ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

উজাড় হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ

চকরিয়া উপকুলে চোরাই গর্জন গাছ দিয়ে অবৈধভাবে ফিশিং ট্রলার তৈরির হিড়িক

এম জিয়াবুল হক, চকরিয়া :: কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় জনপদের একাধিক পয়েন্টে চলছে সরকারি অনুমোদন বিহীন অবৈধ ফিশিং ট্রলার তৈরির হিড়িক। গত তিনমাস ধরে উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলের বদরখালী ফেরিঘাট, সাহারবিলের চোয়ারফাড়ি ও বেতুয়াবাজার সেতু এলাকায় মাতামুহুরি নদীর মোহনায় সংরক্ষিত বনের চোরাই গর্জন গাছ দিয়ে অবৈধ ফিশিং ট্রলার তৈরির প্রতিযোগিতা চললেও বনবিভাগের লোকজন পালন করছেন রহস্যজনক ভূমিকা। অভিযোগ উঠেছে, বনবিভাগের নীরব ভুমিকার কারণে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে কাঠপাচারকারী চক্র। তারা এসব অবৈধ ফিশিং ট্রলার তৈরীতে কাঠের যোগান দিতে গিয়ে দিনদিন উজাড় করছে কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগ ও লামা বনবিভাগের গর্জন সমৃদ্ধ বিশাল বনসম্পদ।

সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান শুষ্ক মৌসুমে চকরিয়া উপজেলার উপকূলের নৌ-চ্যানেল জুড়ে অবৈধভাবে ফিশিং ট্রলার তৈরির হিড়িক পড়েছে। পাশাপাশি গেল কয়েকবছর ধরে মাতামুহুরী নদীর মোহনা লাগোয়া এসব স্পটে কয়েকটি সিন্ডিকেট মিলেমিশে সরকারি বনাঞ্চল থেকে গর্জনসহ বিভিন্ন প্রকার গাছ কাঠ কেটে অবৈধ ফিশিং বোট তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। চকরিয়া উপকুলের তিনটি স্পটের মধ্যে সাহারবিলের চোয়ারফাড়ি এলাকাতে প্রতিবছর বেশি তৈরি করা হচ্ছে অনুমোদন বিহীন ফিশিং ট্রলার।

পরিবেশ সচেতন মহলের অভিযোগ, এভাবে চলতে থাকলে অচিরে কক্সবাজার ও চকরিয়া উপজেলার বেশিরভাগ বনাঞ্চল বৃক্ষ শূন্য হয়ে বিরান ভূমিতে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।

অভিযোগ উঠেছে, চট্টগ্রাম উপকূলীয় বনবিভাগ ও চকরিয়ার সুন্দরবন রেঞ্জে কর্মরত কতিপয় লোকজনকে ম্যানেজ করে অসাধু কাঠ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দীর্ঘ দিন ধরে ফিশিং ট্রলার তৈরির ব্যবসা চালাচ্ছেন। একটি ফিশিং ট্রলার তৈরি শেষে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেওয়া হয়। সারা বছরই এসব নদীর উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে নদীর তীরে বন বিভাগের অনুমতি ব্যতীত অবৈধ ফিশিং ট্রলার তৈরির রমরমা বাণিজ্য চললেও তা বন্ধে স্থানীয় বন বিভাগ ও প্রশাসন কোন আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছেনা।

সরেজমিনে দেখা যায়, বর্তমানে চকরিয়া উপজেলার বদরখালী সেতুর উত্তর পাশে চারটি, চকরিয়া উপজেলার সাহারবিলের চৌঁয়ার ফাড়ি বাজার সংলগ্ন নদীর তীরবর্তী স্থানে ৫টি ও বেতুয়াবাজারস্থ সেতু এলাকায় দুটি বড় ফিশিং ট্রলার তৈরির কাজ চলছে।

ফিশিং ট্রলার নির্মাণকাজে নিয়োজিত শ্রমিকেরা জানিয়েছেন, বনাঞ্চল থেকে গর্জনসহ বড় আকারের বিভিন্ন গাছ কেটে সড়ক পথের পাশাপাশি নৌপথে আনা হয়। পাচারকারীদের সঙ্গে বনবিভাগের লোকজনের যোগসাজশ থাকায় বনাঞ্চল থেকে কাটা এবং পাচারে কেউ বাঁধা দেয়না তাঁদের।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, আমরা টাকা দিয়ে গাছ ক্রয় করি। বনাঞ্চল থেকে তো আমরা চুরি করিনা। তাদের দাবি, পাচারকারী কাঠচোর চক্র এসব গাছ সড়ক ও নদী পথে মোকামে পৌঁছে দেয়। তার আগে কাঠচোর চক্রের লোকজন বন বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সঙ্গে বুঝাপড়া করে।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, চকরিয়া উপকূলের বিভিন্ন পয়েন্টে বর্তমানে নির্মাণাধীন ফিশিং ট্রলার গুলোর কোন ধরনের সরকারি অনুমোদন নেই। মুলত বনবিভাগের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ফিশিং বোট মালিকরা গোপনে নির্মাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

জানতে চাইলে ফিশিং ট্রলার তৈরির আগে স্থানীয় বনবিভাগ থেকে অনুমোদন নিতে হয় বলে স্বীকার করেছেন চকরিয়া উপজেলার সাহারবিলের চোয়ারফাড়ি পয়েন্টের বোট ব্যবসায়ী আক্কাস সওদাগর। তিনি বলেন, প্রতিবার বোট তৈরির আগে বনবিভাগ থেকে অনুমোদন নিই। তবে দুইমাস আগে তৈরি করা ফিশিং ট্রলারের অনুমোদন নিইনি, সেবার রেঞ্জ অফিসার রুহুল আমিনকে ৩০ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। এখন নতুন বোট তৈরি করেছি, সেটির জন্য অনুমোদন নেব।

বোট ব্যবসায়ী আক্কাস সওদাগরের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন চকরিয়া সুন্দরবন রেঞ্জ কর্মকর্তা রুহুল আমিন। তিনি বলেন, আক্কাস সওদাগর বোট তৈরির আগে বনবিভাগ থেকে অনুমোদন নেয়নি, চুরি করে বোট তৈরি করে বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন নিজের অপরাধ ঢাকার জন্য আমাকে জড়ানো হচ্ছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে চকরিয়া উপকুলে যেসব ফিশিং বোট তৈরি করা হচ্ছে, তার কোনটির অনুমোদন নেই। বিষয়টি ইতোমধ্যে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) অবগত করে অভিযান পরিচালনা করার জন্য সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।

কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা ( ডিএফও) মো. আনোয়ার হোসেন সরকার বলেন, চকরিয়া উপকূলে বর্তমানে যেসব ফিশিং ট্রলার তৈরী করা হচ্ছে তার একটি জন্যও কেউ অনুমোদন নেয়নি। তাই অনুমোদন বিহীন এসব অবৈধ ফিশিং ট্রলার জব্দে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ফিশিং ট্রলারগুলোতে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কাঠ ব্যবহার করার সত্যতা পাওয়া গেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা ছাড়াও পাচারকাজে বনকর্মীরা জড়িত থাকলে বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পাঠকের মতামত: