ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

ইটভাটা মালিকরা প্রশাসনের নির্দেশও মানছেন না 

নিজস্ব প্রতিবেদক :: সারা দেশে ইটভাটা তৈরিতে চলছে চরম নৈরাজ্য। নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কা না করে ইটভাটা তৈরির কারণে ভয়াবহ পরিবেশদূষণ হচ্ছে। অপরদিকে দিন দিন কমছে আবাদি জমি। এ ছাড়া প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া গড়ে ওঠা ইটভাটাগুলো থেকে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। ইটভাটার কারণে পরিবেশ বিপর্যয় রোধে প্রশাসনের সিদ্ধান্তও মানছেন না মালিকরা। সব মিলিয়ে এ খাতে নৈরাজ্যকর অবস্থা চলছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. এ কে এম রফিক আহাম্মদ সাংবাদিকদের জানান, ইতোমধ্যে অধিদপ্তর দেশব্যাপী অভিযানে নেমেছে। অবৈধ ও পরিবেশ ছাড়পত্রবিহীন সব ইটভাটায় অভিযান চলবে। এরই মধ্যে ঢাকার ধামরাইয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকায় ও ইট তৈরিতে কারচুপির অভিযোগে ৬টি ইটভাটাকে জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

জানা যায়, গতকাল বুধবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ধামরাইয়ের কালামপুর ও বাথুলি এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে এসব ইটভাটায় জরিমানা করেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিকাশ চন্দ্র দাশ। তিনি বলেন, আমরা ভোক্তা অধিকার তদারকির জন্য ধামরাইয়ের কিছু ইটভাটা পরিদর্শন করেছি। পরিদর্শন করা ইটভাটাগুলোর মধ্যে ছয়টি ইটভাটা বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত স্ট্যান্ডার্ডের চেয়ে কিছু কম পেয়েছি। এর মধ্যে একটি ইটভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও ডিসি অফিস থেকে যে লাইসেন্স নিতে হয় তার কিছুই ছিল না। এসব অপরাধে কেবি কর্ণফুলি ব্রিকসকে ১ লাখ, এসকেবি কর্ণফুলি ব্রিকসকে ৫০ হাজার, কেএজেড ব্রিকসকে ১ লাখ, এএইচকে ব্রিকসকে ৫০ হাজার, রনি ব্রিকসকে ১ লাখ ও কেবিসিকো ব্রিকসকে ১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একই সাথে যাদের লাইসেন্স নাই ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই তাদের এসব সনদ দ্রুত সংগ্রহের জন্য বলা হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, বিএসটিআই নির্ধারিত পরিমাপ অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে। ইটের যে ব্লক রয়েছে সেটারও নির্ধারিত পরিমাপ রয়েছে, এই পরিমাপ কম বেশি হলে সিমেন্ট ও বালুর কমবেশি প্রয়োজন হয়। এটা এক ধরনের প্রতারণা। এজন্যই ভোক্তা অধিকার থেকে আমরা ইটভাটা পরিদর্শন করেছি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন-জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঢাকা জেলা সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মণ্ডলসহ ধামরাই থানার পুলিশ কর্মকর্তারা।

এর আগে গত ১০ জানুয়ারি আশুলিয়ায় অনুমোদনহীনভাবে গড়ে ওঠা দুটি ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেন ভ্রম্যমাণ আদালত। এ সময় এক ইটভাটা মালিককে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকা ভ্রাম্যমাণ অভিযান চালিয়ে এ জরিমানা করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজী তামজীদ আহমেদ। এ সময় পরিবেশ অধিদপ্তর ঢাকা অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মো. রাজিব ও আশুলিয়ায় থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হারুনউর রশিদ, ফায়ার সাভিস ও র্যাব সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

সূত্রমতে, রাজধানীসহ সারা দেশে বৈধ প্রায় ৬ হাজার ইটভাটা রয়েছে। অনুমতির বাইরে (অবৈধ) রয়েছে আরো কয়েক হাজার। এ ইটভাটা থেকে বছরে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কোটি ইট তৈরি হয়। অধিকাংশ ইটভাটা শুষ্ক মৌসুমে চালু থাকে। বছরের অন্য সময়ে বন্ধ থাকে। বিশেষ করে শহর, উপশহর, বড় বড় কলকারখানা বা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি জায়গায় এবং যেখানে যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো ও সহজে ইট আনা-নেওয়া করা যায় এবং ট্রাক ও অন্যান্য যানবাহন স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারে এমন এলাকা বেছে নেয় ইটভাটার মালিকরা। মূলত এ জায়গা থেকেই শুরু হয় পরিবেশদূষণ।

এদিকে ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কাঠ পোড়ানো আইনত নিষিদ্ধ থাকলেও বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন এবং ব্যাপকভাবে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। ইটভাটার কারণে শুষ্ক মৌসুমে বায়ুদূষণ বৃদ্ধি পায়। মূলত নিচু মানের জ্বালানি ও অনুপযুক্ত চিমনি ব্যবহারের কারণে ইটভাটাগুলো পরিবেশদূষণে সহায়ক করছে। ইটভাটার চারপাশ ছড়িয়ে পড়ছে ছাই, ধুলা ও সালফার ডাই-অক্সাইডসহ অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস। আক্রান্ত এলাকায় এসিড বৃষ্টির মতো ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এ ছাড়া ইটভাটাগুলো শস্যাহানি, ধাতব পদার্থে মরচে সৃষ্টি, বর্ণক্ষয়, ভূমিক্ষয়, ভূমিধস ও ভূমির উর্বরতা হ্রাসে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। ইটভাটায় ব্যবহূত জায়গাজমি দীর্ঘ সময় কৃষিকাজে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। জমির উর্বরতাশক্তি এমনভাবে নষ্ট হয় যাতে আর কোনো ফসল হয় না এবং এই জমিতে ফসল ফলালেও ফসল সামান্য উৎপন্ন হলে ফলাফল ভালো হয় না এবং উর্বরতাশক্তি ফেরাতে দীর্ঘকাল সময়ের প্রয়োজন হয়।

ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ একর। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ১৯৮৪ সালে দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ২ লাখ ৩৮ হাজার একক। ১৯৯৭ সালে এসে কমে এসে তা ১ কোটি ৭৪ লাখ ৪৯ হাজার একরে এবং সর্বোপরি বর্তমানে বাংলাদেশের আবাদি জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ কোটি ৫৪ হাজার একরে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পরিবেশ বিপর্যয়, কৃষি জমি ধ্বংস, প্রশাসনের অনুমতি না থাকায় কুমিল্লা সদরের ইরা ব্রিকস ফিল্ড এক ইটভাটার কার্যদক্রম চালানোর উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত। ইটভাটা তৈরির সময় স্থানীয় প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, বনবিভাগ এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কোনো ছাড়পত্র না থাকায় কুমিল্লা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আজিজুর রহমানের আদালত এ নিষেধাজ্ঞা দেন। কিন্তু প্রশাসনের এ আদেশ না মেনে মালিক বিল্লাল কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নে মেসার্স এসএনবি ব্রিকস নামের ইটভাটাটির একই অনিয়মের কারণে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। কিন্তু মালিক শামছুল আলম আদালতের নিষেধ উপেক্ষা করে চালিয়ে যাচ্ছেন ভাটা।

পাবনার ঈশ্বরদীতে লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়নের পদ্মার চরাঞ্চলের তিনটি গ্রামে ৫০টি ইটভাটা। এ ইটভাটাগুলো তৈরিতেও কোনো নিয়ম মানা হয়নি। ইটভাটার ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে স্থানীয় লোকজনের দেওয়া অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইটভাটাগুলো বন্ধের নির্দেশ দেয় প্রশাসন। কিন্তু ওই পর্যন্ত। এরপর আর বন্ধ হয়নি, ইটভাটাগুলো এখনো সচল রয়েছে। এছাড়া নাটোর, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, মানিকগঞ্জ, গাজীপুরসহ অন্তত ৫০টি ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দেন আদালত। কিন্তু আদালতের নির্দেশ অমান্য করে এখনো চলছে ইটভাটাগুলো। এক কথায় যে যেভাবে পারছে, চালিয়ে যাচ্ছে।

কুমিল্লা ইরা ব্রিকস ফিল্ড নামের ভাটার মালিক বিল্লাল হোসেন আদালতের নির্দেশ পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, এ বিষয়ে আমরা উচ্চ আদালতে যাওয়ার চিন্তা করছি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সরকারিভাবে দেশে বর্তমানে ইটভাটার সংখ্যা ৬ হাজার ৯৩০টি আর বছরে দেশে ইটের চাহিদা দেড় হাজার কোটি। এই ইট প্রস্তুত করতে ১২৭ কোটি সিএফটি মাটির দরকার হয়। যার বেশিরভাগই কৃষিজমির উপরিভাগ (টপ সয়েল) থেকে সংগ্রহ করা হয়।

তিনি বলেন, ইট প্রস্তুত খাত দেশের গ্রিনহাউস গ্যাসের সবচেয়ে বড় উৎস। এ খাতে বছরে ২২ লাখ টন কয়লা ও ১৯ লাখ টন জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়, যা বছরে ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে। তিনি বলেন, ভারতে ইটভাটার জন্য মাটি তুলতে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করতে হয়। বাংলাদেশে তা করতে হয় না।

তিনি বলেন, নিয়মনীতি না মানা ইটভাটাগুলো বন্ধের জন্য আমরা বার বার তাগিদ দিয়েছি। কোনোটি মানা হয়েছে, কোনোটি মানা হয়নি। অবৈধভাবে চলা ইটভাটাগুলো দ্রুত বন্ধের দাবি জানান তিনি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. এ কে এম রফিক আহাম্মদ বলেন, অবৈধভাবে চলা ইটভাটার বিষয়ে আমরা অভিযানে নেমেছি। সারা দেশেই এ অভিযান হবে। তিনি বলেন, পরিবেশ ক্ষতি করে যারাই ইটভাটা পরিচালনা করবে তারা যতই প্রভাবশালী হোক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পাঠকের মতামত: