ঢাকা,বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪

নকল ওষুধ আনছে তিন সিন্ডিকেট, ডিলার একজন

অনলাইন ডেস্ক ::

চীনে গিয়ে লাগেজের মাধ্যমে নকল ওষুধ নিয়ে আসছে কমপক্ষে ১২ ব্যবসায়ী। একই পদ্ধতিতে ওষুধ আনছে কোরিয়া ও মিসর থেকেও। এমনকি কনটেইনারের মাধ্যমে পণ্য আমদানির মিথ্যা ঘোষণা দিয়েও নকল ওষুধ আনছে ওই ব্যবসায়ীরা। আনা হচ্ছে ক্যান্সারের নকল ওষুধও।

নকল ওষুধের ব্যবসায়ে জড়িত পাঁচজন গ্রেপ্তার হওয়ার পর চারজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ তথ্য জানিয়েছে। তাদের জবানবন্দি ও এ ঘটনার তদন্তের দায়িত্বে থাকা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্রে আরো জানা গেছে, ১০ বছর ধরে করা নকল ওষুধের ওই ব্যবসায়ে তিন সিন্ডিকেট জড়িত। তবে ডিলার মূলত একজনই। মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকার পবিত্র কুমার দাস সেই ডিলার। বিদেশ থেকে নকল ওষুধ এনে তাঁর কাছেই বিক্রি করে দিত সিন্ডিকেটের অন্যরা। পবিত্র কুমারই পরে সারা দেশে সরবরাহ করতেন।

সম্প্রতি সিআইডি দুই দফায় অভিযান চালিয়ে ওই পাঁচ ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে। তাদের সবাইকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে এবং চারজন ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।

সিআইডির সূত্রে জানা গেছে, গ্রেপ্তারকৃতরা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছে, তিনটি পর্যায়ের তিন সিন্ডিকেট বিদেশ থেকে আনা নকল ওষুধের এই ব্যবসা করছে। প্রথম পর্যায়ের কয়েকজন অবৈধভাবে এসব নকল ওষুধ নিয়ে আসে। দ্বিতীয় পর্যায়ের সিন্ডিকেট মজুদ করে পাইকারি বিক্রি করছে। আর সারা দেশে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে শেষ পর্যায়ের সিন্ডিকেট।

সিআইডির কর্মকর্তারা বলেন, গ্রেপ্তারকৃত পাঁচজন প্রথম পর্যায়ের। দ্বিতীয় পর্যায়ে কাজ করছে এক ব্যক্তি, যে ঢাকায় সব নকল ওষুধ মজুদ করে। ওই ব্যক্তিকে ধরতে অভিযান চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে সিআইডির দল। তাঁরা আরো বলেন, মিটফোর্ডকেন্দ্রিক নজরদারি বাড়ার কারণে ঢাকায় মজুদ করে জেলা শহরে বিক্রি করা হচ্ছে নকল ওষুধ। সরবরাহকারীকে ধরতে পারলে অন্য ব্যবসায়ীদেরও ধরা যাবে বলে মনে করছেন সিআইডির কর্মকর্তারা।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএস) মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য রোগের ওষুধের নামে নকল ওষুধ বাজারে ছড়াচ্ছে কিছু লোক। কয়েকজনকে ধরার পর অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। এই অপকর্মে যারা জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।

সূত্র জানায়, গত ২৮ ডিসেম্বর রাজধানীর তাঁতীবাজার ও শান্তিনগরে গুদামে মজুদ করা ২১ হাজার পাতায় প্রায় কোটি টাকার নকল ওষুধ জব্দ করে সিআইডি। গ্রেপ্তার করা হয় নিখিল কুমার রাজবংশী, রুহুল আমিন দুলাল চৌধুরী ও সাইদ নামে তিনজনকে। গত ২৯ ডিসেম্বরই আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন নিখিল। সাইদ ও দুলালকে আদালতের নির্দেশে দুই দিনের রিমান্ডে নেয় সিআইডি। ১ জানুয়ারি রিমান্ড শেষে দুলাল স্বীকারোক্তি দিলেও সাইদ দেননি।

এদিকে তিনজনের কাছে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার খিলগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে এক হাজার পাতা ওষুধসহ জাহাঙ্গীর আলম ও তারেক আব্দুল্লাহ নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আদালতের নির্দেশে তাঁদের দুই দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন তদন্তকারীরা। রিমান্ড চলাকালে জাহাঙ্গীর শুক্রবার এবং তারেক শনিবার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন।

সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘জবানবন্দিতে আসামিরা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। তারা এক সিন্ডিকেটের সদস্য নয়। তবে সবাই চীন ও মিসর থেকে ওষুধ এনে ঢাকার এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে। ওই ব্যক্তি গোপন স্থানে মজুদ করে বিক্রি করছে। তাকে ধরতে পারলে চেইন পাওয়া যাবে।’

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘তিনটি পর্যায়ে বা ধাপে বিদেশি নকল বা অবৈধ ওষুধের ব্যবসা হচ্ছে। ঢাকায় রেখে রাঙামাটিতে বিক্রিরও তথ্য পাওয়া গেছে। আমরা এখন প্রথম পর্যায়ের তদন্ত করছি।’

সিআইডির সূত্রে জানা গেছে, নকল ওষুধের ব্যবসায়ী দুলাল মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের ভাগ্যকুল এলাকার মৃত পান্নু চৌধুরীর ছেলে। দুলাল একজন জুয়াড়ি। এখন নিজ গ্রামে দানশীল পরিচিতি পেয়েছেন তিনি। দুলাল আগে বৈধভাবেই ওষুধের ব্যবসা করতেন। জুয়ার নেশায় পড়ে তিনি যখন তাঁর সব কিছু হারাতে বসেছিলেন, ঠিক তখনই পরিচয় হয় আরেক জুয়াড়ি সাইদের সঙ্গে। সাইদ আগে থেকেই নকল ওষুধ আনতেন বিদেশ থেকে। তাঁর পরামর্শে নকল ওষুধের ব্যবসায় নামেন দুলাল। ক্যান্সারেরও নকল ওষুধ আনতেন সাইদ। একপর্যায়ে দুুলালও আলাদা নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। মূলত এই চক্র চীন, কোরিয়া ও মিসরের তৈরি দামি বিভিন্ন ওষুধ সেসব দেশের চক্র ব্যবহার করে নকল করিয়ে কম দামে আনে।

দুলাল ৮-১০ বছর আগে শুরু করেন নকল ওষুধের ব্যবসা। এই কয়েক বছরেই তিনি শতকোটি টাকা আয় করেছেন। তবে জুয়া খেলার কারণে সে টাকা ধরে রাখতে পারেননি। তাঁর কাজ ছিল ওষুধগুলো গ্রহণ করে মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় পবিত্র কুমার দাসসহ কয়েকজনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া। এ জন্য ছিল তাঁর একটি গুদামও। সহযোগী নিখিল রাজবংশীর কাছ থেকে সেই গুদামটি ভাড়া নেন। বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস পণ্যের নাম করে নকল ওষুধগুলো কনটেইনারে করে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর হয়ে ঢাকায় আনা হতো। আর এ কাজে তাদের সহায়তা করতেন কাস্টমসের কিছু অসাধু সদস্য।

দুলাল জবানবন্দিতে আরো জানিয়েছেন, ঢাকায় তাঁর কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। গ্রামে কিনেছেন প্রায় শত বিঘা জমিও। তিনি গ্রামে সবচেয়ে নান্দনিক বাড়ি করেছেন। দুলালের ব্যাংক হিসাব ও সম্পত্তির পরিমাণ জানার জন্য এখনো তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানায় সিআইডির সূত্র।

জবানবন্দিতে সাইদ জানিয়েছেন, তিনি একসময় বৈধ ওষুধ ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর মাথায় বুদ্ধি আসে, বিদেশ থেকে নকল ওষুধ অর্ডারে আনা যায়। এ জন্য সাইদ চীনসহ অন্যান্য দেশে যাওয়া শুরু করেন। কখনো ফোনে আবার কখনো ই-মেইলে অর্ডার দিতেন এই নকল ওষুধের জন্য। চীনের নকল ওষুধ তৈরির চক্র তাঁর কথামতো পণ্য তৈরি করে কনটেইনারে পাঠাত। তবে বেশির ভাগ সময় লাগেজে করে নিয়ে আসতেন।

সিআইডির সূত্র জানায়, একসময় শেয়ারবাজারে আড়াই কোটি টাকা লোকসান হয় সাইদের। এরপর পুরোপুরি নকল ওষুধের ব্যবসায়ী হন। সাইদই বাংলাদেশে প্রথম নকল ওষুধের ব্যবসায়ী। সাইদের দৃশ্যমান কোনো আয় না থাকলেও নকল ওষুধের টাকায় চলত তাঁর সংসার। তবে এ ব্যবসা করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় বিমানবন্দরে তাঁর নকল ওষুধের চালান ধরাও পড়ে। সাইদ নিজেকে সাংবাদিক বলেও পরিচয় দেন।

নিখিল রাজবংশী ছিলেন দুলালের সহকর্মী। তিনি দুলালকে তাঁর বাসাটি গুদাম হিসেবে ব্যবহারের জন্য ভাড়া দেন। সেখানেই দুলাল বিদেশ থেকে আনা নকল ওষুধগুলো রাখতেন। তবে রাজবংশীও জানতেন দুলাল নকল ওষুধের ব্যবসা করেন।

সিআইডির সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃত জাহাঙ্গীরের পণ্য আমদানির ট্রেডিং ব্যবসা আছে। কনটেইনারে পণ্য আনার নামে নকল ওষুধ নিয়ে আসতেন তিনি। সম্প্রতি ১১ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে ৩০ লাখ টাকা আয়ের জন্য চালান আনেন তিনি।

সূত্র আরো জানায়, চীনে আসল ওষুধ থেকে কিছু রাসায়নিক মিশিয়ে নকল ওষুধ বানানো হয়। ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য রোগের এসব ওষুধের বাজারমূল্য বেশি। তাই এ ওষুধ নকল করে চলছে প্রতারণা।

তারেক আব্দুল্লাহ জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, তিনি কখনোই বিদেশে যাননি। তাঁর দুই ভাই থাকেন মিসরে। তাঁরাই বিদেশ থেকে নকল ওষুধ পাঠান। অন্য লোকের মাধ্যমেও লাগেজে ওষুধ আসে। ওই চালানে আসল ওষুধের সঙ্গে ভেজাল ও নকল ওষুধ আনা হতো।

সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহমুদুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘পাঁচ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি।’কালের কণ্ঠ

পাঠকের মতামত: