ঢাকা,মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

৫৭-র চেয়ে ৩২ বড়ই থাকল, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস

নিজস্ব প্রতিবেদক ::  সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠনসহ বিভিন্ন মহলের আপত্তি থাকলেও ৩২ ধারা বহাল রেখে জাতীয় সংসদে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল-২০১৮’ পাস হয়েছে। গতকাল বুধবার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বিলটি পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করলে কণ্ঠভোটে পাস হয়। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হওয়া অধিবেশনে বিলটি পাসের আগে জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা। প্রস্তাবটি কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। বিল পাসের খবর পেয়ে বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদসহ গণমাধ্যম মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। সাধারণ সম্পাদক এবং দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম বলেছেন, ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং গণতন্ত্রের জন্য এটি এক দুঃখের দিন।’

এই আইনের ৩২(১) ধারায় অফিশিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের আওতাভুক্ত কিছু অপরাধ করলে বা করতে সহায়তা করলে অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা জরিমানা হবে। ২৫ ধারার (ক) উপধারায় বলা হয়, জেনেবুঝে মিথ্যা তথ্য প্রচার করলে অনধিক তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকা জরিমানা হবে। ২১ ধারায় বলা হয়, ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রপাগান্ডা চালালে বা চালাতে মদদ দিল অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সংসদে বলেছেন, ‘বিলটি পাসের জন্য নিজেকে সৌভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ রক্ষার জন্য ডিজিটাল আইন আমরা সবার আগে তৈরি করছি। পৃথিবীর বহু দেশকে এই আইনটি অনুসরণ করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে এটা ঐতিহাসিক আইন। ভবিষ্যতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ হবে না। যুদ্ধ হবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। তাই কোনোভাবে আমরা রাষ্ট্রকে বিপন্ন হতে দিতে পারি না।’

সংসদীয় কমিটির বৈঠকে উপস্থিত হয়ে সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন এডিটরস কাউন্সিল, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) এবং বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন-অ্যাটকোরসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই উপস্থিত হয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু সংশোধনী প্রস্তাব দিলে সংসদীয় কমিটির চূড়ান্ত সুপারিশে তা রাখা হয়। বিশেষ করে ব্যাপক সমালোচিত তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাসহ কয়েকটি ধারা আরো বিশদ আকারে যুক্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব বাতিলের দাবি জানানো হয় তাঁদের পক্ষ থেকে। তাঁরা দাবি করেন, প্রস্তাবিত ওই আইনের ২১, ২৫, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৪৩ ধারা বিদ্যমান থাকলে স্বাধীন সাংবাদিকতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। পাস হওয়া বিলের কয়েকটি ধারায় কিছু পরিবর্তন আনা হলেও ৩২ ধারাসহ বেশির ভাগ ধারা বহাল রয়েছে।

তবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী গতকাল সংসদে বলেছেন, সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য এই আইন নয়। মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বাধা যেন না থাকে সেটা এই আইনে নিশ্চিত করা হয়েছে।

এদিকে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব উত্থাপনকালে ফখরুল ইমাম বলেন, ‘বিলে স্টেকহোল্ডারদের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। বাক্স্বাধীনতার জন্য এটা উদ্বেগজনক। এটা একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিল। গণমাধ্যমের উদ্বেগ ও মতামত উপেক্ষা করাই স্বাধীন সাংবাদিকতায় বাধার সৃষ্টি করবে। দেশে সুশাসনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল এই বিলের কারণে তা বাধা হয়ে দাঁড়াবে।’ জাতীয় পার্টির আরেক সদস্য নুরুল ইসলাম মিলন বলেন, বিলে গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি।

তাঁরা ৩০ অক্টোবরের মধ্যে জনমত যাচাইয়ের জন্য বিলটি প্রচারের দাবি জানান। এ ছাড়া বিরোধীদলীয় সদস্যরা বিলের ১৩টি ধারায় সংশোধনী প্রস্তাব দিলেও গৃহীত হয়নি।

গত ৯ এপ্রিল ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল-২০১৮’ জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়। এরপর বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। সংসদীয় কমিটি কয়েক দফা বৈঠক করে সংশ্লিষ্টদের মতামত গ্রহণের পর বিলটি চূড়ান্ত করে গত ১৭ সেপ্টেম্বর পাসের সুপারিশ সংসদে প্রতিবেদন জমা দেয়।

বিলের ৩২(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি অফিশিয়াল সিক্রেসি অ্যাক্টের আওতাভুক্ত অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওযার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন তাহা হইলে তিনি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’ ৩২ (২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি উপধারা-১-এ উল্লিখিত অপরাধ দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন সংঘটন করেন, তাহা হইলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’

বিলের ২৫ ধারার (ক) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ করেন, যাহা আক্রমণাত্মক বা ভীতি প্রদর্শক অথবা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তিকে বিরক্ত, অপমান, অপদস্ত বা হেয়প্রতিপন্ন করিবার অভিপ্রায়ে কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ বা প্রচার করেন, বা খ) রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করিবার, বা বিভ্রান্তি ছড়াইবার, বা তদুদ্দেশ্যে অপপ্রচার বা মিথ্যা বলিয়া জ্ঞাত থাকা সত্ত্বেও কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত আকারে প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির অনুরূপ কার্য হইবে একটি অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি অনধিক তিন বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন অপরাধের জন্য পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।’

বিলের ২১ ধারায় নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগন্ডা ও প্রচার চালানো বা উহাতে মদদ প্রদান করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুরূপ কার্য ইইবে একটি অপরাধ।’ এই অপরাধের শাস্তি অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। দ্বিতীয়বার বা পুনঃপুন অপরাধের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বাতিল হওয়া ধারাগুলো নতুন আইনের বিভিন্ন ধারায় রয়ে গেছে, এমনকি কোথাও আইন অপব্যবহারের সুযোগ আরো বেড়েছে বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ৫৭ ধারা নিয়ে উদ্বেগের মুখে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া করার পর দেখা যায়, এর ৩২ ধারা দিয়ে হয়রানির সুযোগ আরো বেশি থাকবে। কালের কণ্ঠ তখন ‘৫৭-র চেয়েও ৩২ বড়’ শিরোনামে বিশেষ প্রতিবেদন ছাপে।

উত্থাপিত বিলের ৩২ ধারা নিয়ে সাংবাদিকমহলের সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছিল। ৩২ ধারায় সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত, যেকোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিল। এখানে সংসদীয় কমিটির সুপারিশে ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ শব্দ উঠিয়ে দেওয়া হয়। এখন বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তি ‘অফিশিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট-১৯২৩-এর আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটন করে বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে তিনি সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ২৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

২৫ ধারায় বলা ছিল, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছা করে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করে যা আক্রমণাত্মক, ভীতি প্রদর্শক বা কাউকে নীতিভ্রষ্ট করে বা বিরক্ত করে; অপমান অপদস্থ বা হেয় করে; রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করতে বা বিভ্রান্ত করতে কোনো তথ্য সম্পূর্ণ বা আংশিক বিকৃত করে প্রকাশ বা প্রচার করে তবে তা হবে অপরাধ। এই ধারার চারটি উপধারাকে ছোট করে দুটি উপধারা করা হয়েছে। তবে মূল বক্তব্য প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। বিলে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি আইনগত কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে অন্য কারো পরিচিত তথ্য সংগ্রহ, বিক্রয় দখল, সরবরাহ বা ব্যবহার করেন, তাহলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বা উভয় দণ্ড হবে।

২৮ ধারায় ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার জন্য শাস্তি কমানো হয়েছে। সংসদে উত্থাপিত বিলে সাত বছরের জেল বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল। পাস হওয়া জেল কমিয়ে পাঁচ বছর করা হয়েছে। মানহানিকর তথ্য প্রচার নিয়ে ২৯ ধারায় পরিবর্তনের কথা সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও সেখানে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত রূপকল্প ২০২১ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ও নিরাপদ ব্যবহার আবশ্যক বর্তমান বিশ্বে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে এর সুফল ভোগের পাশাপাশি অপপ্রয়োগও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে সাইবার অপরাধের মাত্রাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাইবার অপরাধের কবল থেকে রাষ্ট্র এবং জনগণের জানমাল ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান এ আইনের অন্যতম লক্ষ্য।

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, “আমরা এমন একটি কঠোর ও কঠিন আইন চেয়েছিলাম, যার মাধ্যমে অপসাংবাদিকতা, অপপ্রচার, গণমাধ্যমে ও সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার রোধ হবে। কিন্তু আমরা এখন যে ৩২ ধারা যুক্ত যে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ পাস হতে দেখলাম, তা আমাদের জন্য নতুন এক উদ্বেগের কারণ হয়েছে।” তিনি বলেন, ‘এই আইনের খসড়া প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করার আগে আমাদের সঙ্গে আরেকবার বসার কথা ছিল, কিন্তু সেটা আর করা হয়নি।’ কালের কণ্ঠ

পাঠকের মতামত: