ঢাকা,বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাঁচা পাঁচ বোনের করুণ কাহিনী

ddddজসিম মাহমুদ, টেকনাফ ::

মিয়ানমার ছাড়তে ছাড়তে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে ’রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে সে দেশের সৈন্যরা’। তাদের মৌলিক সব নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে, তাদের বিয়ে করার অধিকার নেই, ধর্মকর্ম করার অধিকার নেই, শিক্ষার অধিকার নেই। অনেক রোহিঙ্গাকে বাস্তুচ্যুত হতে হয়। অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চোরাকারবারিদের নৌকা করে পালিয়ে গিয়ে মারাও যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন অত্যাচারের শিকার হয়ে প্রাণে বেচেঁ অনুপ্রবেশকারিরা। এমনকি ধর্ষন, জবাই, আগুনে পুড়িয়ে ও গুলি করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যার করছে মিয়ানমারের সৈন্যরা এমন সংবাদ আন্তজার্তিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে।

হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা শিবির ক্যাম্পে নাফনদী পার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারি ছলিমা বেগম, রেহেনা বেগম, মুমিনা বেগম, শাকরিা, তসলমিার ও শাকের আহমেদ এসব কথা অভিযোগ করে বলেন। তাঁরা সবাই মিয়ানমারের মংডু শহরের ছোট গরজিল, রাইম্য বিল ও রাইক্যং গ্রামের বাসিন্দা। এখন তাঁরা হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা শরনণার্থী ক্যাম্পে কষ্টে জীবন কাটাচ্ছেন। তবে বাংলাদেশ সীমান্তের বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের কড়া নজরদারি কারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকতে পারছেনা।

নির্যাতনের শিকারের বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ছলিমা বেগম জানান, মিয়ানমারের অত্যাচারের ভয়ে আমরা ৫ বোনসহ আমরা একউ গ্রামের প্রায় ২০ জন রাতে আধারে বাংলাদেশে ঢুকি। মিয়ানমারের সৈন্যদের অভিযানের মুখে পড়ে বড় ভাই দিল আহমেদ পালিয়ে গেছে। কিন্তু সে মারা গেছে নাকি জীবত আছে তা আমি জানিনা। আমাদের একটু দুরে এক বাড়িতে সৈন্যরা ঢুকে বাড়ি আগুন জালিয়ে দেয়। এসময় আগুন দেখে আমরা সবাই বাড়ি ফেলে পালিয়ে যায়। এরপর আমারা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ি। অনেক গ্রামের বাড়িতে আগুনে পুড়িয়ে অনেক মানুষকে হত্যা করেছে তারা। তাঁরা নারীদের ধর্ষন, জবাই, আগুনে পুড়িয়ে ও গুলি করে রোহিঙ্গা মুসলিমদের হত্যার করছে। যাতে মিয়ানমারে কোন রোহিঙ্গা না থাকে। প্রাণে বাচঁতে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ছাড়তে হচ্ছে।

মেঝ বোন রেহেনা জানান আমি সহ ছোট দুই বোন সদ্য কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে প্রবেশ করেছে। সেনাবাহিনীর ভয়ে আমরা চার বোনকে বড় বোনের বাড়িতে এনে রেখেছিলেন। কিন্তু চার দিন আগে এক ভোরে মিয়ানমারের সৈন্যরা দুলাভাই এর বাড়িতে ঢোকে। চার বোনকে একসাথে বেঁধে রাখে। খানিক পরে দুলাভাই কে ঘরের বাহিরে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে জানতে পারি দুলাভাইকে জবাই করে হত্যা করা হয়। তারা আমি সহ দুবোন নিয়ে যাচ্ছিল তা দেখেও বোনদের না নিতে সৈন্যদের পায়ে পড়েন আমার বড় বোন ছলিমা। কিন্তু সৈন্যরা তাকে মারধর করে মাটিতে ফেলে যায়। তিন ঘন্টা পরে আমরা তিন বোনকে বাড়িতে দিয়ে যায়। ঘটনা জানতে চাইলে, বোন দুটি নিশ্চুপ হয়ে কাঁদতে থাকে।

টেকনাফ লেদা ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. রশিদ, মো. দুদু মিয়া জানান, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অভিযানের কারণে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। বেশির ভাগ রোহিঙ্গারা রাতে আধাঁরে কয়েকটি সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছেন। তবে এখন সীমান্তে আরও বেশি নজরদারি বৃদ্ধি করা রোঙ্গিরা আগের মত ঢুকতে পারছেনা। রোহিঙ্গারা এখন দিনের বেলায় নাফনদীতে ভাসমান অবস্থায় থাকছে। সুযোগ বুঝে রাতের আধাঁরে আইনশৃঙ্কলাবাহিনীকে ফাকিঁ দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছেন। অনুমানিক কয়েক তিন হাজারের মত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকতে পারে বলে মনে করেন তাঁরা।

এদিকে মিয়ানমারের নাগরিকদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে নজরদারি আরও বাড়িয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্টগার্ড ও পুলিশ সদস্যরা।এ প্রসঙ্গে কোস্টগার্ড চট্টগ্রাম অঞ্চলের অপারেশন কর্মকর্তা ডিকশন চৌধুরী বলেন, ‘নাফ নদীতে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকার খবর শুনে নদীতে টহল আরও বেশি জোরদার করা হয়েছে। কোনো রোহিঙ্গা যেন ঢুকতে না পারে সেজন্য নদীতে টহল অব্যাহত রাখা হয়েছে।রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাড়ল নজরদারিসংশ্লিষ্টরা জানান, এখন থেকে রোহিঙ্গাদের মাঝ নদীতেই বাধা দেওয়ার কৌশল নিয়ে মাঠে নেমেছে কোস্টগার্ড; যাতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের ভেতরেই আসতে না পারে।

মিয়ানমারের কয়োরি পাড়া গ্রামের বাসিন্দা ছলিমা বেগম খালা নুর বাহার জানান, তার স্বামী দিলদার হোসেন একজন জেলে। মাছ শিকার করে তাদের পরিবারের সংসার চলে। তার চার ছেলে-মেয়ে রয়েছে। মিয়ানমারের সৈন্যরা বাড়িতে ঢুকে তাকে বের করে দিয়ে তার স্বামীকে ঘরে আটকে দেয়। পরে সৈন্যরাও বাহির থেকে ঘরের চার পাশে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এরপর কি আর বলব? আগুন দিয়ে কেউ কি বেচেঁ থাকে। তারা এইভাবে আমার স্বামীর মত অনেককে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। তারপর আমি প্রাণের ভয়ে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে নাফনদী পার হয়ে একটি নৌকা করে আমরা ২৫ জন বাংলাদেশ অনুপ্রবেশ করি।

শুধু তাই নয় রোহিঙ্গাদের প্রতিটি বাড়িতে তল্লাশি চালানোর সময় রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের সাথে জড়িত সন্দেহ হলে সে বাড়ি পুড়িয়ে দিতে দ্বিধা করছে না সৈন্যরা। বাড়ি থেকে কাউকে বের হতে দেখলেই গুলি চালায়। শুধু বাড়ি পুড়িয়ে ক্ষান্ত হচ্ছেনা। বাড়ি পুড়িয়ে দেবার পর তাদের খোংলা আকাশে তাদের বসিয়ে থাকতে বাধ্য করছে তাঁরা।’ এমন বর্ণনা দিলেন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারি কামল হোসেন ও মো. মুজিবুল্লাহ। তারা মিয়ানমারের চালিয়া পাড়ার বাসিন্দা। গত মঙ্গলবার ভোরে হ্নীলা ইউনিয়নের মিনাবাজারের সংলগ্ন নাফনদী পার হয়ে একটি নৌকা করে ২০ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে।

২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুজার আল জাহিদ বলেন, ‘নাফ নদীর যেসব পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা বেশি প্রবেশের চেষ্টা করছে সেসব পয়েন্টে বিজিবির নজরদারি আরও বাড়ানো হয়েছে। তাছাড়া নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে শূন্যরেখা অতিক্রম করে রোহিঙ্গাভর্তি কয়কেটি নৌকা অনুপ্রবেশ চেষ্টা করছিল তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে ঠেকানো হয়েছে। তার পর থেকে সীমান্তে বিজিবি বাড়ানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে, টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শফিউল আলম বলেন, ‘রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্ত এলাকায় বিজিবি ও কোস্টগার্ডকে আরও বেশি সতর্ক রাখা হয়েছে। যাতে করে কেউ অনুপ্রবেশ করতে না পারে।’

পাঠকের মতামত: