ঢাকা,মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪

মাদক কারবারিদের তালিকায় পুলিশ ও নেতাদের নাম

নিউজ ডেস্ক ::
পুলিশের অপরাধ কমানো ও নিয়োগ বাণিজ্য প্রতিরোধ করতে নতুন করে নানা উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এ জন্য ‘স্পেশাল মনিটরিং’ নামে একটি টিম গঠন করা হয়েছে।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের সদস্যদের দুর্নীতিসহ অপরাধ ঠেকাতে কাজ করবে এই টিম। আর টিমটি সরাসরি তত্ত্বাবধান করবেন পুলিশের মহাপরিদর্শক।
গত রবিবার পুলিশ সদর দপ্তরে দিনব্যাপী ত্রৈমাসিক সভায় বেশ কয়েকজন পুলিশ সুপারের (এসপি) বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠায় সব জেলার এসপির ওপর নজরদারি করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাঁদের প্রতিটি কর্মকাণ্ড তদারকি করবে মনিটরিং টিম। এসপিদের রাজনৈতিক তদবির না শোনার ব্যাপারেও বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যদের তালিকা করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সভায় ২০১৭ সালের চতুর্থ কোয়ার্টারের (অক্টোবর-ডিসেম্বর) অপরাধ নিয়ে আলোচনা হয়। সারা দেশ থেকে আসা এসপিদের মধ্যে ২৭ জন সভায় বিভিন্ন সমস্যার কথা উত্থাপন করেন। মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর সভাপতিত্বে বৈঠকে এসপি থেকে শুরু করে অতিরিক্ত আইজি পর্যন্ত সবাই খোলামেলা বক্তব্য দেন।
পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকে পুলিশের অপরাধ, নিয়োগ বাণিজ্য, রাজনৈতিক নেতাদের তদবিরসহ নানা বিষয় উত্থাপন করে বক্তব্য দেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত আইজি মোখলেসুর রহমান, র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ, ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
সভায় বেশির ভাগ কর্মকর্তাই বলেছেন, পুলিশের ভেতরেই নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতাদের তদবিরে দিশাহারা পুলিশের প্রতিটি সদস্য। বেশির ভাগ রাজনৈতিক নেতাই থানা থেকে শুরু করে এসপি, ডিআইজিদের কাছে তদবির করে আসছেন। তদবির না শুনলে অন্যত্র বদলি করার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। পুলিশে নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হলে তাঁদের অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায়। মন্ত্রী-এমপিদের ডিও লেটার হিসেবে তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হয়। রাজনৈতিক নেতাদের তালিকায় থাকা লোকদের দলীয় মতাদর্শী পরিচয় দিয়ে বলা হয় পুলিশে নিয়োগ দিতে। তাঁদের কথা না শুনলেই বদনাম রটিয়ে দেন। উদাহরণ দিয়ে একজন উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বলেন, তিনি বছরখানেক আগে একটি রেঞ্জে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ওই সময় পুলিশের নিয়োগ হয়েছে। কয়েকজন মন্ত্রী ও নেতা একটি লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বলেছেন এদেরকে নিতেই হবে। ওই তালিকার মধ্যে দু-একজন বাদে সবাই পরীক্ষায় ফেল করে। তাদের না নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলে ওই মন্ত্রীরা আমার ওপর তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। ডিআইজি আরো বলেন, মন্ত্রী ও অন্য ওসিদের পছন্দের থানাগুলোতে পোস্টিং দিতেও একের পর এক চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু তিনি তা না করে ওই ওসিদের অন্য জেলায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এই ডিআইজি বলেন ‘এর ফলে আমার ওপর খড়্গ নেমে আসে। আমার বিরুদ্ধে নানা কুৎসা রটাতে থাকেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত রেঞ্জ থেকে আমাকে অন্যত্র বদলির ব্যবস্থা করে ফেলেন। ’
একজন অতিরিক্ত ডিআইজি বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আজ অনেক কথা বলা হচ্ছে। যত দিন পুলিশ ও রাজনৈতিক নেতারা ঠিক হবেন না, তত দিন দেশ থেকে মাদক নির্মূল হবে না। আমি একটি রেঞ্জে দায়িত্ব নেওয়ার পর মাদকের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চালাই। অভিযান চালাতে গিয়ে দেখি, মাদক কারবারিদের তালিকায় পুলিশ ও শাসক দলের নেতাদের নাম। যাদের নাম এসেছিল তাদের ধারেকাছেও যাওয়ার কোনো পথ ছিল না। ’
সূত্র জানায়, ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘একজন কনস্টেবল নিয়োগে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এসআই নিয়োগে নেওয়া হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। এসব টাকার ভাগ পাচ্ছেন রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ঢাকার একজন উপকমিশনার জানিয়েছেন, থানাগুলোতে পোস্টিংয়ের জন্য রেঞ্জ ডিআইজি, এসপি ও স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা টাকার ভাগ পাচ্ছেন। ঢাকাতেও একই অবস্থা। মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে থানায় যাওয়ার পর ওই সব পুলিশ কর্মকর্তা দুর্নীতিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তাঁরা মাদক কারবারি ও অপরাধীদের গডফাদারদের সঙ্গে আঁতাত করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। ওসি থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত সবাই থানায় আসা মানুষদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। পড়ালেখা না জানা লোকজন জিডি লিখতে না পারলে তাদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়া হচ্ছে। অথচ পুলিশ সদর দপ্তর থেকে নির্দেশনা আছে, জিডি করতে কোনো টাকা-পয়সা লাগবে না। আগে আমাদেরই সংশোধন হতে হবে। ’ তিনি এসব বন্ধ করার উপায় খুঁজতে ঊর্ধ্বতনদের প্রতি আহ্বান জানান।
সূত্র জানায়, ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার বৈঠকে বলেন, পুলিশের নিয়োগ বাণিজ্য প্রতিরোধ করতে হবে। কোনো ধরনের তদবির শোনা যাবে না। যাদের জন্য তদবির আসবে, তাদের পুলিশে নিয়োগ না দেওয়া উচিত। মাদক প্রতিরোধ করতে সম্মিলিতভাবে অভিযান চালাতে হবে। পুলিশের মধ্যে যারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে তাৎক্ষণিক আইনের আওতায় আনতে হবে।
ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার বলেছেন, মহিলা পুলিশদের ব্যাপারে সহানুভূতি দেখাতে হবে। বিভিন্ন থানায় তাদের দিয়ে পাহারার কাজ করানো যাবে না। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (অপারেশন) বলেন, সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য নির্বাচনে নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালন করতে হবে। পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি (গোপনীয়) বলেন, জঙ্গি অভিযান আরো জোরালো করতে হবে। জঙ্গিসংক্রান্ত মামলা, তদন্ত ও তদারকি করে তা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হবে। নির্বাচনী তথ্য আদান-প্রদানে সতর্ক থাকতে হবে।
সূত্র জানায়, সভা শেষ হওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন আইজি। সেখানে সবার সম্মতিক্রমে স্পেশাল মনিটরিং টিম গঠন করা হয়। বৈঠকে উপস্থিত থাকা একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, কনস্টেবল নিয়োগ নিয়ে কোনো ধরনের তদবির করলে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। রাজনৈতিক নেতারা কোনো তালিকা দিলে তা তদন্ত করতে হবে। নেতাদের লোকজন পরীক্ষায় না টিকলে তাকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। কোনো ধরনের চাপ এলে আইজি থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করতে বলা হয়েছে। রাজনৈতিক নেতাদের তদবির না শুনতে বলা হয়েছে।
সূত্র জানায়, পুলিশের মহাপরিদর্শক বৈঠকে বলেছেন, ‘এখনো সময় আছে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা ভালো হয়ে যান। আর না হলে আমাদের শাস্তি দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না। কনস্টেবল নিয়োগে একদম স্বচ্ছ থাকতেই হবে। কোনো তদবির চলবেই না। থানাগুলোকে সেবার স্থানে নিতে হবে। পুলিশের দুর্নীতি ও মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স থাকবেই। ’
এসপি অফিসের সব রিজার্ভ অফিসারকে একযোগে বদলির সিদ্ধান্ত : দেশের সব কটি জেলায় পুলিশ সুপারদের অফিসে কর্মরত রিভার্জ অফিসার-১, রিজার্ভ অফিসার-২ (আরও-১ ও ২)কে একযোগে আজ মঙ্গলবারের মধ্যে বদলি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশে আরও-১ হলো এসআই আর আরও-২ হলো এএসআই হিসেবে পরিচিত।
বছরের পর বছর ধরে তাঁরা একই পদে কর্মরত আছেন। তাঁদেরকে অন্য কোথাও বদলি করা হয় না। তাঁদের মাধ্যমে এসপিরা সব ধরনের গোপন কাজ করে থাকেন। ফলে পুলিশের বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে তাঁদের যোগসূত্র আছে বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা।
এ প্রসঙ্গে গতকাল রাতে পুলিশ সদর দপ্তরের এক ডিআইজি কালের কণ্ঠকে জানান, ইতিমধ্যেই আরওদের তালিকা সম্পন্ন করা হয়েছে। তাঁরা নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। মূলত তাঁদের মাধ্যমেই পুলিশের নানা অনিয়ম হয়ে থাকে।
অনিয়মের প্রমাণ মিললেই পরীক্ষা বাতিল : এদিকে পুলিশ সদর দপ্তর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেসব জেলায় কনস্টেবলসহ অন্যান্য পদে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে কোনো অনিয়ম ধরা পড়লে তাৎক্ষণিকভাবে পরীক্ষা বাতিল করা হবে। বিশেষ করে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় ছদ্মবেশে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সদস্য পর্যবেক্ষণ করবে। আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

পাঠকের মতামত: