আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
ভারতীয় নাগরিকত্বের চূড়ান্ত খসড়া তালিকা থেকে অাসামের প্রায় ৪০ লাখ মানুষের নাম বাদ দিয়েছে প্রদেশের সরকার। সোমবার আসামের ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেন (এনআরসি) কর্তৃপক্ষ এ তালিকা প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেশি বাংলাদেশ থেকে আসামে পাড়ি জমানো অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করার লক্ষ্যে ১৯৫১ সালের পর এই প্রথম নাগরিকত্বের তালিকা হালনাগাদ করলো আসাম।
এনআরসির কর্মকর্তারা বলেছেন, এটি খসড়া তালিকা মাত্র। সুতরাং এখনই কাউকে গ্রেফতার অথবা নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে না। তবে সমালোচকরা বলেছেন, নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ পড়াদের অধিকাংশই প্রদেশের সংখ্যালঘু মুসিলম জনগোষ্ঠীর সদস্য এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত।
এনআরসি কর্তৃপক্ষ বলছে, ভারতীয় নাগরিকত্ব পেতে ৩ কোটি ২৯ লাখ আবেদন জমা পড়েছিল। এরমধ্যে যাচাই-বাছাই উতড়ে নাগরিকত্বের উপযুক্ত হিসেবে ২ কোটি ৮৯ লাখ মানুষ তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন। তবে যথাযথ নথি ও তথ্য-উপাত্ত দিতে না পারায় ৪০ থেকে ৪১ লাখ আসামিজ ভারতীয় নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন।
এনআরসির একজন সমন্বয়ক জোর দিয়ে বলেছেন, এটি একটি খসড়া তালিকা মাত্র এবং চূড়ান্ত তালিকা নয়। তালিকায় যারা জায়গা পাননি, তারা আবারও আবেদন করতে পারবেন।
ভারতের আসামই একমাত্র রাজ্য যেখানকার বাসিন্দাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য বিভিন্ন-নথিপত্র জমা দেয়ার পাশাপাশি নিবন্ধিত হতে হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর একদিন আগে অর্থাৎ ২৪ মার্চের পূর্বে আসামিজদের বংশধররা যে সেখানে বসবাস করতেন সেই দাবির পক্ষে কাগজপত্র জমা দিতে হয়েছে এবারের এনআরসিতে জায়গা পাওয়ার জন্য। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধ শেষে জন্ম হয় স্বাধীন বাংলাদেশের।
এর আগে ১৯৫১ সালে এক জরিপ চালানোর পর প্রথমবারের মতো এনআরসি তালিকা প্রস্তুত করে আসাম। ওই সময় আসামের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৮০ লাখ। পরে ২০০৫ সালে রাজ্য সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার এবং অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় এক চুক্তি স্বাক্ষরের পর এই তালিকা হালনাগাদ করা হয়। ১৯৮৫ সালের আসাম অ্যাকর্ড বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষর হয়।
২০০৫ সালের পর আবারো এনআরসি তালিকা হালনাগাদের কাজ শুরু হলেও রাজ্যের বিভিন্ন অংশে প্রায়ই সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এর জেরে বিভিন্ন সময় হালনাগাদ কাজ স্থগিত রাখতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। পরে ২০০৯ সালে আসাম পাবলিক ওয়ার্ক নামের একটি বেসরকারি সংস্থা রাজ্যের অবৈধ বাংলাদেশিদের সনাক্ত করার কাজ অব্যাহত রাখতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়।
পরে সুপ্রিম কোর্ট নির্বিঘ্নে অবৈধ অভিবাসীদের সনাক্তকরণ কাজ চালু রাখতে আসাম সরকারকে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়। এর তিন বছর পর আসামে নাগরিকত্বের চূড়ান্ত খসড়া তালিকা সোমবার প্রকাশ করা হলো।
এদিকে, নাগরিকত্বের দ্বিতীয় দফার চূড়ান্ত খসড়া তালিকা প্রকাশকে কেন্দ্র করে আসামের সীমান্তলাগোয়া মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশ ও মনিপুর রাজ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আধা-সামরিক বাহিনীর ২২ হাজার সদস্য আসাম এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে পাঠিয়েছে।
বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে ভারতে পাড়ি জমানোর পর যে সংখ্যালঘুরা সেখানে ছয় বছর অতিবাহিত করেছেন; তারা ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবেন বলে কেন্দ্র থেকে একটি আইনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু আসামসহ অন্যান্য রাজ্য সরকার এই আইনের বিরোধিতা করেছে।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের অঙ্গীকার করেছিলেন। ক্ষমতায় আসার পর ২০১৬ সালে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার নাগরিকত্ব সংশোধন বিল-২০১৬ সালে পাস করে।
কিন্তু বিজেপির এই প্রস্তাবে আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও মনিপুরের কিছু রাজনৈতিক দল নাখোশ; যারা ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জোট গঠন করে সরকারে রয়েছে। এই ইস্যুতে বিজেপির ওপর থেকে তারা সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়ারও হুমকি দিয়েছে।
এনআরসি প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছে দেশটির ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) হীমান্ত বিশ্ব শর্মা। অতীতে তিনি বলেছেন, তালিকায় যাদের নাম থাকবে না তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে।
অন্যদিকে আসামের মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোওয়াল বলেছেন, এনআরসির খসড়া তালিকায় যদি কারো নাম না থাকে তাহলে তাকে বিদেশি হিসেবে মনে করা যাবে না। কারণ এই তালিকা প্রকাশের পর বাদ পড়া মানুষজন তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণের যথেষ্ট সুযোগ পাবেন এবং আবেদনের মাধ্যমে তারা তালিকাভূক্ত হতে পারবেন।
পাঠকের মতামত: