ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

নিজেই রোগি কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল

# দেড় হাজার রোগির জন্য ১৮ জন কর্মচারী
# অর্ধেক ডাক্তারের পদ শূণ্য
# সেবা না পেয়ে প্রসূতিদের হাসপাতাল ত্যাগ
ইমাম খাইর, কক্সবাজার :::
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল নানামুখী সমস্যায় এখন নিজেই রোগী। চিকিৎসক সংকটের কারণে আবাসিক রোগীরা কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছে না। চরম সংকট চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর। নার্সদের আচরণও সন্তুষজনক নয়। শিশু বিভাগ, অপারেশন বিভাগ, ল্যাবরেটরি, গাইনি, অর্থোপেডিক বিভাগে করুণ অবস্থা বিরাজ করছে। সিটের অভাবে মেঝেতে পড়ে থাকে রোগীরা। ২৫০ জন রোগির স্থলে ইনডোর-আউটডোর মিলে দেড় হাজারের বেশি চিকিৎসা নিচ্ছে নিয়মিত। ৪৪ জন কর্মচারীর স্থলে আছে মাত্র ১৮ জন। হাসপাতালে মোট ২৮৬টি সৃষ্ট পদের মধ্যে ৬০টি শূণ্য। কর্মরত ডাক্তারদের অধিকাংশ রোটেশন মানেনা। ডিউটির সময়ে বাইরে ব্যস্ত থাকে। সরকারী দায়িত্ব পালনের চেয়ে বেসরকারী চেম্বারে তাদের ঝুঁক বেশি।
প্রসূতি বিভাগে দুইজন কনসালটেন্ট পদের একজনও নেই। মিড লেভের ডাক্তারও নাই। ডাক্তারের অভাবে দুইটি ইউনিটকে একটি করে ফেলা হয়েছে। প্রসূতি সেবার চাহিদা দিন দিন বাড়লেও নিম্নমুখি সরকারী হাসপাতালের এই বিভাগটি।
চক্ষু বিভাগ অন্ধকারে, দন্ত বিভাগ চলছে অনেকটা দন্তহীনের মতো। হাসপাতালে ৭৭ জন চিকিৎসকের স্থলে আছে মাত্র ৪৮ জন। জরুরি বিভাগে ৭ জন রয়েছে মাত্র ২ জন। আবাসিক রোগীদের মাঝে খাবার বিতরণে অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে।
হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মোহাম্মদ শাহিন আবদুর রহমান চৌধুরী কক্সবাজার নিউজ ডটকম (সিবিএন)কে বলেন, হাসপাতালের অনেক গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। সেবার মানও বেড়েছে। কিছু জায়গায় এখনো ত্রুটি রয়ে গেছে, তা আমরা কেটে ওঠার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, স্থানীয় রোগির পাশাপাশি ভিআইপি ও পর্যটকদের সেবা দিতে হয়। তার উপর রোহিঙ্গাদের চাপ তো আছেই। ২৫০ শয্যার হাসপাতালে নিয়মিত ২-৩ গুণ রোগি ভর্তি থাকে। কিন্তু সেই অনুপাতে ডাক্তার, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নেই। সব বিভাগের কাজ সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার ২৪ লাখ মানুষের সেবার জন্য তিন বছর আগে ১০০ বেডের জেলা সদর হাসপাতালকে ২৫০ বেডে উন্নীত করে সরকার। কিন্তু বাড়েনি অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা। নিয়োগ দেয়া হয়নি পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও জনবল।
ওয়াকিবহাল সূত্র জানায়, ইনডোর ও আউটডোর মিলে দৈনিক দেড় হাজারের বেশি রোগী চিকিৎসাসেবা নেয়। অধিকাংশ ডাক্তার দৈনিক রোস্টার মেনে না চলা ও প্রাইভেট চেম্বারমুখী হওয়ায় যথা সময়ে সেবাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রোগীরা। সকাল সাড়ে ৮টায় হাসপাতালে রিপোর্ট করার কথা থাকলেও পৌঁছে ১১টার পর। ডাক্তারদের অনুপস্থিতির কারণে রোগীদের দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়।
এদিকে অভিযোগ ওঠেছে, চিকিৎসক থাকার পরও কক্সবাজার সদর হাসপাতালে সঠিকভাবে প্রসূতিদের সেবা মিলছে না। এতে প্রসূতি ওয়ার্ডে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থাকার খবরে হাসপাতালে আসা প্রসূতিরা মনোক্ষুণ্ন হয়ে হাসপাতাল ছাড়ছে। আর সংশ্লিষ্ট বিভাগের চিকিৎসকদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে নিরুপায় হয়ে প্রসূতিদের অন্যত্র রেফার করতে বাধ্য হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আবার অনেকে সেবা না পেয়ে নিজ উদ্যোগে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অন্যত্র।
সদর হাসপাতালে চিকিৎসা না দিলেও এর পার্শ্ববর্তী বেসরকারি (প্রাইভেট) হাসপাতালগুলোতে ঠিকই চিকিৎসা দিচ্ছেন গাইনি বিভাগের চিকিৎসকরা। এ নিয়ে সেবা প্রার্থীদের মাঝে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অসাদু এসব চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
অভিযোগ স্বীকার করে হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক ডা. সোলতান আহমদ সিরাজী বলেন, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, কক্সবাজার সদর হাসপাতাল দক্ষিণ চট্টগ্রামের অত্যাধুনিক সুবিধা সম্বলিত সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান। রোহিঙ্গা ইস্যুর পর আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন এনজিও সংস্থা হাসপাতালে অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে। যার ফলে অনেক জটিল রোগের সেবা এখন কক্সবাজার সদর হাসপাতালে মিলছে। এখানে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের অস্থায়ী ক্যাম্পাস হওয়ায় কলেজের বিভিন্ন বিভাগের প্রফেসর ও হাসপাতালের কনসালটেন্ট এবং মেডিকেল অফিসারদের অতিরিক্ত সেবা পাচ্ছেন রোগীরা।
অন্যান্য রোগের সঙ্গে এ হাসপাতালে গত বছর এক বছরে প্রায় ৯ হাজার প্রসূতি সেবা পেয়েছেন। এদের মাঝে সিজারিয়ান ডেলিভারি সেবা পেয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার প্রসূতি। তাই চলমান সময়ে প্রসূতি সেবার জন্য মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ছাড়াও বিত্তশালীরাও সদর হাসপাতালকেই পছন্দের এক নাম্বার তালিকায় রাখছেন।
কিন্তু গর্ভকালীন সেবা পেলেও গত শুক্রবার থেকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রসূতি সেবা পাচ্ছেন না প্রসব বেদনা নিয়ে হাসপাতালে আসা নারীরা। এতে সচ্ছল পরিবারের সন্তান সম্ভবাকে বেসরকারি হাসপাতালে প্রসব করানো হলেও ভোগান্তিতে পড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান সম্ভবা মায়েরা। সেবা না পেয়ে অনেকে নিজ উদ্যোগে হাসপাতাল ছেড়ে গ্রামের ধাত্রি বা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাচ্ছে। এসব দেখে মনোবেদনা নিয়ে নিরুপায় হয়ে সময় পার করছেন গাইনি বিভাগে কর্মরত নার্সরা।
সূত্র আরও জানায়, সদর হাসপাতালে গাইনি বিভাগের সিনিয়র ও জুনিয়র কনসালটেন্টের দুটি পদ থাকলেও তা শূন্য রয়েছে। কিন্তু সদর হাসপাতালটি কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অস্থায়ী ক্যাম্পাস হওয়ায় কলেজের গাইনি বিভাগের শিক্ষকগণ নিয়মানুসারে হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগে সেবা দিতে বাধ্য। বিগত সময়ে সেটি-ই হয়ে এসেছে। তাই হাসপাতালের সৃষ্ট পদ খালি থাকলেও সেবার কমতি হয়নি। কিন্তু চলতি মাসের শুরু থেকে কলেজের গাইনি বিভাগে কর্মরত শিক্ষকরা থিওরিক্যাল ক্লাসেই সব দায় সারছেন। প্রাকটিকাল ক্লাসে বাস্তবিক অপারেশনে না আসায় সেবা বঞ্চিত হচ্ছে প্রসূতিরা।
কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ সূত্র জানায়, মেডিকেল কলেজের গাইনি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করছেন গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. খন্দকার আসাদুজ্জামান। সহকারী অধ্যাপক হিসেবে রয়েছেন ডা. শিরিন আক্তার জাহান, প্রভাষক হিসেবে রয়েছেন ডা. খায়রুন্নেসা মুন্নি ও ডা. শৈলাস। তাদের সঙ্গে রয়েছেন আরও দুইজন।
হাসপাতাল সূত্র মতে, নিয়মানুসারে কলেজের গাইনি বিভাগের নিয়ন্ত্রণে সদর হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগটি পরিচালিত হওয়ার কথা। তাদের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য রাখা হয় কয়েকজন মেডিকেল অফিসার। আর গত ২ মার্চ বিভাগীয় প্রধান ডা. খোন্দকার আসাদুজ্জামান হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ককের কাছে দেয়া একটি রোস্টারে নিজেকে বাদ দিয়ে কনসালটেন্ট ডা. শিরিন, ডা. মুন্নি ও ডা. শৈলাসের সঙ্গে সহকারী হিসেবে চার মেডিকেল অফিসার ডা. আরেফা মেহের, ডা. মাশকুরা ফারুখ জিনিয়া, ডা. ফাতেমা বেগম, ডা. নাফিসা তাহসিনের সমন্বয়ে প্রসূতি বিভাগের দায়িত্ব ভাগ করেছেন।
বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কাজের চাপের কথা বলে ডা. খোন্দকার আসাদুজ্জামান প্রসূতি সেবায় আসছেন না। আর সম্প্রতি প্রফেসর হিসেবে পদোন্নতির অজুহাত তুলে সেবা দিতে আসছেন না আরেক গাইনি কনসালটেন্ট ডা. শিরিন আকতার জাহান। বিভাগীয় প্রধান হিসেবে ডা. খোন্দকার আসাদুজ্জামান একদিনও প্রসূতি বিভাগে দায়িত্ব না রাখায় সেবা দিতে আসছেন না ডা. খায়রুন্নেসা মুন্নীও। আর তিন প্রসূতি কনসালটেন্টের কারণে গত শুক্রবার থেকে সেবা পাচ্ছেন না প্রসূতিরা।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সোলতান আহমদ সিরাজী কক্সবাজার নিউজ ডটকম (সিবিএন) বলেন, সরকারি হাসপাতালে সেবা না দিলেও কনসালটেন্ট হিসেবে প্রাইভেট প্রাকটিস নিয়মিতই চালাচ্ছেন তারা। তাদের অনুপস্থিতির কারণে গত তিন দিনে অর্ধশত রোগী ঝুঁকি নিয়ে চলে গেছেন। সেবা দিতে না পেরে আমরাও নিরুপায় হয়ে অনেক রোগীকে রেফার করে দিয়েছি। এদের মাঝে অনেক রোগী মফস্বল থেকে আসা দরিদ্র।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. খোন্দকার আসাদুজ্জামান গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, কলেজে আমার বিভাগে পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়ানো নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। ফলে প্রসূতি বিভাগে আমার যাওয়া হয়ে ওঠে না। অন্যরা দায়িত্ব পালন না করলে সে ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে পারে।

পাঠকের মতামত: