ঢাকা,বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪

সু চির ব্যর্থ প্রেমের প্রতিশোধ

সাইফুর রহমান

সাইফুর রহমান ::bd-pratidin

সময়টা ১৯৬৪ সাল, ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। শীতঋতু শুরুর কিছুটা পূর্বাহ্নে শুকিয়ে আসা বিবর্ণ হরিৎ ও হরিদ্রা রঙের পাইন, ম্যাপল, ওক ও অন্যান্য বৃক্ষের পাতাগুলো খসে খসে সব স্তূপ হতে থাকে রাস্তায়।

আর এই রাস্তা ধরে সেইন্ট হিউ কলেজের ছাত্রাবাস থেকে মাউল্টন কোম্পানির একটি সাইকেলে চেপে প্রায় প্রতিদিন যাতায়াত করে সেইন্ট হিউ কলেজে সদ্য ভর্তি হওয়া সু চি নামের মেয়েটি। সু চি ভর্তি হয়েছে দর্শন বিষয়টিতে, আদতে তার ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে ছিল ইংরেজি ও ফরেস্টি বিষয়গুলোতে। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত আকীর্ণ স্কার্ট, ঊর্ধ্বাঙ্গে একটি জামা ও খোঁপায় একগোছা ফুল গুঁজে মেয়েটি যখন তার লাবণ্য ও দ্যুতি ছড়িয়ে সাইকেলের প্যাডেলটি হালকা চেপে ধীরগতিতে রাস্তা ধরে চলতে থাকে তখন প্রায় প্রতিটি ছেলের মনেই মৃদু দোলা দিয়ে যায়, শুরু হয় ধুকপুকানি। অনেক ছাত্রের হৃদয়েই জাগে সু চি নাম্মি এই মেয়েটিকে প্রেমিকা রূপে পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে সু চি পড়াশোনা করেছেন দিল্লির বিখ্যাত লেডি শ্রীরাম কলেজে, রাজনীতি বিষয়ে। ওখানে অবশ্য তাদের জাতীয় পোশাক (সারং) হিসেবে, লুঙ্গি পরেই ক্লাস করা যেত। কিন্তু অক্সফোর্ডে এসে লুঙ্গি নামক এই পোশাকটি পরতে সু চির বেশ লজ্জাবোধ হয়। আর সে জন্যই কিছু দিন তিনি সাদা রঙের একটি জিন্স পরে ক্লাসে যেতেন নিয়মিত। কিন্তু তার কিছু বার্মিজ বন্ধুবান্ধব আড়ালে টিপ্পনি কেটে বলত, “দেখ বিশ্রী বার্মিজ হাঁস সাদা জিন্স গায়ে চাপিয়ে বিলেতি রাজহাঁস সেজেছে। ” এই দুঃখে সু চি জিন্স ছেড়ে স্কার্ট ধরেছেন। অক্সফোর্ডে পড়তে এসে তার সমস্ত জীবনযাত্রাতেই ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। দিল্লিতে সু চির মা ছিলেন বার্মার রাষ্ট্রদূত। তার মা তাকে সব সময় অতন্দ্র প্রহরীর মতো প্রহরা দিয়ে রাখতেন। পাছে তার মেয়ে আবার কোনো ছেলের সঙ্গে প্রেম-ট্রেমে জড়িয়ে না পড়ে। কিন্তু অক্সফোর্ডে সে বাধা নেই। এখানে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন। মুক্ত বিহঙ্গের স্বাদ নিতে গিয়ে সু চি জীবনে প্রথম প্রেমে জড়ালেন। ছেলেটি এসেছে পাকিস্তান থেকে। নাম তারেক হায়দার। পাকিস্তানি এ ছেলেটি একজন তরুণ কূটনীতিক। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বৃত্তি নিয়ে সে এসেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে। তারেক হায়দার দেখতে সুদর্শন, সুঠাম ও দীর্ঘদেহী। উপরন্তু সে একজন তরুণ কূটনৈতিক। যেহেতু সু চির মা ছিলেন রাষ্ট্রদূত সেহেতু সু চির ছোটবেলা থেকেই কূটনৈতিক এই পেশাটির প্রতি বেশ মোহ কাজ করত। সু চির জীবনীকার বিখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক পিটার পপহ্যাম লিখেছেন— “এটি সত্যিই বেশ আশ্চর্যজনক যে সংস্কৃতিগতভাবে অনেক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও কীভাবে সু চি তারেক হায়দারের সঙ্গে আবিষ্ট হয়েছিলেন গভীর প্রেমে। ” তাদের মধ্যকার গভীর প্রেমের আরও দু-একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি— সু চি যেহেতু বেশ কিছু বছর ভারতের দিল্লিতে কাটিয়েছিলেন সেহেতু তিনি অক্সফোর্ডে এসেও ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেই মেলামেশা করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বেধে গেলে, সু চি তারেক হায়দারকে খুশি করতে কোনো ভারতীয় ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে উঠা-বসা তো দূরের কথা তাদের সঙ্গে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দেন। অক্সফোর্ডে যে সব ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করে তাদের বেশির ভাগই সাধারণত প্রথম বিভাগ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু সু চি তারেকের সঙ্গে প্রেমে এতটাই মত্ত ছিলেন যে, তার লেখাপড়া করার সময় ছিল না, আর সে জন্যই সু চি শেষ পর্যন্ত তৃতীয় বিভাগ পেয়ে কোনো রকমে পরীক্ষায় পাস করেছিলেন। অক্সফোর্ডে লেখাপড়ার পাঠ শেষ হলে তারেক হায়দার পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সু চির সঙ্গে সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটে। তাদের প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ায় ভীষণভাবে  মুষড়ে পড়েন সু চি। অশ্রুবিসর্জনের মধ্য দিয়ে কাটে বেশ কয়েক মাস। সু চির জীবনীকার পপহ্যাম লিখেছেন— সু চি প্রায় বছরখানেক সময় বিরহে কাটিয়ে ছিলেন তারেক হায়দারের জন্য, সে সময় তিনি ছিলেন শোকে মুহ্যমান  ও  বিধ্বস্ত। তার এই শোকগ্রস্ত অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য ইংল্যান্ডে সু চির পরিবারের পুরনো বন্ধু স্যার পল গর বুথ ও মিসেস বুথের পুত্র ক্রিস্টোফার সু চির প্রয়াত স্বামী মাইকেল আরিসের সঙ্গে সু চির পরিচয় করিয়ে দেন এবং পরবর্তীতে বছর তিন-চারেক পরে ১৯৭২ সালে তারা দুজন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।বর্তমানে রাখাইন প্রদেশে হাজার হাজার বিপন্ন মানুষ ও জনপদ দেখে আমার কেন যেন মনে হয় সু চি কি তাহলে আজ তার বহুকাল আগের ব্যর্থ প্রেমের প্রতিশোধ নিচ্ছেন। হলে হতেও পারে। এমনটি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। বিচিত্রময় এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই সম্ভব। এ ছাড়া সু চির অন্যতম নির্ভরযোগ্য জীবনীকার পিটার পপহ্যাম ‘দ্য লেডি অ্যান্ড পিক্ক’-এ লিখেছেন সু চির ব্যক্তিগত জীবনের অনেক কিছুই না কি জটিলতায় পূর্ণ ও বৈপরীত্যে ভরা। সু চির আরেকটি বিশেষ দিক হলো শান্তিতে নোবেল পেয়ে কীভাবে তিনি হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের মতো বিষয়গুলোতে নীরবে ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছেন। একজন সুস্থ ও বিবেকবান মানুষের কি এসব দেখে চুপ থাকা সম্ভব। ধর্মের কথা না হয় আমি বাদই দিলাম। কিন্তু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের লোকজন তো মানুষ। না কি তারা জীবজন্তু? বনের পশুদেরও মানুষ এভাবে হত্যা করে না কিংবা করে না লুণ্ঠন ও ধর্ষণ। শান্তিতে নোবেল পাওয়া তথাকথিত এই শান্তির প্রতিভূ না কি আবার গান্ধী ভক্ত। বিষয়টি সত্যিই বেশ হাসির খোরাক জোগায়। ১৯৮৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি কমবেশি প্রায় পনের থেকে একুশ বছর গৃহবন্দী ছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি আমাদের জানিয়েছেন এই পুরোটা সময় তিনি না কি বই পড়ে কাটিয়েছেন। কী ধরনের বই যে তিনি পড়েছেন সে প্রশ্ন আসতেই পারে সামনে। তবে সেখানে যে কোনো মানবতার বই ছিল না সে বিষয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিত। সু চি তার সাক্ষাৎকারে আরও বলেছেন, তার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধী। আজ ভাবতেই অবাক লাগে তিনি যখন তার বাসভবনে গৃহবন্দী ছিলেন তখন তার বাসভবন ঘেঁষে ছিল সামরিক জান্তা প্রদত্ত নিরাপত্তা চৌকি। রাতের অন্ধকারে সু চি মহাত্মা গান্ধীর অহিংস দর্শনের অনেক বাণী লিখে সেগুলো সেঁটে দিয়ে আসতেন সেই নিরাপত্তা কর্মীদের ঘরের দেয়ালে। কথাবার্তায়, আচার-আচরণে, বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি গান্ধীজীর অহিংসার কথা বলতেন; বৌদ্ধধর্মের শান্তির কথা বলতেন, গণতন্ত্রের কথা বলতেন, মুক্তির কথা বলতেন। সু চি সামরিক নিরাপত্তা কর্মীদের প্রশ্ন করতেন “তোমরা কি কখনো রাজনীতি নিয়ে ভাবো কিংবা রাজনীতি নিয়ে চিন্তা কর?” নিরাপত্তা কর্মীরা মাথা নেড়ে না-সূচক অভিব্যক্তি প্রকাশ করতেন। তখন সু চি বলতেন আমার বাবা অং সান বলতেন, “You may not think about politics but politics thinks about you”.  অর্থাৎ তুমি হয়তো রাজনীতি নিয়ে ভাবো না রাজনীতি কিন্তু ঠিকই তোমাকে নিয়ে ভাবে। অথচ আজ এত বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রাখাইন প্রদেশের হাজার হাজার মুসলিম জনগণ অসহায় কিন্তু তাদের পাশে নেই, সেই গান্ধীভক্ত শান্তির প্রতিভূ অং সান কন্যা অং সান সু চি। এ কথা বলা যায় নিঃসন্দেহে যে, আজ যদি মহাত্মা গান্ধী বেঁচে থাকতেন তবে সু চির এই সাক্ষাৎকারটি পড়ে হৃদযন্ত্রের ক্রীড়া বন্ধ হয়ে মারা যেতেন নিশ্চয়ই। বিশিষ্ট গান্ধী ভক্তের মগজ আজ সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন। এ যেন কল্পনা করাও কষ্ট। রাখাইন প্রদেশে জাতিগত এই দাঙ্গা যে কতটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে তা উঠে এসেছে কয়েক সপ্তাহ আগে নিউইয়র্ক টাইমস থেকে প্রকাশিত এক নিবন্ধে। সেখানে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রকাশিত স্যাটেলাইটে ধারণ করা ছবিতে দেখা গেছে, ২২ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামে কমপক্ষে ৮৩০টি বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে ২৫ হাজার বাড়িঘর, দোকানপাট, ১২টি মসজিদ এবং ৩০টিরও বেশি স্কুল। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ১০ বছরে পাঁচ হাজারেরও অধিক গ্রাম ধ্বংস হয়েছে এই জাতিগত দাঙ্গায় এবং এর ফলে পাঁচ লক্ষাধিক উদ্বাস্তু বর্তমানে অবস্থান করছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে।

নিউইয়র্ক টাইমস থেকে প্রকাশিত এই নিবন্ধটিতে প্রকাশিত আরও একটি বিষয় পড়ে আমি বেশ আশ্চর্যান্বিত হয়েছি, সেটি হলো অং সান সু চি রোহিঙ্গাদের বিবেচনা করেছেন বিদেশি হিসেবে। তিনি বলেছেন রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। তারা বাঙালি। আমি অবাক হয়েছি এটা দেখে যে, একজন শিক্ষিত মানুষের ইতিহাস বোধ কতটা তুচ্ছ ও নিম্ন হলে মানুষ এমন মন্তব্য করতে পারে। এ বিষয়ে আমার ১৯৯৭ কি ৯৮ সালের একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। সে সময়ে একবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সফরে গিয়েছিলেন মিসরে। সেখানে মিসরের পিরামিডগুলোর দিকে তাকিয়ে তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে মন্তব্য করেছিলেন- আমাদের পূর্ব পুরুষদের (ইহুদি) ঘাম ও শ্রমে তৈরি হয়েছে এই পিরামিডগুলো। মিসরীয়রা তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন। তারা বিস্মিত হয়েছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর এহেন মন্তব্যের কারণে। ইহুদিদের নবী হজরত মূসা (আ.)-এর জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ সালের দিকে অথচ মিসরের বেশির ভাগ পিরামিডই নির্মিত হয়েছে ইহুদিদের মিসরে দাস হিসেবে আগমনের বেশ কিছুকাল পূর্বে। ঠিক তেমনি আমিও বেশ অবাক হলাম, সু চির মতো একজন মানুষ কীভাবে বললেন যে, রোহিঙ্গারা বাঙালি। এর কারণ কী এই যে, তাদের ভাষার সঙ্গে চট্টগ্রামের মানুষের ভাষার মিল রয়েছে। তাহলে তো বলতে হয় আসামের মানুষও বাঙালি কারণ তাদের কথ্য ভাষায় সিলেট অঞ্চলের মানুষের ভাষার সঙ্গে সাযুজ্য রয়েছে। আসাম অঞ্চলের মানুষের যেমন রয়েছে অহমিয়া নামক স্বতন্ত্র একটি ভাষা ঠিক তেমন রোহিঙ্গাদেরও রয়েছে নিজস্ব একটি ভাষা। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের (রাখাইন) রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আধুনিক লিখিত ভাষাই হলো রোহিঙ্গা ভাষা। এটি ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত যার সঙ্গে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার মিল রয়েছে। রোহিঙ্গা গবেষকরা আরবি, হানিফি, উর্দু, রোমান এবং বার্মিজ স্ক্রিপ্ট ব্যবহার করে সফলতার সঙ্গে রোহিঙ্গা ভাষাটি লিখতে সক্ষম হয়েছেন। হানিফি হচ্ছে নতুন তৈরি করা স্ক্রিপ্ট যা আরবি এবং তার সঙ্গে চারটি বর্ণ (ল্যাটিন এবং বার্মিজ) সংযোগে সৃষ্ট। সম্প্রতি একটি ল্যাটিন স্ক্রিপ্টের উদ্ভাবন হয়েছে রোহিঙ্গা ভাষায়। যা ২৬টি ইংরেজি বর্ণ এবং অতিরিক্ত দুটি ল্যাটিন বর্ণ দিয়ে তৈরি।

ইতিহাস ও ভূগোল বলছে বার্মায় মুসলমানদের আগমনের ইতিহাস অনেক পুরনো। মোহাম্মদ ইবনে আল হানাফি প্রথম মুসলমান হিসেবে ইসলাম প্রচারের জন্য আরাকান উপকূলে আসেন ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে। ইবনে আল হানাফি ও তার স্ত্রীর স্মৃতিস্তম্ভ মংডু উপত্যকায় এখনো বিদ্যমান। ইতিহাস থেকে জানা যায়, নবম শতাব্দী থেকে প্রচুর বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা প্রথম বার্মিজ সম্রাট আনারাথার সময়ে আরাকানে বসতি স্থাপন শুরু করেন। ১০৫৫ খ্রিস্টাব্দে বার্মিজ সম্রাট আনারাথার রাজদরবারে মুসলমানরা অনেক ভালো ভালো পদে যেমন-সম্রাটের উপদেষ্টা, প্রশাসক, নগরপতি, ডাক্তার ও হেকিম হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। আজ রাখাইন জনপদটি অনিরাপদ স্থান হিসেবে বিবেচিত হলেও রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত কিংবদন্তি চালু রয়েছে- সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেছিলেন, ‘আল্লাহর রহমে এবারের মতো বেঁচে গেলাম। ’ এই রহম থেকেই না কি রোহিঙ্গা শব্দটির উত্পত্তি। ইতিহাস থেকে আরও জানা যায় যে, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা ছিল স্বাধীন রাজ্য। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এই রাজ্যটি দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়। মিয়ানমারে ব্রিটিশ শাসন আমলে ব্রিটিশরাও একটি বড় ধরনের ভুল করেছিল। মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতি গোষ্ঠীর তালিকা তারা প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক এই যে তার মধ্যে তারা রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করেননি। আজ সু চি রোহিঙ্গাদের মিয়নমারের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন কিন্তু এর প্রতিউত্তরে বলতে হয় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি সু চির পিতা অং সানের নেতৃত্বে মিয়নমার স্বাধীনতা অর্জন করার পরও রোহিঙ্গারা পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করেছে। আসলে সমস্যাটা শুরু হয় ১৯৬২ সালে। সে সময়ে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করতে শুরু করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ধর্মীয়ভাবেও অত্যাচার করা হতে থাকে। নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়া হয়। হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠন হয়ে ওঠে নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। বিয়ে করার অনুমতি নেই। সন্তান হলে নিবন্ধন নেই। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ। এভাবে একটি জাতি কীভাবে বেঁচে থাকে সেটা একটি আশ্চর্যজনক বিষয়।

রোহিঙ্গা সমস্যাটির প্রধান ভুক্তভোগী যেহেতু বাংলাদেশ সেহেতু সমস্যাটির সমাধানকল্পে বর্তমান সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। দৃঢ় পদক্ষেপে এবং যে কোনো মূল্যে সমাধান করতে হবে এ সমস্যার। সেই সঙ্গে সমস্যাটিকে দেখতে হবে মানবতার দৃষ্টি দিয়ে। বিশ্ব জনমত গঠনে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এই সরকারকেই। বিশ্ববাসীকে বুঝাতে হবে ওরা মানুষ। ধর্ম ওদের যেটাই হোক না কেন। এ প্রসঙ্গে পুলিত্জার পুরস্কার পাওয়া বিখ্যাত লেখক হারপার লি-র সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘টু কিল এ মকিং বার্ড’ থেকে একটি ঘটনার উল্লেখ করে আজকের লিখাটি শেষ করছি। উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট ১৯৩০ সালের সাদা ও কালোর বিভক্তময় আমেরিকা। উপন্যাসটিতে টিম রবিনসন নামে এক কালো যুবকের বিরুদ্ধে মায়েলা এওয়েল নামে একজন শ্বেতাঙ্গ তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। কিন্তু কালো ওই যুবকটি আসলে ছিল নির্দোষ। কিন্তু টিম যেহেতু কালো এবং সংখ্যালঘু সেহেতু সাদারা সবাই মিলে কালো এই যুবকটিকে দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করে। সরকার পক্ষ থেকে এটিকাস ফিন্স নামে একজন ন্যায়পরায়ণ আইনজীবী নিয়োগ করা হয় কালো ওই যুবকটির জন্য। এটিকাস ফিন্স নামক এই আইনজীবী মনে করতেন সমাজে ধনী-গরিব, সাদা-কালো সবাই ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রাখে। কোর্টে যখন বিচারকার্যটি পরিচালিত হচ্ছিল, তখন ফিন্স জুরিদের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন— সম্মানিত জুরিগণ আপনারা অবশ্যই এই মামলায় আপনাদের মূল্যবান রায় ঘোষণা করবেন। কিন্তু আপনাদের প্রতি আমার শুধু একটি অনুরোধ। আপনারা রায় ঘোষণা করার আগে চোখ বুজে শুধু একটি বার চিন্তা করবেন যে, টিম রবিনসন নামে এই যুবকটি একজন নিগ্রো নয়, সে একজন শ্বেতাঙ্গ, তাহলেই যদি এ যুবকটি আজ ন্যায়বিচার পায়। পরিশেষে আমিও বলব বিশ্ববাসী যদি আজ বুঝতে পারে রোহিঙ্গারা মানুষ তবেই হয়তো তারা ন্যায়বিচার পাবে। নচেত নয়।

লেখক : গল্পকার ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী

ই-মেইল :  [email protected]

পাঠকের মতামত: