ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়ায় চিংড়ি উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে

মাহমুদুর রহমান মাহমুদ, চকরিয়া :: প্রায় চার দশক আগে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় শুরু হয় চিংড়ি চাষ। শুরুতে যে পরিমাণ জমিতে চাষ হতো, বর্তমানে এর পরিধি দ্বিগুণ হয়েছে। শুরুর দিকে প্রতি হেক্টর জমিতে ২৫০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন হতো। যা বর্তমানে নেমে এসেছে অর্ধেকে।

এর জন্য নির্বিচারে প্যারাবন উজাড়, খালের প্রবাহ বন্ধ করে মাছ চাষ, চর ঘেরা জাল বসিয়ে পোনা মাছ শিকার ও তামাক চাষের কারণে সৃষ্ট বর্জ্যকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এই খাত ঘিরে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে চকরিয়ার আনুমানিক ১০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ শুরু হয়। শুরুর দিকে চরণদ্বীপ, রামপুর এলাকায়ই ছিল বেশিরভাগ ঘেরের অবস্থান। বর্তমানে বহলতলী, রিংভং, পালাকাটা, বদরখালী, পশ্চিম বড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া, কোনাখালী, চরণদ্বীপ, রামপুর মৌজায় প্রায় ২০ হাজার ২৪৩ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হয়ে আসছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি। বাকি জমি সরকারি মালিকানার।

কয়েক বছর আগেও প্রতি মৌসুমে হেক্টরপ্রতি ২৫০ কেজি চিংড়ি উৎপাদিত হতো। সে হিসাবে উপজেলার মোট উৎপাদন হতো আনুমানিক ৫ হাজার টন। গড়ে ৮০০ টাকা কেজি ধরলে ৪৮০ কোটি টাকা আয় হতো এখানে। সঙ্গে চাষ হতো লইট্যা, সাদা চিংড়ি (চাগা), বাটা, কোরাল, বেলে, টেংরাসহ নানা প্রজাতির মাছ। এসব বিক্রি করেও আসত ১৫০ কোটি টাকা। এসব তথ্য জানিয়ে অবসরপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা ছরওয়ার জাহাঙ্গীর বলেন, বর্তমানে উৎপাদনের হার অর্ধেকে নেমেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উৎপাদন কমে আসার পেছনে কাজ করছে বেশ কিছু কারণ। সরকারি দলের প্রভাব খাটিয়ে একটি চক্র নির্বিচারে প্যারাবন উজাড় করছে। সেই সঙ্গে ১১টি শাখা খালের প্রবাহ বন্ধ করে মাছ চাষ করছেন অনেকে। চলতি চিংড়ি মৌসুমের ক্ষতির জন্য অনাবৃষ্টি ও অতিরিক্ত গরমকে দায়ী করছেন তাঁরা। ওই এলাকায় চিংড়ি উৎপাদন শুরুর পর থেকে এবারের মতো ক্ষতি আর দেখেননি তাঁরা।

এ মৌসুমে ব্যক্তিমালিকানাধীন এক হাজার একর জমিতে চিংড়ি চাষ করেছেন পূর্ব বড় ভেওলা ইউনিয়নের চাষি নাজেম উদ্দিন সওদাগর। এতে তাঁর প্রায় ৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। চলতি মৌসুমে এর অর্ধেকও ফিরে আসেনি বলে জানান নাজেম উদ্দিন।

তিনি বলেন, চিংড়ি চাষের আগের সুদিন নেই। ব্যাপক হারে প্যারাবন উজাড় চলছে। মাছ চাষের জন্য প্রবহমান খাল বন্ধ করায় জোয়ার-ভাটার পানি ওঠানামা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চর ঘেরা জাল বসিয়ে চিংড়িসহ অন্যান্য মাছের পোনা নিধন করায় ঘের এলাকায় উৎপাদন দিন দিন কমছে।

বক্তব্য জানতে চকরিয়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ফরহান তাজিমের মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও সাড়া মেলেনি। খুদেবার্তা পাঠালেও উত্তর দেননি তিনি। কার্যালয়ের মাঠ কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম কয়েক বছর ধরে চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ উৎপাদন কমার বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, দীর্ঘ অনাবৃষ্টির কারণে ঘেরের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়েছে। এতে কয়েক দফায় মড়কও দেখা দিয়েছে।

খালে প্রতিবন্ধকতা ও প্যারাবন উজাড় বিষয়ে চকরিয়া উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাহাত উজ জামান বলেন, অভিযোগ পেলেই আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দখল করা বেশ কিছু খাল ইতোমধ্যে বদ্ধ জলমহাল ঘোষণা করা হয়েছে। যেগুলো প্রতি বছর প্রকাশ্যে নিলামের মাধ্যমে ইজারা দেওয়া হচ্ছে। এতে রাজস্ব খাতে আয় হচ্ছে।

বন বিভাগের চকরিয়া সুন্দরবন রেঞ্জের কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, চিংড়ি জোন হিসেবে খ্যাত চরণদ্বীপ ও রামপুর মৌজা একসময় তাঁদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। পরে সরকার এই দুটি মৌজাকে মৎস্য ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে চিংড়ি ঘের হিসেবে ইজারা দেয়। এখন প্যারাবনই উজাড় হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, বর্তমানে সুন্দরবন রেঞ্জের অস্তিত্ব কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। একই রেঞ্জের কিছু বনভূমি চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের অধীনে দেওয়ার পর সেখানে প্যারাবন সৃষ্টি করা হয়।

ওই প্যারাবন ধ্বংসের জন্য প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দায়ী করেন চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা আবদুর রহমান। তিনি বলেন, শাসকদলের নাম ভাঙিয়ে প্যারাবন ধ্বংস করে চিংড়ি ঘের করে যাচ্ছেন প্রভাবশালীরা। তাঁরা এসব অভিযোগে চিরিংগা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জামাল হোছাইন চৌধুরী ও পূর্ব বড় ভেওলার সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল কাদেরসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন।

অভিযুক্ত জামাল হোছাইন চৌধুরী এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, কেন তাঁকে আসামি করা হয়েছে তা বুঝতে পারছেন না। একই রকম মন্তব্য করেন নুরুল কাদের। তবে তাঁদের দাবি, চিংড়ি ঘের বরাদ্দ পাওয়ার জন্য নিয়ম মেনে আবেদন করেছেন। মহাল কমিটিতে তাঁদের আবেদন অনুমোদন হওয়ার আগেই কেন চিংড়ি চাষ করছেন, জানতে চাইলে সদুত্তর দেননি তাঁরা।

চকরিয়া চিংড়ি ঘের মালিক সমিতির সভাপতি মো. ছলিম উল্লাহ বলেন, উৎপাদন কমে যাওয়ায় প্রকৃত চিংড়িচাষিরা প্রতি বছর আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাঁর আশঙ্কা, এ অবস্থা চললে সম্ভাবনাময় এ খাতের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে।

পাঠকের মতামত: