কক্সবাজার প্রতিনিধি :: সাগরে মাছ ধরার উপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে আজ। ইলিশসহ অন্যান্য সামুদ্রিক মাছের প্রজননকাল উপলক্ষে বঙ্গোপসাগর ও নদী মোহনায় এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে আগামী ২৩ জুলাই পর্যন্ত। ফলে আগামী ২ মাসাধিককালের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক মাছের স্বাদ নেয়ার সুযোগ।
ট্রলার মালিকরা জানান, সাগরে মাছ ধরার উপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার কারণে ইতোমধ্যে কক্সবাজারের প্রায় নব্বই শতাংশ মাছ ধরার নৌকা বঙ্গোপসাগর থেকে ঘাটে ফিরে এসেছে। বাকি ট্রলারগুলো বৃহস্পতিবার বিকালের মধ্যে ঘাটে ফিরবে। তবে গতকাল বুধবারই কক্সবাজার থেকে শেষবারের মতো মাছ সরবরাহ করা হয়েছে রাজধানী ঢাকাসহ জেলার বাইরে।
আজ নিষেধাজ্ঞা শুরুর আগে যেসব ট্রলার মাছ ধরে আনবে তা স্থানীয় বাজারেই বিক্রি হবে। গতকাল বুধবার সাগর থেকে শতশত ট্রলারের ঘাটে ফেরার এ দৃশ্য দেখা যায় সমুদ্র সৈকত থেকে। তবে কক্সবাজারের জেলেরা ঘাটে ফিরে মলিন বদনে। প্রায় সবার মাঝে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ। পরিবার পরিজনের মাঝেও উদ্বেগ– উৎকণ্ঠা। জেলা ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাস্টার মোস্তাক আহমদ বলেন, বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার কারণে কক্সবাজারের প্রায় ৭ হাজার ইঞ্জিন নৌকার মধ্যে ৬ হাজারের বেশি নৌকা ঘাটে ফিরেছে। বাকি বোটগুলো বৃহস্পতিবার বিকালের মধ্যেই ঘাটে ফিরে আসবে বলে আশা করছি।
তিনি জানান, সাগরে মাছধরা বড় নৌকায় ৩০ থেকে ৪০ জন এবং ছোট নৌকায় ৫ থেকে ১৭ জন জেলে থাকে। আবার কক্সবাজার শহরতলীর দরিয়ানগর ঘাটের ইঞ্জিনবিহীন ককশিটের বোটে থাকে মাত্র ২ জন জেলে। ট্রলারগুলোর মধ্যে ইলিশ জালের বোটগুলো গভীর বঙ্গোপসাগরে এবং বিহিন্দি জালের বোটগুলো উপকূলের কাছাকাছি মাছ ধরে থাকে। যে কারণে ইলিশ জালের বোটগুলো পক্ষকালের রসদ নিয়ে এবং বিহিন্দি জালের বোটগুলো সাগরে মাত্র একদিনের রসদ নিয়ে সাগরে মাছ ধরতে যায়। বিহিন্দি জালে ইলিশ ব্যতীত ছোট আকারের প্রায় পাঁচ প্রজাতির মাছ ধরা পড়ে, যাকে স্থানীয় ভাষায় ‘পাঁচকাড়া’ (পাঁচ প্রকারের) মাছ বলা হয়।
দরিয়ানগর বোট মালিক সমিতির সভাপতি নজির আলম বলেন, গত কয়েক মাসে সাগরে তেমন মাছ ধরা পড়েনি। ফলে অধিকাংশ নৌকাই ঘাটে নোঙর করা ছিল। তবে বৃষ্টির পর মাছের আশায় প্রায় সকল জেলেই এখন সাগরে মাছ ধরছে। শেষবারের মতো বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত এই বোটগুলো মাছ ধরবে। যেহেতু এই বোটের মাছগুলো স্থানীয় বাজারেই বেশি বিক্রি হয়।
কক্সবাজার শহরের প্রধান মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র ফিশারীঘাট মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির পরিচালক জুলফিকার আলী বলেন, বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে মাছধরা ও পরিবহণের উপর নিষেধাজ্ঞা শুরু হলেও ১৮ মে এরপর ফিশারীঘাট থেকে দেশের অন্যত্র আর মাছ সরবরাহ করা হবে না। আবার ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগরে মাছ ধরা শুরু হলেও সেই মাছ ধরে অবতরণ কেন্দ্রে আসা শুরু হবে আরো প্রায় এক সপ্তাহ পর। সে হিসাবে আগামী আড়াই মাসের জন্য ‘মৎস্যশূণ্য’ খা খা প্রান্তরে পরিণত হতে যাচ্ছে শহরের প্রধান মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র।
সাগরে মাছ ধরা বন্ধ থাকার কারণে শহরের বরফকলগুলোও আগামী দুই মাসাধিককাল সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি মৎস্য ব্যবসায়ী ও শ্রমিকসহ জেলার প্রায় এক লাখ লোক সাময়িক বেকার হয়ে যাচ্ছে বলে জানান ফিশারীঘাট মৎস্য ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জয়নাল আবেদীন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম খালেকুজ্জামান বলেন, ইলিশসহ অন্যান্য সামুদ্রিক মাছের প্রজননকাল উপলক্ষ্যে বৃহস্পতিবার মধ্যরাত ১২টা থেকে বঙ্গোপসাগর ও নদী মোহনায় মাছ ধরার উপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে। এই নিষেধাজ্ঞা শেষ হবে আগামী ২৩ জুলাই। এই সময়ে দেশের সামুদ্রিক জলসীমানায় সব ধরনের মৎস্য আহরণ, পরিবহণ ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। মাছের প্রজনন, উৎপাদন, সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সাগরে ৬৫ দিন মৎস্য আহরণ বন্ধ রাখতে প্রচার–প্রচারণা চালানো হচ্ছে। কেউ এ সময়ে সাগরে গেলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যে জেলার প্রায় ৬৪ হাজার জেলের জন্য প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী জেলার আট উপজেলায় তা বিতরণ করা হবে।
সাগরে মাছের প্রাচুর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার ২০১৯ সাল থেকে প্রথমবারের মতো ছোট নৌকাগুলোকেও ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার আওতায় নিয়ে আসে। এর আগে ২০১৫ সাল থেকে কেবল বড় বড় বাণিজ্যিক ট্রলারগুলোর জন্যই এ নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। তবে ইলিশের প্রজননকাল উপলক্ষে ছোট ট্রলারগুলোকে ২০১১ সাল থেকেই ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়, যেটি অক্টোবর মাসে এখনও কার্যকর রয়েছে।
পাঠকের মতামত: