আতিকুর রহমান মানিক:
বছর ঘুরে আবারো ফিরে আসছে ১ লা এপ্রিল। বিশ্বব্যাপী এ দিনটি “April fool” (এপ্রিল ফুল) হিসাবে পরিচিত। আরো সহজ ভাষায় বললে এপ্রিলের বোকা। সহজাত পারস্পরিক আস্হা ও বিশ্বাস ভঙ্গ করে অপরকে বোকা বানানোর রুল মডেল তথাকথিত এই এপ্রিল ফুল। এ দিনে অনেকে ঘটা করেই পালন করেন এপ্রিল ফুল ও ধোঁকা দিয়ে অপরকে বোকা বানিয়ে হাস্যরসে মেতে উঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু এপ্রিল ফুলের উৎপত্তির বেদনাবিধুর ও বিয়োগান্তক ইতিহাস জানলে হয়ত এদিনে শোক পালন করতেন তারা।
এপ্রিল ফুলের বাস্তব ইতিহাস জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে আজ থেকে ৫২৫ বছর আগে, ১৪৯২ সালের ১লা এপ্রিলের এ দিনে।
তবে এর আগে একটু ফ্লাশব্যাক প্রয়োজন।
ইসলামের শাশ্বত সৌন্দর্য ও কল্যাণে আকৃষ্ট হয়ে বিশ্বের দেশে দেশে ইসলামী বিজয়ের যে জোয়ার ওঠে সেই ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের মাটিতেও ৷ অষ্টম শতাব্দীতে ইউরোপ মহাদেশের স্পেনে কায়েম হয় মুসলিম শাসন৷ মুসলমানদের যোগ্য শাসন ও নিরলস প্রচেষ্টায় তৎকালীন স্পেন জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সভ্যতার ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি লাভ করে ৷ তৎকালীন মুসলিম শাসিত স্পেন ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, স্হাপত্যশিল্প, দর্শন, প্রকৌশল, সমরবিদ্যা ও শিক্ষার লীলাভূমি। পরবর্তী ৮০০ বছর একটানা অব্যাহত থাকে এ উন্নতির ধারা ৷ এখানে একটা কথা না বললেই নয়, চতুর্দিকে এত অগ্রসর আজকের আধুনিক ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল সুতিকাগার ছিল মুসলিমশাসিত তৎকালীন স্পেন। স্পেনে মুসলমানদের ৮০০ বছরের গৌরবময় শাসনের ফলে দেশটিতে তখন অর্থসম্পদ, বিত্ত-বৈভবের অঢেল জোয়ার ৷ কিন্তু একপর্যায়ে মুসলমানরা জাগতিক ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে ভুলে যায় কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষা ৷ সামাজিক-নৈতিক অবক্ষয় ও অনৈক্য ধীরে ধীরে গ্রাস করে তাদের ৷ এ দুর্বলতার সুযোগ পুরোপুরিই গ্রহণ করে চারপাশের খ্রিষ্টান জগৎ ৷ তারা মেতে উঠে কুটিল ষড়যন্ত্রে ৷ সিদ্ধান্ত নেয়, ‘স্পেনের মাটি থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ করতে হবে ৷’ এ চিন্তা নিয়েই পর্তুগীজ রাণী ইসাবেলা চরম মুসলিম-বিদ্বেষী পার্শ্ববর্তী খ্রিষ্টান সম্রাট ফার্দিনান্দকে বিয়ে করে ৷ বিয়ের পর দু’জন মিলে নেতৃত্ব দেয় মুসলিম নিধনের ৷ স্পেন আক্রমন করে খ্রিষ্টানদের সম্মিলিত বাহিনী। তারা হাজার হাজার নারী-পুরুষকে হত্যা করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে উল্লাস করতে করতে ছুটে আসে রাজধানী গ্রানাডায় ৷
ততদিনে টনক নড়ে মুসলিম বাহিনীর ৷ রনপটু ও বীরযোদ্ধা মুসলিমরা দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলে দখলদারদের বিরূদ্ধে। কখনো সম্মুখ যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজিত করতে পারেনি বলে চতুর ফার্দিনান্দ পা বাড়ায় ভিন্ন পথে ৷ তার নির্দেশে আশপাশের সব শস্যখামার জ্বালিয়ে দেয়া হয় ৷ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় শহরের খাদ্য সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র ভেগা উপত্যকা ৷ এর ফলে অচিরেই দুর্ভিক্ষ নেমে আসে শহরে ৷ দুর্ভিক্ষ যখন প্রকট আকার ধারণ করলো তখন প্রতারক ফার্দিনান্দ ঘোষণা করলো, মুসলমানরা যদি শহরের প্রধান ফটক খুলে দেয় এবং নিরস্ত্র অবস্থায় মসজিদে আশ্রয় নেয় তবে তাদের বিনা রক্তপাতে মুক্তি দেয়া হবে ৷
ক্যালেন্ডারের পাতায় সেদিন ছিল ১৪৯২ সালের ১ এপ্রিল ৷ দুর্ভাগ্যতাড়িত গ্রানাডাবাসী অসহায় নারী ও মাসুম বাচ্চাদের করুণ মুখের দিয়ে তাকিয়ে খ্রিষ্টানদের আশ্বাসে বিশ্বাস করে খুলে দেয় শহরের প্রধান ফটক ৷ সবাইকে নিয়ে আশ্রয় নেয় আল্লাহর ঘর পবিত্র মসজিদে ৷ শহরে প্রবেশ করে খ্রিষ্টান বাহিনী মুসলমানদেরকে মসজিদের ভেতর আটকে রেখে প্রতিটি মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয় ৷ এরপর বিশ্বাসভঙ্গ করে একযোগে শহরের সমস্ত মসজিদে আগুন লাগিয়ে বর্বর উল্লাসে মেতে ওঠে হায়েনারা ৷ লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু অসহায় আর্তনাদ করতে করতে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারায় মসজিদের ভেতর ৷ প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখায় দগ্ধ অসহায় মুসলমানদের আর্তচিৎকার যখন গ্রানাডার আকাশ-বাতাস ভারী ও শোকাতুর করে তুলল তখন রাণী ইসাবেলা হেসে বলতে লাগলো, ‘হায় এপ্রিলের বোকা! শত্রুর আশ্বাস কেউ বিশ্বাস করে?’ সেই থেকে খ্রিষ্টান জগত্ প্রতি বছর ১লা এপ্রিল আড়ম্বরের সাথে পালন করে আসছে- April Fool মানে ‘এপ্রিলের বোকা’ উৎসব ৷
প্রতারনা ও বিশ্বাসভঙ্গ করে লাখো মুসলিম উম্মাহ, শিশু ও নারীদের নৃশংস ভাবে হত্যা করার কালোদিন এই ১লা এপ্রিল। তথাকথিত এপ্রিল ফুলের এই হল ইতিহাস, যার মূলেই রয়েছে বিশ্বাসঘাতকতা ও গনহত্যার কলঙ্ক।
কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় উপরোক্ত “এপ্রিল ফুল” এর প্রকৃত ইতিহাস সর্ম্পকে না জানার কারনে আমরা আমাদের পূর্বসূরীদের দুর্ভাগ্যকে আনন্দের খোরাক বানিয়ে এপ্রিল ফুল পালন করছি।
এপ্রিলফুল পালন আমাদের জন্য নয়। বরং এ দিনে নৃশংস গণহত্যার শিকার লক্ষ লক্ষ মুসলিম নর-নারী ও শিশুর বিদেহী আত্নার মাগফেরাত কামনা ও ব্যক্তিগত প্রার্থনার সময় তাদের স্মরণ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ১ লা এপ্রিলের বেদনাবিধুর নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি পৃথিবীর কোথাও যেন না হয়। যে কোন ধর্মাবলম্বী আর কোন আদম সন্তান যেন এরকম বর্বরতার শিকার না হয়, এই হোক আজকের প্রার্থনা।
আতিকুর রহমান মানিক
ফিশারীজ কনসালটেন্ট ও সংবাদকর্মী,
পাঠকের মতামত: