ঢাকা,শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

সুপারভাইজারকে ড্রাইভিং শেখাতে গিয়ে দূর্ঘটনাটি ঘটে

ইমাম খাইর  :
কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রামুর রশিদনগর গ্যারেজ এলাকায় সুপারভাইজারকে ড্রাইভিং শেখাতে গিয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে।
এ ঘটনায় নারীসহ চার যাত্রী নিহত হয়। আহত হয় অন্তত অর্ধশত যাত্রী।
মূলত: ইউনিক পরিবহনের যাত্রীবাহী বাস (ঢাকা মেট্রো ব- ১৪-০১০৫) এর চালককে ঘটনার জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
ঘটনায় নিহতরা হলেন, ভৈরব জেলার বাসিন্দা মো. কাশেম (৪২), চকরিয়া উপজেলার পূর্বভেওলার মৃত কবির আহামদের স্ত্রী নূরুন্নাহার (৪০), পেকুয়া উপজেলার টৈটং ইউনিয়নের মো. শফিকের স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা (২২) ও কুতুবদিয়ার উপজেলার লেমশিখালী ইউনিয়নের মৃত এবাদুল্লাহর ছেলে মো. ফারুক (২০)।
রবিবার (১১ ডিসেম্বর) বেলা দেড়টার দিকে এ দূর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ীটি ঘটনাস্থলে রয়েছে। ঘটনার জন্য চালককে দায়ী করছেন যাত্রীরা। রবিবার রাত ৮টায় রিপোর্ট লেখাকালে নিহতদের মধ্যে দুইজনের মরদেহ জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়। তাদের স্বজনেরা লাশের জন্য হাসপাতালে পৌঁছে।
এদিকে মর্মান্তিক এই সড়ক দূর্ঘটনায় ৫ মাসের শিশুসহ আহত হয়েছে অন্তত ৪০ জন। জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত কয়েকজনের নাম ও পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হচ্ছেন- চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা এলাকার জামাল উদ্দিন (৭০), রংমহল এলাকার মনির আলম (৩৬), টেকনাফ সদরের গোদারবিল এলাকার আবুল হোসেন (৫০), তার মেয়ে উম্মে কুলসুম (৮), উম্মে হাবিবা (৪), চট্টগ্রামের পটিয়া বড়লিয়া এলাকার উত্তম মল্লিক (২২), বরগুনা আমতলি এলাকার ইঞ্জিনিয়ার আবদুল হাকিম (২২), আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সুমন (৩৬), মেহেদী হাসান (১৮), মোহাম্মদ শোয়াইব (২১), মো. জালাল (২৭), সাকিব (১৪), ছাবের আহমদ (৩৫), জান্নাতুল মাওয়া (৫মাস) রিয়াজ মোস্তফা (৪), আবদুল আলীম (৩০), নুরুল আমিন (৬০), (২২), মুবিনুল হক (৪৮), ছৈয়দ উল্লাহ (৩২), রেজাউল কাদের (২৫), তসলিম বেগম (৩৫)। বাকিদের নাম ও পরিচয় পাওয়া যায়নি। আহতদের হাসপাতালে দেখতে যান সিভিল সার্জন ডা. পুচনুর নেতৃত্বে একটি টীম। তিনি আহতদের স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর নেন। আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে কর্তব্যরত চিকিৎসক-নার্সদের আন্তরিক হওয়ার নির্দেশ দেন।
আহত যাত্রী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ সুমন সিবিএনকে বলেন, গাড়ী চলন্ত অবস্থায় ড্রাইভিং শেখানোর জন্য সুপারভাইজারকে চালকের আসনে বসানোর সাথে সাথে বিকট শব্দে গাড়ীটি উল্টে যায়। আমি গাড়ীর ৩ নং সীটে বসা ছিলাম। চালককে বলতে না বলতেই এই দুর্ঘটনাটি ঘটে যায়।
সুমন নিজেকে মানবাধিকারকর্মী পরিচয় দিয়ে সিবিএনকে বলেন, দূর্ঘটনার জন্য চালকই সম্পূর্ণ দায়ী। এ জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে আইনী ব্যবস্থা নেব।
আহতদের মধ্যে আরেক যাত্রী মেহেদী হাসান। তিনি চট্টগ্রাম হাজী ওমর গণি (এমইএস) কলেজের দ্বাদশ শ্রেনীর ছাত্র। মেহেদী কক্সবাজারে বেড়াতে বেড়াতে আসছিলেন।
দূর্ঘটনার বিষয়ে তিনি বলেন, আমি একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দে গাড়ীটি উল্টে যায়। চারিদিকে চিৎকার ছাড়া আর কিছুই শুনিনি। পরে দেখি, আমাকে হাসপাতালে আনা হয়।
আহত আরেক যাত্রী আবুল হোসেন চট্টগ্রামে একটি মাদরাসায় চাকরী করেন। মেয়ে উম্মে কুলসুম ও উম্মে হাবিবাকে নিয়ে টেকনাফে বাড়ীতে আসছিলেন। পথে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে আর বাড়ী যাওয়া হলোনা। হাসপাতালের বিছানায় দুই মেয়েকে বুকে নিয়ে কাতরাচ্ছেন তিনি। একইভাবে অন্যান্যদের আর্তচিৎকারে পুরো হাসপাতাল অঙ্গন ভারী হয়ে ওঠেছে।
আবুল খায়ের নামে স্থানীয় এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, ঘটনার সাথে সাথে স্থানীয়রা জেনারেটর বসিয়ে লোহা কাটার মেশিনের সাহায্যে গাড়ীর ভেতর থেকে লোকজনকে বের করে আনেন। এলাকাবাসী না হলো হতাহতের ঘটনা আরো বাড়ত। পরে উদ্ধারকর্মীরা তাদের সাথে যোগ দেয়।
রামু তুলাতলী হাইওয়ে পুলিশের পরিদর্শক আবদুল আওয়াল জানান, চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দিকে আসা ইউনিক পরিবহনের একটি বাস সড়ক দেবে গিয়ে খাদে পড়ে যায়। এতে বাসে থাকা থাকা যাত্রীদের মধ্যে চারজন নিহত হয়েছে।
তিনি জানান, দুর্ঘটনার পরপরই উদ্ধার অভিযানে নামেন ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স টিম পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী। তারা যৌথভাবে চালানো দীর্ঘ ৫ ঘন্টা উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে যাত্রীদের উদ্ধার সক্ষম হয়। এদের মধ্যে চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে দূর্ঘটনার পর সড়কের দু’পাশে শত শত বাস আটকা পড়ে। এতে চরম দূর্ভোগের সৃষ্টি হয়। দমকল বাহিনী, পুলিশ, বিজিবি ও সেনা সদস্যরা উদ্ধার অভিযানে যোগদিয়ে দীর্ঘ সাড়ে ৩ ঘন্টাপর সড়কে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনে।
রশিদনগর ইউপি চেয়ারম্যান এমডি শাহ আলম ও দূর্ঘটনা স্থলের বাসিন্দা এবং সৌদিয়া পরিবহণের লিংকরোড় কাউন্টার ম্যানেজার মো. রুহুল আমিন প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে জানান, চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ইউনিক পরিবহণের একটি বাস (ঢাকা মেট্টো-ব-১৪-০১০৫) দ্রুত গতিতে কক্সবাজার যাচ্ছিল। বেলা দেড়টার দিকে মহাসড়কের রামুর রশিদনগর গ্যারেজ এলাকায় পৌঁছামাত্র অকস্মাৎ চলন্ত গাড়িটি সড়কের উপর উল্টে যায়। এতে গাড়ির ভেতর চাপাপড়ে যাত্রীরা। ভেতর থেকে কান্না ও গুমরানির শব্দ আসছিল। এসময় পুরো রাস্তা ব্লক হয়ে সড়কের দু’পাশে শত শত বিভিন্ন ধরণের গাড়ি আটকা পড়ে।
খবর পেয়ে কক্সবাজার দমকল বাহিনী, রামু থানা ও হাইওয়ে পুলিশ, রামু ৫০ বিজিবি ও ১০ পদাতিক ডিভিশনের সেনা সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নেন।
রামু হাইওয়ে পুলিশের পরিদর্শক আজাদ বলেন, বাসের দু’পাশের বড়ি কেটে আটকে পড়া যাত্রীদের বের করা হয়। নারী-শিশুসহ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে প্রায় ৪০-৪৫ জনকে। যাত্রিদের অনেকের মাথা ফেটে গেছে, অনেকের হাতভাঙ্গা, পা কেটে রক্তাক্ত হয়েছে।
ঘটনাস্থলে থাকা রামু উপজেলা চেয়ারম্যান রিয়াজুল আলম বলেন, খোঁজ নিয়ে জেনেছি রামু হাসপাতালে আনা আহতদের মাঝে দু’জন মারা গেছেন। অবস্থার অবনতি হওয়ায় অনেককে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে প্রেরণ করেছে রামু উপজেলা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
রামু উপজেলা যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক নীতিশ বড়ুয়া সিবিএনকে জানান, দূর্ঘটনার পর পরই উদ্ধারকারিদের সাথে ঘটনাস্থলে গিয়ে জানতে পেরেছি, দূর্ঘটনা কবলিত বাসটি চালাচ্ছিলেন সুপারভাইজার। চকরিয়া এলাকায় চালক নেমে গেলে সুপারভাইজারই চালকের আসনে বসেন। একত তিনি অদক্ষ অন্যদিকে দ্রুত চালাচ্ছিলেন। বিষয়টি দেখে কয়েকজন যাত্রি তাকে নিয়ন্ত্রিত ভাবে গাড়ি চালানোর অনুরোধ করেও কোন কাজ হয়নি। গ্যারেজ এলাকায় সড়কের কিছু অংশ হালকা দেবে গিয়ে ঢেউয়ের সৃষ্টি করেছে। স্পীড বাড়ানো থাকায় ঢেউয়ে পড়ে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় মুসল্লীরা জানান।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালে জরুরী বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক রফিকুল ইসলাম বলেন, দূর্ঘটনায় আহত প্রায় ৩০ জনকে কক্সবাজার হাসপাতালে আনা হয়। এদের মাঝে দুজন হাসপাতালে পৌঁছার পূর্বেই মারা গেছেন।
ঈদগাঁও পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের ইনচার্জ দেবাশিষ সরকার কক্সবাজার নিউজ ডট কম (সিবিএন)কে জানান, অকল্পনীয়ভাবে চলন্ত বাস উল্টেগিয়ে সব যাত্রি ভেতরে আটকা পড়ার খবর পেয়ে ঈদগাঁও থেকে উপ-পরির্দশক (এএসআই) পিয়ারু ইসলামের নেতৃত্বে দ্রুত ফোর্স পাঠানো হয়। বেশ কয়েকজন আহত নারী-পুরুষকে ঈদগাঁও ও চকরিয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।
দমকল বাহিনী কক্সবাজার স্টেশন ইনচার্জ মো. আবদুল মজিদ জানান, বিজিবি-সেনাবাহিনী ও অন্যদের সহযোগিতায় অনেক চেষ্টারপর বেলা ৫টার দিকে দূর্ঘটনা কবলিত বাসটি সরানো সম্ভব হয়। বাসের বড়ি কেটে উদ্ধারকরা যাত্রীদের যে যেভাবে পেরেছে, হাসপাতালে নিয়ে গেছেন।

পাঠকের মতামত: