ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়ায় গোঁয়ারফাঁড়ি খালে বাঁধ

‘জাপানি ভালোবাসা’ ১৫ একর প্যারাবন কাটার প্রস্তুতি!

নিজস্ব প্রতিবেদক. চকরিয়া :: কক্সবাজারের চকরিয়া সুন্দরবন এলাকায় প্যারাবন কেটে চিংড়িঘের তৈরির প্রক্রিয়া চালাচ্ছে প্রভাবশালী একটি মহল। সমুদ্র উপকূলের এই সুন্দরবনে জেগে ওঠা চরের প্রায় ১৫ একর জায়গায় কেওড়া, গেওয়া, বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির রোপিত প্যারাবন কেটে ঘের তৈরির তোড়জোড় চলছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ইতোমধ্যে সুন্দরবনের প্রবহমান গোঁয়ারফাঁড়ি শাখা খালে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। একইসাথে বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে প্যারাবনের চতুর্দিকে। বাঁধ তৈরির কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে অর্ধশত শ্রমিককে। চতুর্দিকে বাঁধ দেওয়ার কাজ শেষ হলে যে কোনো মুহূর্তে প্রায় ১৫ একর জায়গার এই প্যারাবন কাটা বা উজাড় হওয়ার আশঙ্কা করছেন সচেতন লোকজন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চকরিয়ার পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের ডেবডেবী, ফুলতলা ও বদরখালী ইউনিয়নের সাতডালিয়া পাড়ার ওপর দিয়ে গেছে গোঁয়ারফাঁড়ি শাখা খাল। সমুদ্র উপকূলের এই শাখা খালের লবণাক্ত পানি ব্যবহার করে প্রায় তিন হাজার একর চিংড়ি জমিতে চিংড়ি উৎপাদন ও শুষ্ক মৌসুমে লবণ চাষ করে আসছেন অসংখ্য ঘের মালিক। কিন্তু এই শাখা খালে বাঁধ তৈরি করে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ব্যক্তি মালিকানাধীন ও সরকারিভাবে লিজপ্রাপ্ত চিংড়িঘের মালিকদের মধ্যে। উপকূলে বসবাসকারী বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে ও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল কক্সবাজার উপকূলে। সেই ঝড়ে রাতের মধ্যেই বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছিল উপকূলীয় এলাকা। অন্তত ২০ হাজার মানুষ প্রাণ হারানোর পাশাপাশি লাখো গবাদি পশু মারা পড়েছিল সেই ঘূর্ণিঝড়ে। এরপর উপকূলের মানুষের জীবন রক্ষায় ওআইএসসিএ নামক জাপানভিত্তিক এনজিও সংস্থা সেই দেশের পরিবেশবাদী শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রতি বছর চকরিয়া সুন্দরবনের জেগে ওঠা চরে প্যারাবন সৃজন কার্যক্রম শুরু করে। ২০১২ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। পরে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হওয়ায় জাপানের পরিবেশবাদী শিক্ষার্থীরা আর আসেননি।

ওআইএসসিএ চকরিয়ার আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক হামিদুল হক মানিক বলেন, বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া চকরিয়া সুন্দরবনের জেগে ওঠা চরে ১৯৯১ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রায় ২২ লাখ গাছ রোপণ করা হয়। কিন্তু প্রভাবশালী দুর্বৃত্তরা অবৈধভাবে চিংড়িঘের তৈরি করতে জাপানিদের রোপিত সেই প্যারাবন মাঝে-মধ্যে কেটে ফেলে। এ নিয়ে কয়েকটি মামলাও করা হয়েছে দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে। তারপরও প্যারাবন উজাড়ের মতো ঘটনা ঘটছে।

বৈধ চিংড়িঘের মালিকেরা জানান, বাঁধের কারণে কয়েক কিলোমিটারের শাখা খালটিতে পানি চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়ায় অকেজো হয়ে পড়বে সমুদ্র উপকূলের অন্তত পাঁচটি স্লুইস গেট বা জলকপাট। এতে লবণাক্ত পানির অভাবে তিন হাজার একরের বৈধ ঘেরে চিংড়ি ও লবণ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। তাই গোঁয়ারফাঁড়ি শাখা খালে দেওয়া মাটির বাঁধ অপসারণ করা জরুরি।

ভুক্তভোগী চিংড়িঘের মালিক পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের দরবেশকাটা পূর্বপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ এহেছান বলেন, চকরিয়া সুন্দরবনে অন্তত দুই শতাধিক ছোট-বড় শাখা-প্রশাখা খাল রয়েছে। জোয়ার-ভাটার নিয়ন্ত্রিত এসব খাল দিয়ে নৌ-যানও চলাচল করে। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে উৎপাদিত লবণ গোঁয়ারফাঁড়িসহ এসব খাল দিয়ে পরিবহন হয়। এই অবস্থায় খালটিতে বাঁধ তৈরি করায় সবকিছুতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে।

গোঁয়ারফাঁড়ি খালে বাঁধ তৈরি করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা। তিনি বলেন, খালে মাটির বাঁধ দিয়ে পানি চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একই সাথে বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে প্রায় ১৫ একর জায়গায় সৃজিত প্যারাবনের চতুর্দিকে। বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হলে উজাড় করা হবে বিভিন্ন প্রজাতির রোপিত প্যারাবন। এছাড়া পানি চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অকেজো হয়ে পড়বে অন্তত পাঁচটি স্লুইস গেট।

গোঁয়ারফাঁড়ি খালে বাঁধ দেওয়ায় চিংড়িঘের মালিক মোহাম্মদ এহেছান চকরিয়া থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। সেই অভিযোগে পরিবেশ বিধ্বংসী এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে উপজেলার বদরখালী ইউনিয়নের ২ নং ব্লকের নতুনঘোনার মৃত আমির হোসেনের ছেলে নুরুন্নবী ও তার লোকজনকে। ভুক্তভোগী চিংড়িচাষিরা অভিযোগ করেছেন, খালে বাঁধ দেওয়ার সময় বাধা দেওয়া হয়। এ সময় নুরুন্নবী ও তার লোকজন চিংড়িঘের মালিকদের নানা হুমকি দেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপকূলের ঘের মালিকেরা অভিযোগ করেছেন, অভিযুক্ত নুরুন্নবীর বিরুদ্ধে ইতোপূর্বে সমুদ্র উপকূলীয় চকরিয়া ও মহেশখালী চ্যানেলের প্যারাবন উজাড়, জলদস্যুতাসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে নুরুন্নবী বলেন, আমি খাল দখল করে মাটির বাঁধ দেওয়ার কাজে জড়িত নই। আমার বিরুদ্ধে থানায় কেউ অভিযোগ করেছে কিনা জানা নেই। তবে তিনি স্বীকার করেন, গোঁয়ারফাঁড়ি খালে বাঁধ দেওয়ার কারণে বেশ কয়েকটি স্লুইস গেট অকেজো হয়ে বিপুল পরিমাণ জমিতে চিংড়ি ও লবণ উৎপাদন ব্যাহত হবে। তাহলে এই বাঁধ কে তৈরি করেছেন? এমন প্রশ্নে নুরুন্নবী বলেন, যারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন তারাই এই কাজ করতে পারেন। আমি কোনো খারাপ কাজের সাথে সম্পৃক্ত নই।

অভিযোগের বিষয়ে চকরিয়া থানার ওসি মুহাম্মদ ওসমান গনি বলেন, বদরখালীর নুরুন্নবীসহ তার লোকজনের বিরুদ্ধে খালে বাঁধ দেওয়ার অভিযোগ পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়। এ সময় বাঁধ তৈরির কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পুরো ঘটনা তদন্ত করে পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেপি দেওয়ান বলেন, প্রবহমান খালে মাটির বাঁধ তৈরি করা সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ। তাছাড়া প্যারাবন নিধনের অপচেষ্টাও রোধ করা হবে। এসব কাজ যারা করবে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সরেজমিনে বিষয়টি দেখে আসার জন্য উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাহাত উজ-জামানকে পাঠানো হবে। কোনোভাবেই পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন হতে দেওয়া হবে না।

পাঠকের মতামত: