ঢাকা,রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪

ভেজাল ওষুধের রমরমা বানিজ্য, জনস্বাস্থ্য হুমকিতে

medicine_bd_pratidinঅনলাইন ডেস্ক :::

ভেজাল ওষুধের রমরমা বাণিজ্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি উৎপাদিত ওষুধের সুনাম রয়েছে। আছে চাহিদাও। কিন্তু স্থানীয় বাজারে চিত্র ভিন্ন। সু-চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে ভেজাল ওষুধ কিনে উল্টো নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এক শ্রেণির ওষুধ কোম্পানি বেশি মুনাফা লাভের আসায় তৈরি করছে বিভিন্ন ধরনের ভেজাল ওষুধ। এসব ওষুধ সেবন করে রোগীরা আক্রান্ত হচ্ছে জটিল ও কঠিন রোগে। অনেক সময় এসব ওষুধ সেবনে মারাও যাচ্ছে রোগী। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালালেও কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না ভেজাল ওষুধের দৌরাত্ম্য। এদিকে, ৩রা এপ্রিল আদালত দেশের ২৮টি কোম্পানির এন্টিবায়োটিক (পেনেসিলিন ও সফোলোস্পোরনি), হরমন ও ক্যানসার প্রতিরোধক ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। ২৮ কোম্পানির তিন ধরনের ওষুধ উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে রিটটি দায়ের করে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস পিস ফর বাংলাদেশ। এতে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক জিএমপি নীতিমালা যা আমাদের দেশে প্রচলিত আইনে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, তা না মেনে কোম্পানিগুলো উৎপাদন চালাচ্ছে। যে কারণে নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদিত হচ্ছে, যা জনস্বাস্থ্যের প্রতি মারাত্মক হুমকি। এ ব্যাপারে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ গণমাধ্যমকে জানান, সংসদীয় কমিটির একই রিপোর্টে আরো ২০টি কোম্পানির সব ধরনের ওষুধ এবং ১৪টি কোম্পানির এন্টিবায়োটিক ওষুধ উৎপাদন বন্ধেরও সুপারিশ করে বিশেষজ্ঞ কমিটি। কিন্তু সেগুলোর ব্যাপারেও পদক্ষেপ না নেয়ায় এর আগে রিট করা হয়। গত বছরের আগস্ট মাসে নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন করায় ৪৪টি ওষুধের রেজিস্ট্রেন বাতিল এবং ১৪টি প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের এন্টিবায়োটিক উৎপাদন বন্ধ করেছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। চলতি বছরেও এরকম ২৮টি কোম্পানির ওষুধ নিষিদ্ধ করল আদালত। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে বিভিন্ন সময় নাম সর্বস্ব কোম্পানিকে জেল জরিমানা করা হলেও তাদের টনক নড়ছে না। নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন করে কেউ কেউ কোটিপতি বনে যাচ্ছে। তবে নিম্নমানেরসহ নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন বন্ধে তারা বদ্ধপরিকর বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অ্যালোপ্যাথিক থেকে শুরু করে আয়ুর্বেদিক সব ওষুধেই মিলছে ভেজাল। ওষুধ কোম্পানিগুলো ডাক্তারদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে রোগীদের এসব ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। এসব ওষুধ খেয়ে কিডনি বিকল, বিকলাঙ্গতা, লিভার, মস্তিষ্কের জটিল রোগসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। পাশাপাশি রোগী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাদের মতে, নিম্নমানের ওষুধ খেয়ে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রতিকার পাওয়ার সুনির্দিষ্ট আইনও নেই বাংলাদেশে।
সূত্র মতে, গত বছরের শুরুর দিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি তৃতীয়বারের মতো ছোটবড় ৮৪টি ওষুধ কোম্পানি সরেজমিন পরিদর্শন করে অধিকাংশগুলোতেই  দেখে চরম হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, দেশে অর্ধশতাধিক কোম্পানিতে এখনও নিম্নমানের ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে! তারা জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুসারে যেকোনো ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) গাইড লাইন অনুসরণের বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করে দিলেও এখনও বহুসংখ্যক কোম্পানিতে জিএমপি গাইড লাইন অনুসরণের বালাই নেই। তবে কিছু কিছু কোম্পানি উদ্যোগী হয়ে আগের তুলনায় উন্নতি করেছে।
ওষুধ বিক্রেতারা জানান, তারা ব্যবসার জন্য বসেছেন। যারা ওষুধ সম্পর্কে বুঝে না তাদের দেয়া হয়। আর বেশির ভাগ লোক প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ নেয়। তাদের এসব ওষুধ দেয়া সহজ হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে ১৫ শতাংশ ওষুধই ভেজাল। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ ভেজাল ওষুধ তৈরি হয় ভারতে। এরপর নাইজেরিয়ায় ২৩ শতাংশ। এ দেশটির মোট ওষুধের মধ্যে ৪১ ভাগই ভেজাল ওষুধ। এরপরে রয়েছে পাকিস্তান যার শতকরা ১৫ শতাংশ ওষুধই ভেজাল। বাংলাদেশের ওষুধ নিয়ে কোনো গবেষণা করা হয়নি। তবে কোনো বিশেষজ্ঞর তথ্যমতে, বাংলাদেশে শতকরা ১০ ভাগ ভেজাল ওষুধ বিক্রি হয়। বাংলাদেশের ওষুধের সবচেয়ে বড় পাইকারি মার্কেট রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকা। ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরির অন্যতম আখড়াও হচ্ছে ঢাকার মিটফোর্ড এলাকা এবং এখান থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভেজাল ওষুধ ছড়াচ্ছে। এরপরও এখানে কোনো ওষুধ টেস্টিংয়ের ব্যবস্থা নেই। মিটফোর্ডের কিছু ওষুধ ব্যবসায়ী জানান, বেশির ভাগ ওষুধ কোম্পানিই এখান থেকে ওষুধের কাঁচামাল কিনে নিয়ে যায়। যে ওষুধগুলোর দাম বেশি ও সহজে পাওয়া যায় না সেসব ওষুধ ভেজাল করা হয়। ভেজাল কীভাবে করা হয় তা জানতে চাইলে তারা জানান, আসল ওষুধের কাঁচামালের সঙ্গে তারা খাবার সোডা, আটা, ময়দা, সুজি ও চিনি মিশিয়ে ওষুধ তৈরি করে। এটি পরীক্ষা ছাড়া ধরা সম্ভব নয়। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির জেমস্‌ পি গ্রান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথের সিনিয়র একজন গবেষক বলেন, স্বাস্থ্য সেবা পেতে গিয়ে রোগীরা শুধু ওষুধের পেছনেই ৬৫ শতাংশ অর্থ খরচ করে। গরীব রোগীরা আরও নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। ভেজাল ওষুধের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে তিনি বলেন, কোম্পানীগুলো অনৈতিক প্রতিযোগীতা করে নিম্নমানের ভেজাল ওষুধ তৈরি করছে। যে কারণে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে। তথ্যমতে, দেশে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ কারখানার সংখ্যা ২৮১টি, ইউনানির সংখ্যা ২৬৬টি, আয়ুর্বেদিক ২০৭টি, হোমিওপ্যাথিক ৭৯টি ও হারবাল ৩২টি। এসব কারখানায় মনিটরিং ব্যবস্থা নেই বলেই চলে। এ ব্যাপারে ওষুধ প্রশাসনের পরিচালক রুহুল আমিন জানান, তাদের অভিযান হচ্ছে রুটিন ওয়ার্ক। আদালত এর আগে ১৪টির নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এখন ২৮টি দিয়েছে। এছাড়া অনেক  মামলা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ সম্পর্কে মানবজমিনকে বলেন, এই ওষুধ শরীরের যে রোগের জন্য খাওয়া হচ্ছে, তার কাজ হচ্ছে না। এতে টাকা গচ্চা যাচ্ছে। একই সঙ্গে লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক ও অস্থিমজ্জা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

পাঠকের মতামত: