ঢাকা,শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

আজ রবিবার আন্তর্জাতিক বন দিবস

ধ্বংসপ্রাপ্ত বনজ সম্পদের পুনর্বাসনের বিকল্প নেই

প্রফেসর ড. মো. দানেশ মিয়া ::
জলবায়ু পরিবর্তন আজকে পৃথিবীর সর্বত্র দুশ্চিন্তায় পরিণত হয়েছে। জলবায়ুর এই পরিবর্তনটি প্রাকৃতিক বিবর্তনের মাধ্যমে হয়নি বরং মানুষেরই তৈরি বলে আমাদের একটু আশার আলোও আছে। মানুষের যে যে কার্যকলাপের জন্য এই পরিবর্তন ধেয়ে আসছে, সে কার্যকলাপের পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা নিশ্চয়ই জলবায়ুর পরিবর্তন ঠেকাতে পারবো।

জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য দায়ী মানুষের কার্যকলাপের মধ্যে নির্বিচারে বনজ সম্পদ ধ্বংস উল্লেখযোগ্য। এটি এই পরিবর্তনের জন্য প্রায় এক চতুর্থাংশ দায়ী। বনের এই ধ্বংসযজ্ঞ যদি আমরা থামাতে পারি এবং বনকে মোটামুটি আগের একটা ভাল অবস্থানে যদি পূনর্বাসন করতে পারি, তাহলে আমরা কমপক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের এক-চতুর্থাংশ থামাতে পারবো। তাছাড়া এর উন্নত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনকে আরো বর্ধিতাংশে ঠেকানো সম্ভব হবে। মানতেই হবে, ধ্বংসপ্রাপ্ত বনজ সম্পদকে পূনর্বাসন করার কোন বিকল্প নেই। আর এ কাজটি করার জন্য এ বিষয়ক রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা সৃষ্টিরও কোন বিকল্প নেই।

পৃথিবীর যেকোন অঞ্চলের বনজ ইকোসিষ্টেমের উপযোগিতার অর্থনৈতিক আধুনিক হিসেবে দেখা যায়, একটি অঞ্চলের বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক যে লাভ পাওয়া যায়, সে বনকে সংরক্ষণ করলে পানি সংরক্ষণ, মাটি সংরক্ষণ, কার্বন সংবন্ধন, অক্সিজেন প্রবাহ, জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, বনভিত্তিক পর্যটন সহ পরিবেশের বিভিন্ন বিশুদ্ধতা রক্ষার মাধ্যমে সে অঞ্চলের জন্য যে অর্থনৈতিক লাভ পাওয়া যায়, তা হাজার লক্ষ গুণে বেশী। তাহলে আমাদের বনকে সংরক্ষণ করাইতো সমীচিন।

পৃথিবীর অনেক দেশেই বন সংরক্ষণের এই সূক্ষ লাভজনক হিসেব বেশ কয়েক দশক আগে থেকেই স্পষ্ট হয়েছে এবং এজন্য তারা যথাযথ ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে। এশিয়াতে দক্ষিণ কোরিয়া এমন একটি দেশ যেখানে ৫০ বছর আগে কোরিয়ান যুদ্ধে প্রায় সব বন ধ্বংস হয়ে যায়। ৬০’র দশকের প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট পার্ক চুং হি- এর নেতৃত্বে ও অনুপ্রেরণায় কোরিয়ান সরকার বড় ধরনের বন পূনঃ সৃজনের কর্মসূচি হাতে নেয়।

গ্রামীণ সমবায় গঠনের মাধ্যমে হাজার হাজার লোক বিরান হ্ওয়া পাহাড়গুলোতে গাছ লাগানো শুরু করে। বর্তমানে সেখানে প্রায় ৬৫% জায়গা বনে আবৃত, যা প্রায় ৬ মিলিয়ন হেক্টরের সমান। নতুন করে গাছ লাগানোর জন্য এখন সেখানে কোন জায়গা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দক্ষিণ কোরিয়াতে বন সংরক্ষণের উপযোগিতা এত বড় করে দেখা হয় যে, দেশটিতে ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে কাঠজাত দ্রব্যের বিকল্প উদ্ভাবনে পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম। যার ফলশ্রুতিতে সেখানে বনের উপড় চাপ কমেছে। বনের উপড় নির্ভরশীল লোকদের বিকল্প জীবিকা উদ্ভাবনেও দক্ষিণ কোরিয়া ব্যাপকভাবে সফল হয়েছে।

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের মধ্যে পরিবর্তিত মাত্রার বৃষ্টিপাত এবং অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর সুষ্পষ্টভাবে প্রভাব ফেলছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বন্যা ও ব্যাপক ভূমিধ্বস তারই প্রমাণ। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা দেখতে পেয়েছি, অনেক অঞ্চলে ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানির স্তর বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে অস্বাভাবিক ভাবে নীচে চলে যাচ্ছে। এতে অনেক জায়গায় মরুকরনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে এবং কৃষি উৎপাদনের জন্য সেচ বাবদ খরচ অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েছে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতি আমরা বাংলাদেশের বেশ কিছু অঞ্চলে ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানি। আর এটি কিন্তু হয়েছে ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানির বার্ষিক মোট পরিমান হ্রাস পাওয়ায় আর্সেনিকের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে।

বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বেশকিছু জায়গায় ভূ-অভ্যন্তরের পানিতে ক্রমবর্ধমান হারে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর মূল কারণও কিন্তু ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানির বার্ষিক মোট পরিমান কমে যাওয়া। এতে ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানির স্তরের সমতা রক্ষার জন্য সমুদ্রের লবণাক্ত পানি ভূমির অভ্যন্তর দিয়ে প্রবেশ করছে। এতে প্রচলিত কৃষি উৎপাদন ও খাবার পানি সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের এই যে সংবেদনশীলতা, তা সহনীয় পর্যায়ে রাখার জন্য বনজ ইকোসিষ্টেমের কোন বিকল্প নেই। একটি সুস্থ্য বনজ ইকোসিষ্টেম বৃষ্টিপাতের পানি সংরক্ষন করে সারা বছর ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানির পরিমান ও তার গুণাগুণকে বজায় রাখে। আর এর মাধ্যমে আমাদের সভ্যতা টিকে থাকার জন্য বেশ অনেকখানি চালিকা শক্তি অর্জন করে।

জলবায়ু পরিবর্তন এবং বন ধ্বংসের এমন একটি পর্যায়ে এসে আমরা উপনীত হয়েছি, যেখানে আমাদের নিস্ক্রিয় হয়ে বসে থাকার কোন সুযোগ নেই। যদি আমাদের সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে হয়, তাহলে বনজ ইকোসিষ্টেমকে পূনর্বাসন করতেই হবে পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর অন্যান্য ব্যবস্থাপনাও নিতে হবে। আর এজন্য চাই সুষ্ঠু রাজনীতি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সুষ্ঠু রাজনীতিই উপযুক্ত রাষ্ট্রনীতি তৈরি করতে পারে। এজন্য রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা খুব জরুরী।

লেখক: প্রফেসর, ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পাঠকের মতামত: