ঢাকা,রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪

মালুমঘাট সড়ক ট্রাজেডি

চকরিয়ায় প্রমাণিত হলো মানবিক বাংলাদেশের স্বরূপ

নিজস্ব প্রতি্বেদক,  চকরিয়া ॥   দেশ থেকে এখনও মানবতা হারিয়ে যায়নি। বিশেষ সময়ে সহমর্মিতা ও মানবতার উদাহরণ আজও আমাদের দেশে চলমান। দেশব্যাপী আলোচিত চকরিয়ার সড়ক দুর্ঘটনা ট্র্যাজেডিতে একই পরিবারের ৬সহোদরের মৃত্যু বরণের বিরল ঘটনায় সরকার প্রধানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন ও তাদের নেতাকর্মীরা অসহায় পরিবারের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। সকল দলের অনুসারীরা হাত বাড়িয়ে স্থাপন করেছেন “মানবিক বাংলাদেশ” এর উদাহরণ।

দেশজুড়ে আলোচিত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়ায় পিকআপ চাপায় মর্মান্তিকভাবে নিহত ৬ ভাইয়ের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩৫লাখ টাকা নগদ সাহায্য প্রধান করেন। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খাঁন শোকাহত পরিবারকে দেখতে এসে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দিয়েছেন ৪ লাখ টাকা। কক্সবাজার জেলা ও চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন ৩ দফায় দিয়েছে ৩লাখ ৬০ হাজার টাকা, জেলা পুলিশ সুপার ১ লাখ টাকা, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদ দিয়েছে ২লাখ ৫০হাজার টাকা, সৎসঙ্গ কেন্দ্র ২লাখ টাকা, ইসকন ৫০হাজার টাকা, চাল, ডাল ও তেল সহ ৭বস্তা ত্রাণ সাহায্য দেয়।

এছাড়া কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলমের স্ত্রী শিক্ষিকা সাহেদা জাফর দিয়েছেন ১ লাখ টাকা। এমনকি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ প্রতি পরিবারকে ৫৭হাজার টাকা করে মোট ৩ লাখ ৪২হাজার টাকা প্রদান ছাড়া আরও অনেক নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মানুষ যে যা পারেন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এই সাহায্যে ছিলনা কোন সাম্প্রদায়িকতা, হিংসা, বিদ্বেষ। এভাবে অর্ধকোটি টাকারও বেশী নগদ সাহায্য তারা পেয়েছেন। সাহায্য এসেছে সুদূর আমেরিকা প্রবাসী বাঙালী সংগঠন থেকেও। সাহায্যের হাত বাড়ানো দেখে বলা যায় আমাদের জন্মভূমি ‘‘মানবিক বাংলাদেশ’’ এর স্বরূপ উন্মোচিত করেছে।

অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রবর্তিত মুজিব বর্ষের উপহারের ৮টি ঘর পাচ্ছেন ৬ভাইয়ের স্ত্রী ছাড়াও ঘটনার ৩বছর আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করা অপর আরেক ভাইয়ের স্ত্রী, তাদের মা ও বেঁচে থাকা একমাত্র ভাই প্লাবন সুশীল। ইতোমধ্যে মুজিব বর্ষের এই ৮টি ঘরের কাজ শুরু করে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছে চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন। তাদের দেয়ার জন্য নির্মাণ করা হচ্ছে সেমিপাঁকা আটটি ঘর। মুজিব বর্ষের উপহার হিসেবে উপজেলা প্রশাসন এসব ঘর নির্মাণ করছেন। নিহতদের বাবা কর্তৃক নির্মিত স্থানীয় মালুমঘাট এলাকায় বন বিভাগের জমিতে অবৈধভাবে তৈরী করা বেড়ার ওপর টিনসেট জরাজীর্ণ পুরনো বাড়িতে ৭ বিধবা বসবাস করছেন। তবে খুব শীঘ্র তাদের সেই কষ্ট ঘুচে যাবে। এখন সরকারী খাস জমিতে আধাপাকা ঘর নির্মাণ করে ঘরসহ জমির মালিকানা দলিল বুঝিয়ে দিতে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করছে চকরিয়া উপজেলা প্রশাসন।

স্থানীয় প্রশাসন সুত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চকরিয়ার ডুলাহাজারা মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির উত্তর-পুর্ব পাশে ১৬ শতক সরকারি খাস জমিতে এসব উপহারের ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিটি ঘরে দুটি বেডরুম, একটি বাথরুম, বারান্দা ও একটি রান্না ঘর থাকছে। এসব ঘর নির্মাণের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে মোট ১৯ লাখ ২০ হাজার টাকা। গত ২২মার্চ এসব ঘর নির্মাণ কাজের আনুষ্ঠানিকভাবে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেপি দেওয়ান।

আজ শনিবার বিকেলে স্থানীয় সংবাদকর্মির সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে কথা হয় নিহত কয়েকজনের বিধবা স্ত্রীদের সঙ্গে। নিহত চম্পক সুশীলের স্ত্রী দেবিকা ঘোষ জানান, সে নিজেসহ মোট ৪জনের স্ত্রী এখনও ভোটার হতে পারেনি। ফলে প্রাপ্ত নগদ টাকাগুলো দিয়ে সঞ্চয়পত্র কেনার ইচ্ছা থাকলেও ভোটার আইডি কার্ডের অভাবে তা করা যাচ্ছেনা। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। যাদের ভোটার আইডি কার্ড আছে তারা ইতোমধ্যে সঞ্চয়পত্র কেনার সুযোগ পেয়েছে। ফলে তারা অধিক আর্থিক নিরাপত্তা পেয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোর পাঁচটায় বাড়ির কাছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক পার্শে নির্জন স্থানে প্রয়াত বাবা সুরেশ চন্দ্র শীলের পারলৌকিক ক্রিয়ানুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার মুহূর্তে সব্জি বোঝাই দ্রুতগামী পিকআপ এসে সাত ভাই-বোনকে একসঙ্গে চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলে চার ভাই অনুপম শীল, নিরূপম শীল, চম্পক শীল, দীপক শীল মারা যায়। চমেক হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে মারা যান আরেক ভাই স্মরণ শীল। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন বোন হীরা শীল ও অপর ভাই রক্তিম শীল। তন্মধ্যে হীরা মালুমঘাট মেমোরিয়াল খ্রিষ্টান হাসপাতালে চিকিৎসার পর সুস্থ হলেও ঘটনার ১৪দিন পর রক্তিম শীল চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেপি দেওয়ান চকরিয়া নিউজকে বলেন, একটি পরিবারের ছয়জন লোক একসঙ্গে সড়কে প্রাণ হারানোর ঘটনা খুবই নজিরবিহীন। তাদের এ ক্ষতি পুষিয়ে দেয়া কারো পক্ষে সম্ভব না। তারপরও ঘটনার পর থেকে উপজেলা ও জেলা প্রশাসন এবং সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, নিহতদের পরিবারগুলো বর্তমানে যে জায়গার মধ্যে রয়েছে তা বনবিভাগের জায়গা। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো: মামুনুর রশীদ সুশীল পরিবারের সকলকে সরকারী খাস জায়গায় পূর্ণবাসন করার জন্য নির্দেশ দেন। পরে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে কয়েকটি খাস জমি দেখানো হয় এবং তাদের সম্মতিতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক সংলগ্ন জায়গাটি নির্ধারন করা হয়েছে।

পাঠকের মতামত: