অনলাইন ডেস্ক ::
বিসিএস নিয়োগে মেধা কোটা ৪৫ শতাংশ হলেও বাস্তবে গড় নিয়োগ ৭০ শতাংশের বেশি। গত তিনটি বিসিএসে নিয়োগের উপাত্ত থেকে এ হিসাব পাওয়া যায়। মেধা কোটায় নিয়োগের এ হার হচ্ছে ৩৩তম বিসিএসে ৭৭.৪০, ৩৫তম বিসিএসে ৬৭.৪৯ এবং ৩৬তম বিসিএসে ৭০.৩৮ শতাংশ। সংশ্লিষ্ট অনেকে বলছেন, কোটার জন্য বরাদ্দ করা পদ সংরক্ষণ না করা হলে ভবিষ্যতেও মেধাতালিকা থেকেই বেশি নিয়োগ পাবে।
গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে ৩৩তম, ৩৫তম ও ৩৬তম বিসিএসের তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। একই তথ্য গতকাল মঙ্গলবার তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও তুলে ধরেছেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৩২তম বিসিএসের মুক্তিযোদ্ধা কোটা পূরণ না হওয়া এক হাজার ১২৫টি পদ ৩৩তম বিসিএসের মেধা তালিকা থেকে পূরণের সিদ্ধান্ত দিয়েছিল সরকার। এ কারণে ৩৩তম বিসিএসে মেধা কোটায় নিয়োগ ৭৭.৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। ৩৫তম বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা, মহিলা ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় পূরণ না হওয়া ৩৩৮টি পদ ৩৬তম বিসিএসের মেধাতালিকা থেকে পূরণের সিদ্ধান্ত দিয়েছিল মন্ত্রিসভা। একই সঙ্গে ৩৬তম বিসিএসে কোটার ৭৩৭টি পদের ক্ষেত্রে পদ সংরক্ষণের বিধান শিথিল করা হয়েছিল। সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণে ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষায় মেধা কোটায় ৭০.৩৮ ভাগ নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।
সূত্র মতে, পিএসসি সরকারকে সতর্ক করে বলেছিল, ৩৬তম বিসিএসে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৪৯১টি, নারী কোটায় ১৬৪টি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটায় ৮২টি পদ খালি থাকবে। এসব পদ সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করা হলে জনবলের অভাব হবে। পিএসসির আবেদনে সাড়া দিয়ে মন্ত্রিসভা কোটার পদ সংরক্ষণ না করে জাতীয় মেধা তালিকা থেকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। এভাবে একেকটি বিসিএস সামনে এসেছে এবং কোটা পূরণে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তখন শূন্য পদ মেধাবীদের দিয়ে পূরণের জন্য পিএসসি মন্ত্রিসভার কাছে ছুটে গেছে। মন্ত্রিসভা একটি করে বিসিএস আমলে নিয়ে সিদ্ধান্ত শিথিল করেছে।
১৯৯৭ সালে কোটা ব্যবস্থাকে সম্প্রসারিত করে প্রথম মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আওতাভুক্ত করা হয়। ২০১১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিরাও কোটার আওতায় আসেন। বর্তমানে ৫ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ এবং নারী ও জেলা কোটা ১০ শতাংশ করে রয়েছে। সব মিলিয়ে কোটার জন্য বরাদ্দ ৫৫ শতাংশ।
বিসিএসের বাইরেও কোটায় যোগ্য প্রার্থীর অভাবে বিভিন্ন নিয়োগ আটকে যাচ্ছিল। গত বছর সরকার প্রায় ১০ হাজার সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নিলে শুরুতেই তা থেমে যায় মুক্তিযোদ্ধা কোটার কারণে। একপর্যায়ে এখানেও কোটা শিথিল করে মেধা তালিকা থেকে নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিসভা। একইভাবে মিডওয়াইফ বা ধাত্রী নিয়োগেও কোটা শিথিল করা হয়।
চলতি বছরের শুরুতে আরো চার হাজার সিনিয়র স্টাফ নার্স ও ধাত্রী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ সময়ও কোটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বিষয়টি মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থাপন করা হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনপ্রশাসন সচিবের কাছে জানতে চান, বারবার কোটা শিথিলের প্রস্তাব আসছে কেন। তখন বৈঠকে জনপ্রশাসনসচিব বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন যে বিভিন্ন কোটায় যোগ্য প্রার্থীর অভাব রয়েছে। যোগ্য প্রার্থীর অভাবে পদগুলো শূন্য থেকে যায়। এসব পদ দীর্ঘদিনেও পূরণ করা সম্ভব হয় না। এ সময় কয়েকজন সিনিয়র মন্ত্রীও প্রধানমন্ত্রীকে জানান, সরকারি সেবা জনবলের অভাবে পূরণ করা সম্ভব না হলে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়।
সূত্র মতে, এই পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত দেন বিষয়টি যেহেতু বারবার মন্ত্রিসভায় আসছে তাহলে এর স্থায়ী সমাধান দেওয়া দরকার। নির্দেশনায় বলা হয়, প্রতিটি নিয়োগের জন্য আলাদা আলাদা কোটা শিথিলের প্রস্তাব এলে সমস্যা হয়। যারা এ প্রস্তাব তৈরি করেন, তাঁদেরও সময় ব্যয় হয়। এখন থেকে কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে সেসব পদ সংরক্ষণের দরকার নেই। এসব পদ মেধাবীদের দিয়ে পূরণ করা যাবে। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা গত ৫ মার্চ আদেশ আকারে জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে ওই আদেশটি পূর্ণাঙ্গ না হওয়ায় গত ৫ এপ্রিল আরো একটি আদেশ জারি করে একই মন্ত্রণালয়।
গতকাল হাসানুল হক ইনু সাংবাদিকদের বলেছেন, বর্তমান সরকার কোটা পদ্ধতি চালু করেনি। বরং এ সরকার কোটা পদ্ধতি প্রয়োগের বিষয়টি সুস্পষ্টকরণ ও যৌক্তিকীকরণের পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সর্বশেষ গত ৫ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে কোটা পদ্ধতির অনেক সংস্কার সাধিত হয়েছে। তিনি আরো বলেন, কোটা পদ্ধতি প্রয়োগে সরকারের এই সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ও অবস্থানের প্রতিফলন বেশ আগ থেকেই ঘটতে শুরু করে। তা সাম্প্রতিককালের কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষার নিয়োগে তা দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে মেধা কোটা ৪৫ শতাংশ হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে মেধার ভিত্তিতেই নিয়োগ ৭০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও। সাবেক এই আমলা বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে কোটা অবশ্যই থাকবে। সমাজে যারা পশ্চাত্পদ, তাদের জন্য কোটা থাকা উচিত। প্রশ্ন হচ্ছে, কত শতাংশ কোটা থাকবে। কোটা এখন যা আছে, তা বোধ হয় অনেক বেশি হয়ে গেছে। এটি সংস্কার করা উচিত। কোটা সংস্কারের বিষয়টি আমার মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। তার পরও আমি প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিয়েছি, এটাকে সংস্কার করার জন্য। বাজেটের পর ৫৬ শতাংশ কোটা অবশ্যই সংস্কার করা হবে। কারণ, কোটায় যত পদ আছে, তত লোক পাওয়া যায় না।’
সংবিধানের বাধ্যবাদকতার কারণে শুরু থেকেই বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা রয়েছে। ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করা হয়। ওই সময় ৪০ শতাংশ জেলা কোটা, ১০ শতাংশ নারী কোটা এবং ২০ শতাংশ মেধা কোটা ছিল। ১৯৭৬ সালে জেলা কোটা ২০ শতাংশ কমিয়ে মেধা কোটা ৪০ শতাংশ করা হয়। ১৯৮৫ সালে মেধা কোটা ৪৫ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ৫ শতাংশ এবং মুক্তিযোদ্ধার জন্য ৩০ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়।
পাঠকের মতামত: