ঢাকা,বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪

মাতামুহুরীর ভাঙনে বিলীন সাহারবিলের শীলপাড়া

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::

সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যার পর মাতামুহুরী নদীর ভাঙনে হারিয়ে যাচ্ছে চকরিয়ার সাহারবিলের শীলপাড়া। গত ২০ বছরে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে এখানকার ২০০ বসতবাড়ি। বিলীন হওয়ার পথে একমাত্র সড়কটি। অবশিষ্ট ৫০ পরিবারকেও রক্ষার কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। গত ২০ বছর ধরে অব্যাহত ভাঙনের কবলে পড়ে মাতামুহুরী নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার সাহারবিল ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডেরই শীলপাড়ার অন্তত ২০০ বসতবাড়ি।

বসতবাড়ি হারানো এসব পরিবার মাথা গোঁজার জন্য ভূমি না থাকায় অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে শীল পাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের দুটি মন্দিরও। বর্তমানে শীল পাড়ার অবশিষ্ট যেসব বসতবাড়ি (প্রায় ৫০ পরিবার) বিদ্যমান রয়েছে তাও ভাঙনের কবলে পড়েছে। ইতোমধ্যে এই পাড়ার ওপর দিয়ে বিদ্যমান সাহারবিল শীলপাড়া সড়কটিও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যে সড়ক দিয়ে প্রতিদিন চলাচল করেন আশপাশের বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ। সেইসাথে এই সড়কের ওপর দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করেন অন্তত পাঁচটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। কিন্তু এই সড়কটি নিয়ে কারোরই যেন মাথাব্যথাও নেই। মাতামুহুরী নদীর করাল গ্রাসে পড়ে ভাঙন অব্যাহত থাকায় একেবারেই যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে শীল পাড়া সড়কটিতে। এই অবস্থায় সড়কটির উপকারভোগী এবং শীল পাড়ার ৫০ পরিবারের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

মাতামুহুরীর ভাঙনের মুখে আতঙ্কিত শীল পাড়ার বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, গত ২০ বছর ধরে মাতামুহুরী নদীর ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়ে বসতভিটে হারিয়েছেন প্রায় ২০০ পরিবার। বর্তমানে এসব পরিবারের কেউ কেউ অন্যত্র গিয়ে বাসাবাড়ি নিয়ে এবং কেউবা জায়গা ক্রয়ের মাধ্যমে বসতি নির্মাণ করে বসবাস করছেন। আবার অনেকেই বাপ দাদার ভিটে-বাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে এখন পথের ভিখিরির মতো উদ্বাস্তুর জীবনযাপন করছেন।

বিমল হরি সুশীল নামের এক বয়োবৃদ্ধ কান্নাজড়িত কণ্ঠে চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘মাতামুহুরী নদীটি বর্তমানে যে স্থানে বহমান রয়েছে, মূলত সেখানেই ছিল আমাদের শীলপাড়ার বেশির ভাগ অংশ।

গত ২০ বছরে এই নদীর দুই তীরে ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়ে পুরো শীলপাড়াই যেন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আমাদের পাড়ার অবশিষ্ট ৫০ বসতবাড়িও আর রক্ষা করা যাবে না। কেননা এই পাড়ার মাঝখান দিয়ে চলমান শীলপাড়া সড়কটিও ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এতে অন্যের বাড়িভিটের ওপর দিয়ে কোনোমতে যাতায়াত করতে হচ্ছে। স্থানীয় জনগণের পক্ষ থেকে নদীতীরের ভাঙন ঠেকাতে গাছ পুঁতে দিয়ে তার ওপর তক্তা বিছিয়ে চলাচল সচল রাখলেও চলতি বছরের প্রথম বন্যার ধাক্কায় সেই তক্তার রাস্তাও নদীতে তলিয়ে গেছে।’

বিমল হরির মতো ওই পাড়ার আরো বেশ কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি চকরিয়া নিউজকে বলেন, আমাদের কপাল বড়ই অভাগার। কেননা গত ২০ বছর ধরে শীলপাড়া মাতামুহুরী নদীর ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়লেও কোনো জনপ্রতিনিধি সেই ভাঙন ঠেকাতে তেমন কোনো উদ্যোগই নেননি। কারণ বিএনপি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত এক ব্যক্তিই টানা কয়েকবার সাহারবিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। সেই চেয়ারম্যান আমাদের জন্য কোনো কাজই করেননি। উপরন্তু তিনিই চেয়েছিলেন দিন দিন যাতে আমাদের বসতবাড়ি হারিয়ে যায়। সেজন্য মাতামুহুরী নদীর ভাঙন ঠেকাতে কোনো তৎপরতা তিনি দেখাননি। এ কারণে গত ২০ বছরে শীল পাড়ার ২০০ হিন্দু পরিবার বসতভিটে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে।

তাঁরা আরো অভিযোগ করেন, সাহারবিল ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান হিসেবে যিনি দায়িত্ব পালন করছেন মো. মহসিন বাবুল। তিনি নির্বাচিত হওয়ার ইতোমধ্যে একবছর পেরিয়ে গেছে। নির্বাচনের সময় তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন নির্বাচিত হওয়ার পর পরই মাতামুহুরী নদীর ভাঙন রোধে তিনি জোর পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু না, নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই তিনি আর কোনো খবরই নেননি। এমনকি তার কাছে এই বিষয়ে ধর্না দিলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

সাহারবিল ইউনিয়নের বাসিন্দা ও কালের কণ্ঠ শুভসংঘের চকরিয়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক আবুল মাসরুর আহমদ চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘ছোটকাল থেকেই দেখে আসছি সাহারবিল ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি বড় পাড়া ছিল। যা শীলপাড়া নামেই পরিচিত। গত ২০ বছরে অব্যাহত ভাঙনের কবলে পড়ে এই পাড়ার প্রায় ২০০ পরিবারের ঘরবাড়ি ইতোমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে অবশিষ্ট রয়েছে প্রায় ৫০ পরিবার। এসব পরিবারও ভাঙনের কবলে রয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘এই পাড়ার মাঝখান দিয়ে গেছে শীলপাড়া সড়কটিও। এই সড়ক দিয়ে প্রতিদিন আশপাশের কয়েকটি ইউনিয়নের অন্তত ৫০ হাজার মানুষ যাতায়াত করেন। তাছাড়াও চকরিয়া আনওয়ারুল উলুম কামিল মাদরাসা, বাটাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বি এম এস উচ্চ বিদ্যালয়, জি এন এ মিশনারি উচ্চ বিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তত ৫ হাজার শিক্ষার্থী এই সড়ক দিয়ে চলাচল করে। কিন্তু বর্তমানে সড়কটিও আর অবশিষ্ট না থাকায় যাতায়াতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সকলেই।’

তবে সাহারবিল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. মহসিন বাবুল চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘আমার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল মাতামুহুরী নদীর ভাঙন থেকে শীলপাড়া এবং সড়কটি রক্ষা করার। চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত

হওয়ার পর পরই আমি এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অংশ হিসেবে স্থানীয় এমপি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছ থেকে ডিও লেটার নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলীর কাছে আবেদন জানাই। সেই আবেদন বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হয়ে প্রতিবেদনের জন্য আসে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে। কিন্তু জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী গত একবছর ধরে সেই আবেদন ধরে রেখেছেন। অব্যবহিত এই সময়ের মধ্যে একবারের জন্যও নির্বাহী প্রকৌশলী বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো কর্মকর্তাই সাহারবিলের অন্যতম সমস্যা মাতামুহুরী নদীর এই ভাঙন এলাকা পরিদর্শনও করেননি। এরই মধ্যে বহুবার যোগাযোগ করেও কোনো ফলও আসেনি।’

চেয়ারম্যান মহসিন বাবুল চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘শুধু মাটি ফেলে এই ভাঙন ঠেকানো যাবে না। তাই আবেদনে আমি উল্লেখ করেছিলাম এই ভাঙন ঠেকাতে হলে সিসি ব্লক দ্বারা মাতামুহুরী নদীর তীর সংরক্ষণ করতে হবে। তা না হলে কোনো কাজেই আসবে না। তাই বিষয়টি নিয়ে আমি এখন থেকে আরো বেশি তৎপর হব। কেননা সাহারবিলের চার নম্বর ওয়ার্ডের হিন্দু সম্প্রদায়ের শীলপাড়ার অবশিষ্ট পরিবারগুলোকে যেকোনো ভাবেই রক্ষা করতে হবে।’

চকরিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাফর আলম  চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘সাহারবিলের চেয়ারম্যান মহসিন বাবুল আমার কাছ থেকে ডিও লেটার নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছেন।

মাতামুহুরীর করাল গ্রাস থেকে শীলপাড়ার বসতবাড়ি ও সড়কটি রক্ষায় আমিও ব্যক্তিগতভাবে তদবির শুরু করেছি পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের কাছে। ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সচিব কবির বিন আনোয়ার এবং প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম শামছুল করিম ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন পোল্ডার এবং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিদর্শনে আসলে তাদের কাছে নানা সমস্যা তুলে ধরেছি। এবং অচিরেই এসব সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন তাঁরা।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের চিরিঙ্গা শাখা কর্মকর্তা (এসও) মো. তারেক বিন ছগির চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘উপজেলার সাহারবিল ইউনিয়নের শীলপাড়া সড়কটি মাতামুহুরী নদীতে বিলীন হওয়ার বিষয়টি সত্য। বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পর ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানানো হয়েছে। হয়ত বর্ষা শেষ হলেই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে ভাঙন ঠেকাতে।’

এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান চকরিয়া নিউজকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা ছিল না। এই ভাঙনের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

পাঠকের মতামত: