ঢাকা,বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪

ভালো নেই বৃক্ষমানব, মুক্তামণির পরিবারও দুশ্চিন্তায়

নিউজ ডেস্ক ::

ভালো নেই বিরল রোগে আক্রান্ত আবুল বাজেদার। তার হাত-পা জ্বালা-পোড়া করছে। হাত-পায়ের আঙুলগুলো আবারো গাছের শেকড়ের মতো হয়ে উঠছে। দিন দিন তা বাড়ছে। ২৪ বার অপারেশন করেছিলেন আবুল বাজেদার। সর্বশেষ গেল বছরের ১২ই জুলাই তার অপারেশন হয়।
কিন্তু অপারেশনের ১৫ দিন পর থেকেই আবার গোড়া থেকে গাছের শেকড়ের মতো বের হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন। গত প্রায় দুই বছর ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন রয়েছেন আবুল বাজেদার। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ভেবেছিলাম সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যাবো। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করবো। কিন্তু হলো না। আবার শেকড়ের মতো বাড়লেও এখনও আশা ছাড়িনি। শরীরে খুব ব্যথা হয়। চিকিৎসকরা চেষ্টা করছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। তার সঙ্গে থাকা স্ত্রী হালিমাও কষ্টের কথা জানিয়েছেন। রোগটি আবার বৃদ্ধি পাওয়া দুশ্চিন্তায় আছেন। মনকে বোঝাতে পারছেন না। তবে আশাবাদী তারা। আবুল বাজেদার প্রসঙ্গে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, আবারও তার অপারেশ করা হবে। এজন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়েছি। মাঝে মাঝে এই রোগটি বাড়বে, আবার অপারেশন করতে হবে। এজন্য তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়নি। বাজেদারকে নিয়ে তারা আশাবাদী বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) বার্ন ইউনিটে দীর্ঘ ছয় মাস চিকিৎসা শেষে গত ২২শে ডিসেম্বর বাড়িতে ফিরে যাওয়া রক্তনালির টিউমারে আক্রান্ত বারো বছর বয়সী শিশু মুক্তামণিও ভালো নেই। দুশ্চিন্তায় তার পরিবার। সে জানিয়েছে, ‘আমার হাত আগের চেয়ে ভার লাগে। জ্বালা-পোড়া করে। হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিয়েছে। বাড়ি এসেছি। মুক্তামণির বাবা ইব্রাহিম হোসেন বলেন, ওর (মুক্তামণি) হাত ফুলে যাচ্ছে। ভালো তেমন হচ্ছে না। হাতে কোনো অনুভূতি পাচ্ছে না। ডাক্তারা দীর্ঘ ছয় মাস চেষ্টা করেছেন। হাতের ওজন ৩ থেকে ৪ কেজি ছিল, যা আগের মতোই আছে। তেমন উন্নতি হয়নি। চিকিৎসকরা বলেছেন, দুই বছর সময় লাগবে। হাতে আগে গন্ধ হতো এবং পোকা হতো। তা এখন হচ্ছে না। এক মাস পরে ঢামেকে যাওয়ার কথা থাকলেও চিকিৎসকরা তাদের শীত শেষে হাসপাতালে আসার জন্য বলেছেন বলে ইব্রাহিম হোসেন উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, মুক্তামণি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি। সে বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেছিল। এজন্য কয়েকদিনের জন্য রিলিজ দেয়া হয়েছে। সে আবারও আসবে। শীতের জন্য তাদের একটু দেরিতে আসতে বলেছি।
মুক্তামণির বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার সদর উপজেলার দক্ষিণ কামার বায়েশা গ্রামে। এ বছরের ১২ই জুলাই ঢামেক হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি হয় সে। বার্ন ইউনিটের ৬০৮ নম্বর কেবিনে ছিল মুক্তামণি। প্রথমে তার রোগটিকে বিরল রোগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। পরে বায়োপসি করে জানা যায়, তার রক্তনালিতে টিউমার হয়েছে। তখন তার উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে যোগাযোগ করেন বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা। মুক্তামণির সব রিপোর্ট দেখে তারা চিকিৎসা করতে অস্বীকৃতি জানান। পরে ঢামেকের চিকিৎসকরাই তার অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন। এদিকে, মুক্তামণির চিকিৎসার সব ধরনের খরচের দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মুক্তামণির হাতে ১২ই আগস্ট প্রথম অস্ত্রোপচার হয়। তার হাতের ফোলা অংশ অস্ত্রোপচার করে ফেলে দেন চিকিৎসকরা। পরে দুই পায়ের চামড়া নিয়ে দু’দফায় তার হাতে লাগানো হয়। ঢামেকের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালামের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞ একদল চিকিৎসক মুক্তামণির স্কিন গ্রাফটিং (চামড়া লাগানো) অপারেশনে অংশ নেন। পরে মুক্তামণির হাত আবার ফুলে যাওয়ায়, ফোলা কমানোর উদ্দেশ্যে হাতে প্রেসার ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়া হয়।
মুক্তামণিকে কয়েক দফায় বার্ন ইউনিটের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখা হয়। প্রথম অপারেশনের পর ডা. সামন্ত লাল সেন সাংবদিকদের জানিয়েছিলেন, তাকে সুস্থ করা আরো দীর্ঘদিনের ব্যাপার, কেননা দেরির কারণে তার শরীরের আরো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নষ্ট হয়ে গেছে। এমনকি আক্রান্ত হাতটি ফেলে দেয়ার আশঙ্কা ছিল। মুক্তামণি পুরো সেরে উঠবে কি না সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত নন বলে তিনি মন্তব্য করেন। তার হাতের টিউমারটা সরানো তার চিকিৎসার প্রথম স্টেজ। এখনো অনেকদূর যেতে হবে।
অন্যদিকে কয়েকবার অপারেশনের পর স্বাভাবিকের পথে আসতে শুরু করেন গাছমানব। নতুন করে স্বপ্ন দেখেছিলেন বাজেদার ও তার পরিবার। কিন্তু নতুন করে আবার শেকড়ের মতো হাতে ও পায়ে সেই রোগ দেখে তার পরিবার দুশ্চিন্তায় পড়েছে। বিরল রোগে আক্রান্ত আবুল বাজেদারের প্রথমে এক হাতে অস্ত্রোপচার করে ভারমুক্ত করা হয়েছে গত ২০১৬ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি। সাড়ে তিন ঘণ্টার অপারেশনে তার হাতের পাঁচ আঙুলের ওপর বেড়ে ওঠা অংশ ফেলে দেয়া হয়েছে। জটিল অপারেশন নিয়ে চিকিৎসকরা সংশয়ে থাকলেও শেষে তারাও স্বস্তি প্রকাশ করেছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবুল কালামের নেতৃত্বে চিকিৎসকদের একটি দল আবুলের ডান হাতের পাঁচটি আঙুলেই অস্ত্রোপচার করেন ওই সময়ে। এরপর একই বছরের ১৯শে মার্চ বাম হাতে অস্ত্রোপচার সফলভাবে সম্পন্ন হয়। এর মধ্যদিয়ে তার দু’হাতই অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। তার প্রায় এক মাস আগে অপারেশন হয়েছিল তার ডান হাত। এরপর পর্যায়ক্রমে চিকিৎসকরা তার শারীরিক অবস্থা বুঝে হাত ও পায়ের অন্যান্য অপারেশনগুলো করেন চিকিৎসকরা। সর্বশেষ গেল বছরের ১২ই জুলাই অপারেশন করা হয় আবুল বাজেদারের।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পৃথিবীতে বাংলাদেশসহ এখন পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকজনকে এ রোগে আক্রান্ত হতে দেখা গেছে। তাদের ইন্দোনেশিয়ায়, রোমানিয়া এবং সর্বশেষ এই বাংলাদেশে দেখা গেল। এই রোগী বাংলাদেশে প্রথম। হাসপাতালে ভর্তির পর থেকেই চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে তার চিকিৎসা হবে। তার জন্য গঠন করা হয় ৯ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড। চিকিৎসকদের ধারণা, আবুল বাজেদার ‘এপিডার্মোডিসপ্লাসিয়া ভেরাসিফরমিস’ রোগে আক্রান্ত। রোগটি ‘ট্রি-ম্যান’ (বৃক্ষমানব) সিনড্রম নামে পরিচিত। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এ রোগ হয়। খুলনার পাইকগাছার এই যুবক গত ১২ বছর ধরে এই রোগে ভুগছিলেন। তার হাত ও পায়ের আঙুলগুলো গাছের শেকড়ের মতো হয়ে যায় এবং দিন দিন তা বাড়তে থাকে। তাকে ২০১৬ সালের ৩০শে জানুয়ারি ঢামেকের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। রাখা হয় বার্ন ইউনিটের ৫১৫ কেবিনে।

পাঠকের মতামত: