছয় বছর অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন শেষে এখন অবসরযাপন করছেন ঢাকায়। ব্যবসা করছেন পাঁচ তারকা মানের রেস্টুরেন্টের। জানা যায়, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ দেশ ছেড়ে যান যুক্তরাষ্ট্রে। অবশ্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ছিলেন আগেও। এ দফায় দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র গিয়ে বাড়ি কেনেন মেরিল্যান্ড স্টেটের পটোম্যাকে। সেখানে তার দুটি বাড়ির একটিতে থাকেন সস্ত্রীক ও অন্যটিতে থাকে তার কন্যার পরিবার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ায় ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ বিষয়ে ভিজিটিং স্কলার হিসেবে গবেষণা ও শিক্ষকতা করেছেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী পদমর্যাদার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের শিক্ষার্থীদের ‘উন্নয়নশীল দেশের গণতন্ত্রের বিকাশ’ সম্পর্কে শিক্ষা দেন। সেই সঙ্গে সামাজিক ব্যবসা ও ক্ষুদ্র ঋণ বিষয়েও  শিক্ষার্থীদের পড়ান প্রায় ২০ বছর বিশ্বব্যাংক ও ৫ বছর পিকেএসএফে দায়িত্ব পালন করা ফখরুদ্দীন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি বেশ কয়েকজন বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছেন এবং এখনো করছেন। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ সেনাপ্রধান হিসেবে অবসর নেন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের মাঝামাঝি। সে বছরেরই ১৪ জুন তিনি চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। প্রথমে ফ্লোরিডায় ছোট ভাই ও ছেলের কাছে থাকতেন। পরে তার ক্যান্সার ধরা পড়লে চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্কের কুইন্সে থাকা শুরু করেন। এর মধ্যেই তার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব হয় বা গ্রিন কার্ড পান। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বিশেষ সুবিধায় নিউইয়র্কের হাসপাতালে ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা নেন। পরে তার স্পাইনাল কর্ডে পাঁচটি স্থানে ক্ষত হওয়ায় বোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশনও করা হয়। কেমোথেরাপি এখনো চলছে। দীর্ঘ ৫ বছর লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও গত বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন অব ফ্লোরিডার আয়োজনে উত্তর আমেরিকা রবীন্দ্র সম্মিলনের মঞ্চে সরব উপস্থিতি ছিল জেনারেল মইনের। সম্মেলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি হাসিমুখে কুশল বিনিময় করেন অতিথিদের সঙ্গে। এর মধ্যে ‘শান্তি পথে’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন ওয়ান-ইলেভেনসংশ্লিষ্ট কিছু কথা। ওয়ান-ইলেভেনের সময় রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে নানান কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত হওয়া অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ চার বছর আগে মারা যান। ২০১২ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি ৮১ বছর বয়সে  থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। শেষ সময়ে তিনি বয়সের ভারে মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেছিলেন। দিন কাটিয়েছেন গুলশানের বাসভবনে। কোনো রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানেই যোগ দেননি। সাবেক এই রাষ্ট্রপতির স্ত্রীর প্রতিষ্ঠিত অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানাসংক্রান্ত জটিলতায় তার ছেলেকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে তার জীবদ্দশায়। ওয়ান-ইলেভেনের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশের দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করার অভিযানের জন্য গঠন করা ‘গুরুতর অপরাধ দমনসংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’র প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুুরী (অব.)। সে সময় সাভারের নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি থাকা মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হন। পরে ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের হাইকমিশনারের দায়িত্ব নিয়ে চলে যান অস্ট্রেলিয়া। স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বর্তমান সরকার চার দফায় তার মেয়াদ বাড়ানোয় মোট ছয় বছর অস্ট্রেলিয়ায় দায়িত্ব পালন করেন। পরে ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ ঢাকায় ফিরে আসেন। এখন তেজগাঁওয়ে একটি ফাইভ স্টার মানের রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করছেন জেনারেল মাসুদ। দুই মেয়ে বিদেশে থাকায় সস্ত্রীক রেস্টুরেন্ট ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত তিনি। ওয়ান-ইলেভেনের আরেক আলোচিত ও সমালোচিত সামরিক কর্মকর্তা (চাকরিচ্যুত) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল চৌধুরী ফজলুল বারী এখন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে অবস্থান করছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ সময়ে ব্রিগেডিয়ার বারী ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে সামরিক অ্যাটাশের চাকরি নিয়ে দেশ ত্যাগ করেছিলেন। পরে আওয়ামী লীগ সরকার তাকে দেশে ফেরার নির্দেশ দিলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। তখন পরিবার-পরিজন নিয়ে এক প্রকার বিপদেই পড়েন। যদিও এখন তার স্ত্রীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের বৈধ অভিবাসী স্ট্যাটাস আছে। তবে প্রথমে এক বাংলাদেশির মালিকানাধীন ডমিনাস পিজা স্টোরের ডেলিভারিম্যানের কাজ করতেন। এখন একটি ওষুধ কোম্পানির ডেলিভ্যারিম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। ওয়ান-ইলেভেন সময়ে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদফতরের (ডিজিএফআই) পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মেজর জেনারেল এ টি এম আমিন (অব.) ২০০৯ সালের ১৭ মে সব আর্থিক সুবিধাসহ সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। পরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিচয়ে দেশত্যাগ করেন। সর্বশেষ দুবাইয়ে অবস্থান করে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় চাকরি করছেন বলে জানা যায়। সেখানেই আছেন ডিজিএফআইর সে সময়ের অপার ক্ষমতাধর মেজর জেনারেল সাঈদ জোয়ার্দারও (অব.)। ওয়ান-ইলেভেনের আগে আগে উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করা লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধূরী (অব.) পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর জাতীয় সংসদে চরম সমালোচিত হয়ে ২০০৯ সালের ২ এপ্রিল পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বর্তমানে তিনি ঢাকায় ডিওএইচএসের বাসাতেই থাকছেন। নিয়মিত হাঁটাহাঁটি, ব্যায়াম করেন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। বিভিন্ন সংসদীয় কমিটি তাকে দুদকের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির কৈফিয়ত দিতে ডাকলেও তিনি সেখানে উপস্থিত হননি। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরজুড়ে মেজর জেনারেল এম এ মতিন (অব.) উপদেষ্টা ছিলেন। গুরুতর অপরাধ দমনসংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির প্রধান হিসেবে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে তিনি অভিযান পরিচালনা করেন। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামে নিজ বাড়িতে বসবাস করে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল পরিচালনা করছেন। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে অত্যধিক সক্রিয় ভূমিকায় থাকা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন পৈতৃক সম্পত্তি ভাগাভাগি করে দৈনিক ইত্তেফাক ছেড়ে দিয়ে নিজের আইন পেশায় মনোযোগী হয়েছিলেন। অবশ্য উচ্চ আদালতে তাকে খুব একটা দেখা যায় না। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন টকশোয় তার উপস্থিতি দেখা যায়। উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান মহাজোটের তিন বছরে নীরবে নিজের এনজিও পিপিআরসির চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেছেন। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা ও খণ্ডকালীন শিক্ষকতা নিয়েও তিনি ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে যতটা সরব ছিলেন এখন ততটাই নীরবে আইন পেশায় নিয়োজিত।

বিদেশি কূটনীতিক : ওয়ান-ইলেভেনের আগে-পরে ঢাকায় দায়িত্ব পালন করা বেশ কয়েকজন কূটনীতিকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নাক গলানোর অভিযোগ ওঠে। সে সময়ের মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটেনিস ২০০৭ সালের জুনে ঢাকার দায়িত্ব শেষ করে ফিরে যান। পরে তিনি শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানব পাচর দফতরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্বে আছেন। বিউটেনিসের পরপরই ঢাকায় আসা জেমস এফ মরিয়ার্টিও অবসরে গেছেন। সে সময় ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আনোয়ার চৌধুরী বর্তমানে পেরুতে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন। মাঝে তিনি ব্রিটিশ সরকারের ফরেন ও কমনওয়েলথ অফিসের ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন্সের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আনোয়ার চৌধুরীর পরে দায়িত্ব পালন করা স্টিভেন ইভান্সও দায়িত্ব পালন শেষে লন্ডনে পররাষ্ট্র দফতরে কাজ করছেন। সে সময় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী হিসেবে আলোচিত ভূমিকা রাখা রেনাটা ডিজালিয়েন বর্তমানে মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির দায়িত্বে রয়েছেন। বাংলাদেশ প্রতিদিন

পাঠকের মতামত: