নিউজ ডেস্ক :: পর্যটকদের ভিড়, জেলেদের আগ্রাসী শিকার আর দূষণ তাদের ঠেলে দিয়েছিল দূরে, করোনাভাইরাস মহামারী আবার তাদের কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিনের সৈকতে অবাধ বিচরণের সুযোগ করে দিয়েছে; তার তাতে সঙ্কটে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপের বংশ বিস্তার বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। মূলত তিন প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ অলিভ রিডলে, গ্রিন টার্টল আর হকসবিল বাংলাদেশের উপকূলে ডিম ছাড়তে আসে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ বা আইইউসিএনের লাল তালিকায় অলিভ রিডলেকে ‘সংকটাপন্ন’, গ্রিন টার্টলকে ‘বিপন্ন’ এবং হকসবিল টার্টলকে ‘মহাবিপন্ন’ প্রজাতির কাতারে রাখা হয়েছে।
অলিভ রিডলে ও হকসবিল কচ্ছপ সাধারণত নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত এবং গ্রিন টার্টল জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিম ছাড়ে। এই সময়ে রাতের আঁধারে মা কাছিম সৈকতের বালিয়াড়িতে তৈরি বাসায় (নেস্টিং গ্রাউন্ড) এসে ডিম দিয়ে আবার সাগরে ফিরে যায়।
নেচার কনজারভেশন সোসাইটির (ন্যাকম) সমন্বয়ক আবদুল মান্নান সামুদ্রিক কচ্ছপ নিয়ে গবেষণা করেন ২০০৭ সাল থেকে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে পর্যটন বন্ধ মার্চ থেকে। তাতে বাংলাদেশের উপকূলে অলিভ রিডলে ও হকসবিলের আগমন ও ডিম ছাড়ার হার যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে তাদের স্থায়িত্ব। “অনেক বছর ধরে কাছিম নিয়ে কাজ করলেও এবার প্রথম দেখলাম জুন মাস পর্যন্ত ওরা আমাদের উপকূলে ডিম দিতে আসছে। সাধারণত প্রজনন মৌসুম মার্চ, বড়জোড় এপ্রিলেই শেষ হয়ে যায়।” সৈকতে কচ্ছপের ডিম ছাড়ার প্রবণতা কতটা বেড়েছে তার ধারণা পাওয়া যায় পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব থেকে। কচ্ছপের বংশ বিস্তারের জন্য কক্সবাজারে পাঁচটি সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে সরকার, যেখানে কৃত্রিমভাবে ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো হয়। ডিম ছাড়ার জন্য সৈকতের বালিয়াড়িতে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে বাসা (নেস্টিং গ্রাউন্ড)।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, এই পাঁচটি কেন্দ্রে মোট ১১৫টি নেস্টিং গ্রাউন্ড থেকে এবারের প্রজনন মৌসুমে ১৩ হাজার ১৮৯টি ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে, সেগুলো থেকে ফোটানো হয়েছে মোট সাড়ে ১১ হাজার ছানা।
কক্সবাজারে অধিদপ্তরের উপ পরিচালক শেখ মো নাজমুল হুদা চকরিয়া নিউজকে বলেন, “গতবার আনুমানিক আট হাজার ডিম পাওয়া গিয়েছিল। সেগুলো থেকে সাড়ে ৫ হাজার বাচ্চা পাওয়া গিয়েছিল। সে তুলনায় এবার সংখ্যা অনেকটাই বেশি।” কচ্ছপের ফেরার পরিবেশ তৈরিতে করোনাভাইরাসের লকডাউন বড় ভূমিকা রেখেছে জানিয়ে তিনি বলেন, নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যত ডিম পাওয়া গেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি ডিম পাওয়া গেছে মার্চ ও এপ্রিলে।
অধিদপ্তরের হিসাবে, এর আগে ২০১৮ সালে আড়াই হাজার ডিম থেকে ১৮০০ এবং ২০১৭ সালে ২ হাজার ডিম থেকে ১৭০০ বাচ্চা পাওয়া গিয়েছিল। সামুদ্রিক প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কচ্ছপকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জলজ প্রাণি বিবেচনা করা হয়। কচ্ছপ ক্ষতিকর জেলি ফিশ খেয়ে ফেলে, যা মাছের বংশ বিস্তারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। ২০১৫ সালের জীববৈচিত্র্য বিষয়ক পঞ্চম জাতীয় প্রতিবেদনে বলা হয়, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও পর্যটকের আনাগোণা বেড়ে যাওয়ায় সৈকতে কচ্ছপের নেস্টিং গ্রাউন্ড ধ্বংস হয়। পাশাপাশি সাগরে চিংড়ি ধরার বাণিজ্যিক জালে আটকা পড়ে মৃত্যু ঘটে কচ্ছপের। ফলে কচ্ছপের ডিম পাওয়ার সংখ্যা কমে আসছিল দ্রুত।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মীরা ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে ১২টি মৃত কচ্ছপ পেয়েছেন সৈকতে, ২০১৯ সালে পাওয়া গিয়েছিল ৪৮টি। বাংলাদেশ মেরিন লাইফ অ্যালায়েন্সের সাবেক প্রোগ্রাম অফিসার মোহাম্মদ রাসেল বলেন, সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন মৌসুমে সেন্ট মার্টিন সৈকতের ১০ কিলোমিটারের মধ্যে বড় জাল দিয়ে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে তা মানা হয় না।
“গ্রিন টার্টল সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টা সমুদ্রের নিচে থাকতে পারে, অলিভ রিডলেও এরকমই প্রায়। তারপর শ্বাস নেওয়ার জন্য তাদের উপরে উঠতে হয়। ডিম দেওয়ার সময় হলে কাছিম উপকূলের কাছাকাছি থাকে। কিন্তু মাছ ধরার জালে আটকে গেলে দীর্ঘসময় পানির নিচে থেকে মারা যায়। “
এছাড়া সৈকতের ভাসমান কুকুরও কাছিমের ডিম খেয়ে ফেলে প্রজনন বাধাগ্রস্ত করে বলে জানান তিনি। সামুদ্রিক কচ্ছপ সংরক্ষণের লক্ষ্যে ২০১৬ সালে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে ‘প্রতিবেশগত ব্যবস্থাপনা সেন্টমার্টিন দ্বীপেরজীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ’ নামে একটি প্রকল্প নেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। এ প্রকল্পের হিসাবে, সদ্য বিগত ২০১৯-২০ প্রজনন মৌসুমে ১০ হাজার ডিম থেকে ৭ হাজার কাছিমের বাচ্চা জন্ম নিয়েছে। যেখানে আগের মৌসুমে ৪ হাজার ডিম থেকে ২ হাজার ২৮টি বাচ্চার জন্ম হয়।
এই প্রকল্পের সংরক্ষক আবদুল আজিজ বলেন, সৈকতের একেবারে কাছাকাছি তৈরি হওয়া হোটেল-মোটেলের আলো ও পর্যটকদের হৈ চৈ করার কারণে রাতে সৈকতে কচ্ছপের আসা কমে গিয়েছিল। এমনও হয়েছে যে মা কচ্ছপ সৈকতে এসেও ডিম না ছেড়েই ফিরে গেছে।
“তবেআশার কথা হচ্ছে, সেন্টমার্টিন দ্বীপের চারটি হট স্পটের মধ্যে যে দুটি স্পটে মানুষের কারণে কচ্ছপের আগমন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেগুলোতে এবার তারা ফিরে এসেছে, ডিম ছেড়েছে। ” সেন্টমার্টিনের প্রবীণ কচ্ছপ সংরক্ষণ কর্মী নুরুল হক বলেন, “এবার পর্যটক আসা বন্ধ হওয়ায় সেন্টমার্টিনের সৈকতগুলো ছিল একেবারে নিরিবিলি। তাই ভালো সংখ্যক ডিম আমরা এবার পেয়েছি। ”
পাঠকের মতামত: