ঢাকা,রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

পুরুষের পৃথিবীতে বাস করার অভিজ্ঞতা

taslima-nasrin_1:::: তসলিমা নাসরিন ::::

ঋতুস্রাব যদি মেয়েদের না হয়ে ছেলেদের হতো? তাহলে যেভাবে মেয়েদের অসুস্থ, অপবিত্র, অশুচি বলা হয়, সেভাবে কি ছেলেদের বলা হতো? উত্তর খুব সোজা, হতো না। পুরুষের ঋতুস্রাব হলে ঋতুস্রাব লজ্জার ব্যাপার হতো না, গৌরবের আর উৎসবের ব্যাপার হতো। পুরুষের ঋতুস্রাব হলে আমার মনে হয় না নামাজ রোজা থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া হতো অথবা সামাজিক শুভকাজ থেকে তাদের সরিয়ে রাখা হতো। মেয়েদের ঋতুস্রাবকে ঘৃণা করা হয়, কারণ মেয়েদের ঘৃণা করা হয়। পুরুষের ঋতুস্রাবকে মূল্য দেবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, যেহেতু এই সমাজ পুরুষকে মূল্য দেয়। মেয়েদের যেহেতু ‘নীচুস্তরের মানুষ’ বলে ভাবা হয়, তাই মেয়েদের পোশাক আশাক, আচার আচরণ পুরুষ নিজের জন্য চায় না। পুরুষদের অপমানিত অথবা লাঞ্ছিত করতে চাইলে মেয়েদের কাপড় চোপড় আর গয়না গাটি পরিয়ে দেওয়া হয়। ওদিকে মেয়েরা পুরুষের কাপড় পরলে শহরে নগরে তাদের স্মার্ট মেয়ে বলা হয়। কী ভয়ঙ্কর আমাদের সমাজের লিঙ্গ বৈষম্য! কিন্তু এই বৈষম্য ঘোচানো সহজ নয়। বৈষম্যের কিড়েগুলো তো মানুষের মাথায়। কিড়ে যতদিন না মরবে, মাথা যতদিন কিড়েমুক্ত না হবে, ততদিন লিঙ্গ বৈষম্য বহাল তবিয়তে রয়ে যাবে।

আমেরিকার একজন নারীবাদী লেখিকা জানতে চেয়েছেন, পুরুষের লেখা মাস্টারপিসগুলো, যদি পুরুষের লেখা না হয়ে নারীর লেখা হতো? তাহলে কি ওগুলোকে মাস্টারপিস বলতো কেউ, নাকি নারীর লেখা বলে অবজ্ঞা পেয়ে পেয়ে, অবহেলা পেয়ে পেয়ে, হারিয়ে যেতো সব লেখা? যেমন হারিয়ে যায়, অন্ধকারে পড়ে থাকে, মেয়েদের লেখাগুলো? এটির উত্তরও আমরা জানি। ‘আনা কারেনিনা’ যদি লিও টলস্টয়ের লেখা না হয়ে কোনও রুশ নারীর লেখা হতো? ডল’স হাউস যদি হেনরিক ইবসেনের লেখা না হয়ে নরওয়ের কোনও নারীর লেখা হতো? শেকসপিয়রের লেখাগুলো যদি পুরুষের না হয়ে নারীর হতো, তবে লেখাগুলো এই মূল্য পেতো না, যে মূল্য এখন পাচ্ছে। ক্লাসিক্স হিসেবেও মর্যাদা পেতো না। পুরুষকে, পুরুষের চিন্তা ও শ্রমকে, নারী ও পুরুষ উভয়ে, মূল্য দিতে শিখেছে। এই মূল্যটা নারীর কোনও প্রতিভার জন্য নারী পায়নি। তসলিমা নাসরিন নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে নারীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সরব হলে তাঁর লেখা নিষিদ্ধ হয়ে যায়, আর হুমায়ুন আজাদ নারীবাদী লেখকদের লেখা টুকে গ্রন্থ লিখে, চরম পুরুষতান্ত্রিক হয়েও, ‘নারীবাদী’ নাম কামান। নিশ্চিতই পুরুষের তৈরি বিশাল এক বৈষম্যের জগতে বাস করা আমাদের জন্য চরম অপমানের।

প্রেম ভালোবাসায় ভরপুর চলচ্চিত্রের নাম দেওয়া হয়েছে ‘চিক ফ্লিক’। চিক ফ্লিক মানে মেয়েদের ছবি, মেয়েরা যেসব ছবি পছন্দ করে, সেসব। পাশ্চাত্যের অনেক বুদ্ধিজীবীকে গর্ব করে বলতে শুনেছি, ‘আমি চিক ফ্লিক দেখি না’। কী দেখেন তাঁরা? তাঁরা সম্ভবত যুদ্ধের ছবি দেখেন। যুদ্ধটা বেশ পেশিসর্বস্ব। পাল্প ফিকশান দেখেন। সায়েন্স ফিকশান দেখেন। আমি জানি না প্রেম ভালোবাসার ছবিগুলোকে কেন মেয়েদের ছবি বলা হয়! প্রেম ভালোবাসা আবেগ অভিমান কি পুরুষের নেই? নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সমস্যা হলো, ওগুলোকে লুকোতে চায় পুরুষেরা। আবেগ প্রকাশ করলে, দুঃখে কাঁদলে লোকে বলে, ‘ছিঃ ছিঃ মেয়েদের মতো কাঁদছো কেন’? পুরুষদের কাঁদতে নেই, পুরুষদের পাষাণ হতে হবে। পুরুষেরা পাষাণ হওয়ার, নিষ্ঠুর হওয়ার শিক্ষাটা ছোটবেলা থেকেই পেয়ে যায়। যেহেতু মেয়েদের মায়াবতী, লজ্জাবতী, মমতাময়ী, করুণাময়ী হিসেবে ধরা হয়, পুরুষেরা তাই মনে করে তাদের ঠিক উলটো হতে হবে। নির্লজ্জ হতে হবে, নিষ্ঠুর হতে হবে, নির্মম হতে হবে, বর্বর হতে হবে। আর যা কিছুই হোক তারা, কোনোভাবেই মেয়েদের মতো হওয়া চলবে না। মেয়েদের মতো হওয়াকে তারা অসম্মানজনক মনে করে। পুরুষের মতো পুরুষ হতে হলে মানবিক গুণাবলি বিসর্জন দিতে হয়, এর চেয়ে দুঃখজনক শিক্ষা আর কী হতে পারে! মুশকিল হলো, মানবিক গুণাবলিগুলোকে ক্ষমতাহীনদের জিনিস বলে বিশ্বাস করা হয়। ক্ষমতাবানরা তাই মানবিকতা থেকে দূরে থাকেন। গোটা জীবনে, আমার মনে পড়ে না, আমি কোনও পুরুষকে কাঁদতে দেখেছি। বাংলাদেশে সেই কতকাল থেকে নারী রাজত্ব চলছে। তারপরও নারী যে কাতারে ছিল, সে কাতারেই পড়ে আছে, ক্ষমতাহীনদের কাতারে। নারীরা ডাক্তার হচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে, আরও কত বড় বড় কিছু হচ্ছে এখনো তাদের কিন্তু ডাকা হয় মহিলা ডাক্তার, মহিলা ইঞ্জিনিয়ার, মহিলা অ্যাডভোকেট, মহিলা বিচারক, মহিলা শিল্পী বলে। ক্ষমতাহীনদের বেলায় বিশেষণের প্রয়োজন পড়ে। ক্ষমতাবানদের বেলায় বিশেষণের প্রয়োজন পড়ে না বলেই আমরা পুরুষ ডাক্তার, পুরুষ অ্যাডভোকেট, পুরুষ বিচারক, পুরুষ পুলিশ বলি না। আমার অবশ্য খুব ইচ্ছে করে ওদের পুরুষ কিছু একটা বলে ডাকতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইচ্ছেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিই দূরে। ক্ষমতাবানদের ক্ষমতাচ্যুত করা সহজ নয়।

বলছিলাম ঋতুস্রাবের কথা। ঋতুস্রাব হলে মেয়েদের দুর্বল বলে ভাবা উচিত নয়। ঋতুস্রাব কোনও অসুখ নয়। এটি শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার মতো স্বাভাবিক। ধর্মাচার থেকে যাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়, তারা রোগী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করানো মা— এমন। এই কাতারে ঋতুস্রাব হতে থাকা মেয়েদের ঢোকানো হয় কেন? রোগী না হয়েও, বৃদ্ধা না হয়েও ওদের কেন চিহ্নিত হতে হবে দুর্বল বা অক্ষম হিসেবে? এক সময় শারীরবিজ্ঞান সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান যখন কম ছিল, তখন ঋতুস্রাবকে খুব নোংরা কদর্য ঘটনা বলে ভাবা হতো, ঋতুস্রাব হওয়া মেয়েদের দুর্বল আর অক্ষম বলে ভাবা হতো।

এখন তো সেই সমস্যা নেই। এখনো কেন ঋতুস্রাব হলে মেয়েদের অপবিত্র এবং অক্ষম ভাবা হয়? হিন্দু ধর্মের মনু সংহিতায় (৪৪১) আছে, ‘যেদিন প্রথম রজঃদর্শন হবে সেদিন থেকে তিন রাত্রি পর্যন্ত রমণী সবকিছু পরিত্যাগ করে ঘরের মধ্যে সর্বদা আবদ্ধ থাকবে। যাতে অন্য কেউ তাকে না দেখতে পায়। স্নান করবে না, অলংকার পরবে না। এক বস্ত্র পরিধান করবে। দীনাভাবে মুখ নিচু করে বসে থাকবে। কারো সাথে কোনও কথা বলবে না। নিজের হাত, পা ও চোখ থাকবে স্থির। দিনের শেষে মাটির হাঁড়িতে তৈরি করা ভাত সে খাবে এবং ভূমিতে সাধারণভাবে শয্যা করে নিদ্রা যাবে। ’ এ ছাড়া মনু সংহিতায় আছে : ‘রজঃস্বলা নারীতে যে পুরুষ সঙ্গত হয় তার বুদ্ধি, তেজ, বল, আয়ু ও চক্ষু ক্ষয় পায়। ’ বাইবেল (লেবীয় পুস্তক : ১৫) বলছে : ‘যে স্ত্রী রজঃস্বলা হয় সে সাত দিন অশৌচ থাকবে, যে তাকে স্পর্শ করে সেও সন্ধ্যা পর্যন্ত অশুচি থাকবে এবং অশৌচ কালে যে পুরুষ তার সাথে শোয় ও তার রজঃ যদি পুরুষটির গায়ে লাগে, সে পুরুষও সাত দিন অশুচি থাকবে। ’

মানুষের জন্য ধর্ম এসেছে, ধর্মের জন্য মানুষ আসেনি। ঋতুস্রাবকে নোংরা বলা, খারাপ বলা, অসুস্থ বলা এই বিজ্ঞানের যুগে আর উচিত নয়। স্রাব হয়েছে বলে তাকে ধর্মীয় আর সামাজিক অনুষ্ঠানাদি থেকে সরিয়ে দেওয়ারও কোনও যুক্তিসংগত কারণ নেই। যুক্তিবুদ্ধির মানুষেরা এবার কিছু কথা বলুন। মুখ বুজে থাকলে সমাজ বদলায় না।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।

পাঠকের মতামত: