ঢাকা,রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

বাবা দিবসের ভাবনা… যারা আকাশে তাকিয়ে অলক্ষ্যে বাবার স্মৃতি হাতড়ায়!

jaynob:::  জয়নব ইসলাম  :::

“কাটে না সময় যখন আর কিছুতে/বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না/জানলার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা/মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না/ আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়…।” হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদারের গাওয়া এই গানটি সন্তানদের এক অসীম নস্টালজিয়ায় ডুবিয়ে দেয়।

এই গানের সুর যখন কানে এসে লাগে এমন কোন সন্তান নেই যার বাবার কথা এবং এমন কোন বাবা নেই যার সন্তানের কথা মনে না পড়ে। মনে হয় অতীতের গহব্বর থেকে কথাগুলো মধুরতম সুর হয়ে হৃদয়ে পরশ বুলিয়ে দিয়ে যায়।

গানটি কি শুধুই সুরের জন্য ভাল লাগে?

না।

কারণ এই সুরের মধ্যে মিশে আছে একটি অকৃত্রিম ভালোবাসা। সুরকে হৃদয় স্পর্শী করা এই ভালোবাসার নাম-‘বাবার প্রতি ভালোবাসা’।

সাধারণত ‘বাবা’কে নিয়ে আমাদের সংস্কৃতিতে খুব বেশি আদিখ্যেতা নেই। বাবা মানে দূরের মানুষ। সংসারের রাশভারী, নামজাদা মেহমান। তাঁকে পাতলা পর্দার মতো ঘিরে থাকে ভয়, রাগ, শাসন আর গাম্ভীর্য।

আবার কীভাবে যেন তাঁর মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় এক আকাশ নির্ভরতা আর একরাশ নিরাপত্তার অনুভূতি। তিনি ভালোবাসেন ঠিকই, স্নেহও করেন, কিন্তু সবই যেন সীমিত মাত্রায়। বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কে মিশে থাকে খানিকটা দূরত্ব, খানিকটা সংকোচ, খানিকটা ভীতি মেশানো শ্রদ্ধা।

তবে আমার কাছে বাবা একটু ভিন্ন।

আমার ভরসা ও ছায়ার নাম ‘বাবা’ । আমার কাছে বাবা মানে নির্ভরতার আকাশ, আর একরাশ নিরাপত্তা। বাবা আলোকের ন্যায়, সমীরণের ন্যায়। বাবা মানে বিশালতা। বাবাহীন জীবন ধূসর মরুর ঊষর বুক, শ্বাপদ সংকুল বনে দুরু দুরু হৃৎকম্পন। বাবাহীন জীবন ছোট্ট ডিঙ্গি নিয়ে উত্তাল সাগর পাড়ি দেয়ার দুঃসাহসিক চেষ্টার নাম।

আমার বাবার স্নেহচ্ছায়া আমাদের মাথার ওপর বটবৃক্ষের মতো। আদর-শাসন আর বিশ্বস্ততার জায়গা হলো আমার বাবা। সে তো বাবাই। আর বাবার তুলনা বাবা নিজেই।

যার কল্যাণে এই পৃথিবীর রূপ, রঙ ও আলোর দর্শন করেছি তিনি আমার শাশ্বত, চির আপন, চিরন্তন বাবা।

আমার বেঁচে থাকার আনন্দে, কষ্টের তীব্রতায়, কঠিন সমস্যায় বাবাই হয়ে থাকেন বিপদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বন্ধু বা সহায়।

বাবা মানে একটু শাসন, অনেক ভালোবাসা; বাবা মানে একটু কঠিন, মাথার ওপর ছায়া।

বাবা শুধু একজন মানুষ নন, স্র্র্রেফ একটি সম্পর্কের নাম নয়। এই ডাকের মধ্যেই জড়িয়ে থাকে পৃথিবীর সব আবেগ ও ভালোবাসা।

বাবার মাঝে জড়িয়ে আছে বিশালত্বের এক অদ্ভুত মায়াবি প্রকাশ। বাবা নামটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে শ্রদ্ধা কৃতজ্ঞতা আর ভালবাসার এক অনুভব জাগে। মানুষটি কতভাবে অবদান রেখে যান আমাদের জন্য! অথচ তার জন্য আমরা কিছুই করি না, করতে পারি না।

আজ ১৮ জুন ‘বিশ্ব বাবা দিবস’। যদিও বাবাকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে কোনো বিশেষ সময়ের প্রয়োজন হয় না, তবুও আজ বাবা দিবসে বিশ্বের সব বাবার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

আসুন এই ‘বাবা দিবসে’ আমারা সবাই বাবাকে বলি, ‘বাবা, খুব ভালোবাসি তোমাকে, যেভাবে পাশে আছো সেভাবেই থেকো চিরদিন’।

হয়তো অনেক সময় মুখ ফুটে বাবাকে ভালোবাসি কথাটা বলা যায় না, কিংবা বলা হয় না। কিন্তু কিছু ভালোবাসা আছে যা মুখে না বললেও মনে মনে সহস্রবার বলা হয়ে যায়। আর যাকে উদ্দেশ্য করে বলা তিনি ঠিকই তাঁর অন্তর দিয়ে তা শুনতে পান। বুঝতেও পারেন।

বিশ্বের প্রায় ৫২টি দেশে এ দিবসটি পালিত হয়। পিতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য দিনটি বিশেষভাবে উৎসর্গ করা হয়ে থাকে।

উইকিপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে,

ধারণা করা হয় ১৯০৮ সালের ৫ জুলাই প্রথম ‘বাবা দিবস’ পালিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জিনিয়ার ফেয়ারমন্টের এক গির্জায় প্রথম এ দিনটি পালিত হয়।

সনোরা স্মার্ট ডড নামে ওয়াশিংটনের এক নারীর মাথাতে বাবা দিবসের আইডিয়া আসে। ডড এই আইডিয়াটা পান গির্জার এক পুরোহিতের বক্তব্য থেকে। সেই পুরোহিত মাকে নিয়ে অনেক ভালো কথা বলছিলেন।

তার মনে হয়েছিল, বাবাদের নিয়ে কিছু করা দরকার। ডড তার বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগেই ১৯১০ সালের ১৯ জুন বাবা দিবস পালন করা শুরু করেন।

১৯১৩ সালে আমেরিকান সংসদে বাবা দিবসে ছুটি ঘোষণার জন্য একটি বিল উত্থাপন করা হয়। ১৯২৪ সালে সে সময়কার আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ক্যালভিন কুলিজ বিলটিতে পূর্ণ সমর্থন দেন। ১৯৬৬ সালে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন বাবা দিবসে ছুটি ঘোষণা করেন। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে জুন মাসের তৃতীয় রোববার বাবা দিবস হিসেবে পালিত হয়।

ব্যস্ততার সাগরে ডুবে থাকা নাগরিক জীবনে আমাদের সব আবেগ অনুভূতিই ইদানীং বড্ড বেশি যান্ত্রিক হয়ে পড়ছে। আমাদের আরো অনেক সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আমাদের বাবাদের আরো অনেক বেশি সময় দেয়া প্রয়োজন।

আজ আমার লিখাটি তাদের জন্য উৎসর্গ করলাম যাদের বাবা দূরতম গ্রহের বাসিন্দা। যারা শত অর্জনের মাঝেও নিশ্চিতভাবেই বঞ্চিত হন অমোঘ এক প্রাপ্তি থেকে। যেসব অগণিত ভাগ্য বিড়ম্বিতের বাবা না থাকার আক্ষেপ অন্তরের, জ্বালা চিরকালের।

বিশেষ করে যার জীবনে বাবা নামের কোন অস্থিত্বই ছিলোনা কোন কালে!

পৃথিবীতে জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়াছে!

তাঁরা হয়তো আকাশে তাকিয়ে অলক্ষ্যে বাবার স্মৃতি হাতড়ায়!

আজ তাদের আমার বাবাকে একবার হলেও বাবা ডাকার অধিকার দিলাম!

আমার বাবাকেই বলো তোমরা -“বাবা তোমায় অনেক ভালোবাসি, অনেক ভালোবাসি”!

– জয়নব ইসলাম

সহকারি শিক্ষক

আলীকদম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

আলীকদম, বান্দরবান পার্বত্য জেলা।

পাঠকের মতামত: