ঢাকা,শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

কক্সবাজারে ভারী বর্ষণ ও সামুদ্রিক জোয়ারে ১০লাখ মানুষ পানি বন্দি: পাউবো বাধঁ মেরামতে বরাদ্ধ দেয়া ২৭৬কোটি টাকা ভাগভাটোয়ায় ব্যস্ত

coxsbazar pic- 25-07-2017জহিরুল ইসলাম, চকরিয়া :
গত ৪ দিনের অবিরাম বর্ষণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢ়ল ও আমাবস্যার জোয়ারে কক্সবাজার জেলার ৮উপজেলার ৭১টি ইউনিয়ন ও ৪টি পৌরসভার নদী, ছড়াখাল ও সমুদ্র তীরবর্তি এলাকার প্রায় ১০লাখ মানুষ পানি বান্দি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে মাতামুহুরী নদীতে বিপদসীমার ৪৫ সে.মিটার উপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন, কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। জেলার মাতামুহুরী, হারবাং ছড়া, বাইশ্যারছড়া, পাগলিরবিল, খুটাখালী ছড়া, ঈদগাও খাল, বাকঁখালী নদী, রেজু খাল ও নাফ নদীর দু-তীরে পানি সয়লাব হয়ে যাওয়ায় চকরিয়া, পেকুয়া, রামু, কক্সবাজার সদর, উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় বসবাসরত ১০লাখ মানুষ পানি বন্দি অবস্থায় মানবেতর দিনাতিপাত করছে। অপর দিকে আমাবস্যার জোয়ারের পানিতে দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার নিচু এলাকায় ভারি বর্ষণ ও জোয়ারের অথৈ পানিতে এলাকাকার হয়ে গেছে। নদীর ভাঙ্গনে ফসলি জমি, ঘরবাড়ি, দোকান পাট ও গ্রামীণ অবকাঠামো গুলো নদী গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে।
পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় কক্সবাজারের নদী ও সমুদ্র উপকুলে বসবাসরত মানুষের জানমাল রক্ষায় গত অর্থ বছরে এডিপি, এনডিআর ও ইমাজেন্সী খাতে বাধঁ মেরামত প্রটেক্টটিভ ওয়ার্ক ও বিধস্ত বেড়িবাধঁ সংস্কার ও পূন: নির্মাণসহ এবং রেগুলেটর নির্মাণের জন্য সব মিলিয়ে প্রায় ২৭৬ কোটি টাকার বরাদ্ধ দেয়। এরপরও উপকুলে বসবাসরত মানুষের কোন কল্যাণ বয়ে আসছে না পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের এ বিপুল পরিমাণ অর্থের? শুধুমাত্র পেকুয়া উপজেলার পোল্ডার নং ৬৪/২বি অধীনে পাউবোর বান্দরবান বিভাগের পেকুয়া সেকশনের অধীনে ১০টি প্যাকেজের আওতায় ৭৫ কোটি টাকার বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ওই ১০ প্যাকেজের অধীনে দায়িত্বপ্রাপ্ত ঠিকাদারদেরকে ৩০ কোটি টাকার বিল প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু ওইসব বাধঁ ভেঙ্গে জোয়ারের পানিতে মগনামা ও উজানটিয়া এলাকা সমুহে অথৈ পানিতে ডুবে গেছে হাজার হাজার বাড়িঘর।
এলাকাবাসী অভিযোগ করেছন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরাদ্ধ দেয়া অর্থে জনগণের কোন কল্যাণ না হলেও প্রদেয় বিলের বিপরীতে পার্সেন্টটেজ হিসেবে ৩ কোটি টাকার পকেটস্ত করেছেন ওই বিভাগের নির্বাহী প্রকেীশলী, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ও শাখা কর্মকর্তাসহ নিম্ম পদস্ত কর্মচারীরা।
অপরদিকে চকরিয়া উপজেলার ৬৫নং পোল্ডারের অধীনে কোনাখালী ইউনিয়নের কন্যারকুম ও কুরুল্ল্যাকুম এলাকায় বাধঁ সংস্কার ও মেরামতের জন্য এডিপি প্রকল্পের আওতায় ৩ টি প্যাকেজের অধীনে ও এনডিআর ও ইমার্জেন্সীসহ ৪ টি প্যাকেজের অধীনে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়। কাজের দায়িত্ব প্রাপ্ত ঠিকাদারদের কাজ সম্পাদনের বিলম্ব, অনিয়ম ও দূর্নীতির আশ্রয় নেওয়ায় বিধ্বস বেড়িবাধঁ দিয়ে জোয়ার ও বন্যার পানি ঢুকে চকরিয়ার উপকুলীয় ইউনিয়ন কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, বিএমচর, পূর্ববড়ভেওলা, পশ্চিমবড়ভেওলা, বদরখালী, বরইতলী, কেয়ারবিল ও সাহারবিল ইউনিয়নের প্রায় অর্ধশত গ্রাম বর্তমানে বন্যার পানিতে সয়লাব হয়ে পড়েছে। এদিকে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের বদরখালী উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীর অধীনে বদরখালী ও মহেশখালীর ধলঘাট সেকশনে শাখা কর্মকর্তা রয়েছে ১জন। তার অধীনে ধলঘাট শাখায় ৭০নং পোল্ডারে বাধঁ নির্মাণ ও প্রতিরক্ষা মুলক কাজের জন্যে এডিপি খ্যাতে ৩টি প্যাকেজের মাধ্যমে ২৪ কোটি টাকার ও এনডিআর এবং ইমাজেন্সী খ্যাতে ৬টি প্যাকেজে ৪ কোটি টাকাসহ সর্বমোট ২৮ কোটি টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হলেও সামান্য জোয়ার ও বৃষ্টির পানি ঠেকাতে পাচ্ছে না এসব সদ্য নির্মিত বেড়িবাধঁ।
এদিকে চকরিয়া পৌরশহরের ১নং গাইড বাধঁ ও শহর রক্ষা বাধঁ মাতামুহুরী নদীর ভাঙ্গন থেকে রক্ষার জন্য ১টি প্যাকেজের অধীনে সিসি ব্লক বসানোর জন্যে ৩ কোটি ৫০লাখ টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়। ওই স্থানে ভাঙ্গন সম্ভব হলেও এর পশ্চিম পাশের ভাঙ্গন তীব্র আকার ধারণ করায় যে কোন মুহুর্তে ওই বাধঁ ভেঙ্গে ফাসিঁয়াখালী ইউনিয়নের আংশিক এলাকাসহ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ড বিলিন হয়ে যাওয়ার আশংকা প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী। ইতিমধ্যে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড ভাঙ্গন এরাকায় বল্লির স্পার ও পানির বস্তা ফেলে ভাঙ্গন রোধে প্রচেষ্টা চালালেও তা টেকসই নয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার লোকজন। অন্যদিকে মাতামুহুরী নদীর ডানতীর সংরক্ষণ প্রকল্পের অধীনে পানি উন্নয়ন বোর্ড সুরাজপুর-মানিকপুর ও কাকারা ইউনিয়নে ৬০ লাখ টাকা বরাদ্ধ দিলেও এ বাধঁ দিয়ে বন্যার পানি ঠেকানো যাচ্ছে না।
সরেজমিন দেখা গেছে, চকরিয়া উপজেলার মাতামুহুরী নদীতে তীব্র বেগে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির স্রোতে কাকারা ইউনিয়নের চিরিঙ্গা-কাকারা-মাঝেরফাঁড়ি সড়কের প্রপার কাকারা পয়েন্টে সড়কের বিশাল অংশ তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। এই অবস্থায় নদীতীরের মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। দিগরপানখালী সড়ক কাম বেড়িবাঁধটি যে কোন মুহূর্তে ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। গেল বন্যায় ডুলাহাজারা ইউনিয়নের পাগলির বিলস্থ ছড়াখালের ভেঙে যাওয়া বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ছে। এতে বেশ কয়েকটি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিএমচর ইউনিয়নের কুরুইল্যারকুম পয়েন্টে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ব্যাপকভাবে ঢুকে পড়ছে বানের পানি। বরইতলী ইউনিয়নের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে অন্তত ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ইতিমধ্যে অনেক পরিবার বাড়িভিটে ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। একইভাবে চকরিয়া উপজেলার সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, কৈয়ারবিল, লক্ষ্যারচর, বরইতলী, হারবাং, কোনখালী, ঢেমুশিয়া, ডুলাহাজারা, সাহারবিলসহ ১৭ ইউনিয়ন এবং পৌরসভার অন্তত লক্ষাধিক মানুষ বানের পানিতে ভাসছে।
টানা ৪ দিনের অতিবৃষ্টির কারণে পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানি বেড়ে পেকুয়ার ৫ ইউনিয়নের অন্তত ২৫ টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্লাবিত ইউনিয়নগুলো হল টইটং, রাজাখালী, উজানটিয়া, শিলখালী ও বারবাকিয়া। ৫ ইউনিয়নের মধ্যে ২ ইউনিয়ন বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ও বাকি ৩ ইউনিয়ন পাহাড়ি ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়। এদিকে টইটং ইউনিয়নের চৌকিদার পাড়া গ্রামে দেয়ালধ্বসে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধা নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। নিহত বৃদ্ধা আনোয়ারা বেগম (৬৮) ওই এলাকার মোহছেন আলীর স্ত্রী। নিহতের পরিবারের লোকজন জানান, গত ২৪ জুলাই ঘরে পাহাড়ি ঢলের পানি উঠায় নিহত আনোয়ারাকে খাটের উপর বসিয়ে রেখে তারা ঘরের বাইরে কাজ করতে যান। এসময় হঠাৎ ঘরের দেয়াল ভেঙ্গে পড়ে। এতে ঐ বৃদ্ধা চাপা পড়ে ঘটনাস্থলে নিহত হন। পরে মাটি খুঁড়ে তাকে বের করা হয়েছে।
প্লাবিত ইউনিয়নগুলোর চেয়ারম্যান ও স্থানীয় লোকজনের সাথে যোগাযোগ করে জানা যায়, উজানটিয়ার রূপালী বাজার, গুদার পাড় পয়েন্টে, রাজাখালী বখশিয়া ঘোনা ও উত্তর সুন্দরী পাড়া, ভাঙ্গার মুখ পয়েন্টে ভেঙ্গে ২ ইউনিয়নের প্রায় ৯ টি গ্রাম প্লাবিত হয়। উজানটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম জানান, রূপালী বাজার ও গুদার পাড় পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে সুতাচুরা, নূরীর পাড়া, পেকুয়ার চর, ঠাণ্ডার পাড়া ও আতর আলী পাড়া পানির নিচে তলিয়ে গেছে। টইটং ইউনিয়নের ধনিয়াকাটা, রমিজ পাড়া, ভেলোর পাড়া, পুরাদিয়া, বড় পাড়া, কাচারী পাহাড়, বটতলী জুম পাড়া, চৌকিদার পাড়া, গুদিকাটা প্লাবিত হয়েছে।
কক্সবাজার সদর উপজেলার বৃহত্তর ঈদগাঁওতে প্রবল বর্ষণ আর পাহাড়ী ঢলে ২য় বারের মত বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে পড়েছিলো ঈদগাঁও বাজার সহ বিশাল এলাকার নিমাঞ্চল। এমনকি বৃহত্তর এলাকা প্রত্যান্ত গ্রামগঞ্জে শতকরা ৮৫ ভাগ ঘরবাড়ি পানি বন্দি হয়ে দূর্ভোগ আর দূর্গতির চরম পর্যায়ে পৌছেছে। বৃষ্টিপাত না কমানোর ফলে জেলা সদরের বৃহত্তর ঈদগাঁও তথা ছয় ইউনিয়নের নিমাঞ্চলে প্রচন্ড পরিমান বন্যা ও বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে পড়েছে। তবে বেড়েছে দূর্ভোগ। এদিকে ঈদগাঁও ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী বৃহত্তর মাইজ পাড়ার নাসি খালের কাঠের ব্রীজটি গেল বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় জন ও যানচলাচল বন্ধ বললেই চলে।
অন্যদিকে জালালাবাদ ইউনিয়নে গেল বন্যার ন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবারও। রাবারড্যাম পয়েন্টের বেড়িবাঁধ ভাঙ্গন আর ঈদগাঁও ফরাজী পাড়ার প্রধান যোগাযোগ সড়কের লরাবাক এলাকায় রাস্তা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে ঐ সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ। গত বন্যার পর থেকে উক্ত ভাঙ্গনকৃত বেড়িবাধটি ১৫ হাজার বালির বস্তা আর ৬শতটি বাঁশ দিয়ে দ্রুত গতিতে বেড়িবাধ সংস্কারের কাজ চলছিল। তৎমূহুর্তে প্রচন্ড বৃষ্টিপাত আর আবারো বন্যার পানিতে ঐ বেড়িবাধটি তলিয়ে যায়।

পাঠকের মতামত: