ঢাকা,বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

শুধুই গণহত্যার বিভীষিকা

77ফরিদুল মোস্তফা খান, কক্সবাজার থেকে  :::

নাফ নদীর বিশাল জলরশি যদি কথা বলতে পারতো, তাহলে কোন বিভীষিকার গল্প সে আগে বলতো? অপ্রশস্ত এই নদীপথ মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সীমান্ত নির্দেশ করে। এর পশ্চিম তীরে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগ। আর পূর্বে বার্মার আরাকান রাজ্য। এটা রাখাইন নামেও পরিচিত। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আবাস এখানে। মুসলিম সংখ্যালঘু এ গোষ্ঠীটি বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রহীন, বন্ধুহীন আর বিস্মৃত। কিন্তু নদীটি যদি তাদের গল্প মনে রাখতে পারতো, তাহলে হয়তো কথা বলে উঠতো। উদাহরণস্বরূপ, নভেম্বরের শেষদিকে এক রাত্রে ২৫ বছর বয়সী রোহিঙ্গা নারী আরাফা নিজের ৫ সন্তান নিয়ে এ নদীর পানিতে ভেলা ভাসায়। আগে তার সন্তান ছিল ছয়জন। নাফ নদীর বাংলাদেশ অংশে অস্থায়ী একটি শরণার্থী শিবিরে কুঁড়েঘরের দরজার মুখে বসে কথা বলছিলেন আরাফা। চারপাশে তার অল্পবয়সী মেয়ে আর এক ছেলে। উৎসুক আর চঞ্চল ছেলেপুলের এক দল। কিছুটা লাজুকও বটে। কখনো মায়ের পেছনে গিয়ে লুকাচ্ছে। পর মুহূর্তে ঘরের ভেতর-বাইরে দৌড়াচ্ছে। তার আরেক ছেলের ভাগ্যে কী জুটেছিল, সে কথা বলছিলেন আরাফা। ছেলেটির বয়স ছিল ৮। ২২শে নভেম্বরের আশপাশে কোনো একদিন তাদের গ্রামে হানা দেয় বার্মিজ নিরাপত্তা বাহিনী। দেশটিতে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে দেখা হয় রোহিঙ্গাদের। তাদের নাগরিকত্বের অধিকার প্রত্যাখ্যান করেছে রাষ্ট্র। দীর্ঘদিন ধরে এ গোষ্ঠীটি বৌদ্ধ জঙ্গি আর দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী উভয়ের হাতেই ভয়ভীতি, দমন-পীড়ন ও সহিংসতার শিকার। সর্বশেষ বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক সংঘাত ঘটে ২০১২ সালে। সেবার আরাকানি বৌদ্ধ আর রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যকার দ্বন্দ্বে বাস্তুচ্যুত হয়েছিল কমপক্ষে ১ লাখ ২৫ হাজার মানুষ। মানবাধিকার কর্মীরা নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল যে, তারা সহিসংতা ছড়িয়ে যাওয়ার সময় নির্বিকার দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে অথবা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। আরাফা বললেন, এ দফায় আর্মির আগ্রাসন ভিন্নরকম অনুভূত হয়েছে। এবারে রোহিঙ্গাদের শাস্তি দেয়ার জন্য নিরাপত্তা সদস্যদের আরো বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আরো বেশি উদ্বুদ্ধ বলে মনে হয়েছে। তাদের পছন্দের অস্ত্র ছিল আগুন। আরাফা জানান, আর্মি তাদের গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। তার বাড়িতে যখন আগুন লাগে তখন ৬ সন্তানকে নিয়ে কোনোমতে পালাতে সক্ষম হন তিনি। পালাতে গিয়ে বার্মিজ এক সেনার সামনে পড়ে যান। ৮ বছরের ছেলেটিকে পাকড়ে ধরে তার ভাইবোনের কাছ থেকে আলাদা করে জলন্ত অগ্নিকাণ্ডে ছুড়ে ফেলে ওই সেনা। এই হট্টগোলের মধ্যে আরাফা তার স্বামীকে হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু পেছনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। স্বামীকে পেছনে ফেলেই এগিয়ে যেতে হয় তাকে। পুড়ে কয়লা হওয়া ছেলের লাশ ফেলে রেখেই চলতে হয় তাকে। পালাতে থাকা অবস্থাতেই শোক আর বিলাপ করতে হয় তাকে। টাইম ম্যাগাজিনকে আরাফা বলেন, ‘আমার অপর সন্তানদের বাঁচানোটাই ছিল মুখ্য। আমাদের বার্মা থেকে পালানো ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ওরা সবকিছু পুড়িয়ে দিয়েছে।’

নাফ নদীর বার্মিজ অংশে জঙ্গলের মধ্যে দুদিন লুকিয়ে ছিলেন আরাফা ও তার সন্তানেরা। সেনাদের চোখ এড়াতে ঘাপটি মেরে পড়ে থেকেছেন। পরে জরাজীর্ণ এক নৌকায় উঠে পড়েন, যা তাদের নাফ নদীর অপর পাশে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যায়। তারা একা নন। গত দুই মাসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া আনুমানিক ২১ হাজার রোহিঙ্গার মধ্যে আরাফার পরিবার একটি। বার্মিজ বাহিনীর বর্বর অভিযান থেকে তারা পালিয়ে এসেছেন। শরণার্থীদের বিবরণ, মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সংগৃহীত উপগ্রহ থেকে ধারণ করা চিত্র আর আরাকানের ভেতর থেকে ফাঁস হওয়া ছবি ও ভিডিও সাক্ষ্য দিচ্ছে, ১০ লক্ষাধিক মুসলিম সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে বীভৎস রক্তাক্ত অভিযান চালানো হয়েছে। সাম্প্রতিক সমস্যা শুরু হয়েছে অক্টোবরের শুরুতে। পুলিশ বলছে, তিনটি সীমান্ত চৌকিতে ইসলামপন্থি জঙ্গিরা হামলা চালায়। এতে ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হয়। সরকার বলছে, হামলাকারীরা আকামুল মুজাহিদিন গ্রুপের সদস্য। বার্মিজ প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে তাদের ‘রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন’ সংশ্লিষ্ট বলে উল্লেখ করা হয়। এই ‘জঙ্গি’ গোষ্ঠীটি অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হতো। আর এসব দাবির একমাত্র প্রমাণ হলো সরকারের ভাষ্য।

 

পাঠকের মতামত: