ঢাকা,শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

দাম বাড়ায় আগাম লবণ উৎপাদনে চাষিরা মাঠে

ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া ::solt

আমদানির কারণে টানা কয়েকবছর লোকসানের মাঝেও চলতি বছর হঠাৎ লবণের রেকর্ড পরিমাণ দাম বেড়ে যায়। এতে আশায় বুক বাঁধেন লবণচাষিরা।

তাই মৌসুম শুরুর নির্দিষ্ট সময়ের আগেই লবণ উৎপাদনে মাঠে নেমেছেন কক্সবাজারের ছয় উপজেলা ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার লক্ষাধিক চাষি। ধারণা করা হচ্ছে, এবার প্রায় ৭০ হাজার একর জমিতে উৎপাদন হবে লবণ। এদিকে এখনো লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেনি বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক)। সরেজমিন দেখা যায়, কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, কক্সবাজার সদর, টেকনাফ এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় লবণ উৎপাদনের জন্য মাঠ তৈরির কাজ চলছে জোরেশোরে। আবার অনেক স্থানে শুরু হয়ে গেছে উৎপাদন। সাধারণত আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবং উৎপাদন মৌসুমে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা গেলে চাষিরা দিনরাত শ্রম দিয়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন করে থাকেন। এরই মধ্যে কুতুবদিয়াসহ কয়েকটি এলাকায় লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে অধিকাংশ প্রান্তিক চাষি সহায়-সম্বলহীন হওয়ায় মহাজনের টাকায় লবণচাষের উদ্যোগ নিচ্ছেন বরাবরের মতো। কিন্তু কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ভারত, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশ থেকে লবণ আমদানির পাঁয়তারা নিয়ে তাঁদের মনে শঙ্কা কাজ করছে। প্রতিবছরই একশ্রেণির লবণমিল মালিক সরকারকে ‘ভুল তথ্য’ দিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করে থাকেন। এতে দরপতন ঘটে দেশে উৎপাদিত লবণের। এ কারণে একটানা কয়েকবছর মাঝপথে লবণ উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন চাষিরা।

বিসিকের কক্সবাজার লবণ প্রকল্প অফিস সূত্র জানায়, গেল মৌসুমে কক্সবাজারের চকরিয়া-পেকুয়াসহ ছয় উপজেলার উপকূলীয় এলাকার প্রায় ৬০ হাজার একর এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার ৭ হাজার ২৫৬ একর জমিতে লবণ উৎপাদনে মাঠে নামেন চাষিরা। সরকারিভাবে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৮ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। গত মৌসুমে উৎপাদন হয় ১৫ লাখ ৫৫ হাজার টন। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন কমায় স্থানীয় চাহিদা পূরণে সরকার দেড় লাখ টন লবণ আমদানির অনুমতি দেয় মিল মালিকদের।

মহেশখালীর লবণচাষি কল্যাণ পরিষদের সভাপতি ছৈয়দুল কাদের বলেন, ‘গেল মৌসুমের শেষ দিকে আবহাওয়া বৈরী থাকলেও সরকারের নির্ধারিত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়। এর পরও কোরবানির ঈদের সময় পশুর চামড়া সংরক্ষণে বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহের কথা বলে কিছু লবণ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেই সুযোগে কয়েক লাখ টন অতিরিক্ত লবণ আমদানি করা হয়। এতে একদিকে উৎপাদকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে ভারত ও মিয়ানমার থেকে পণ্যটি আমদানি করতে হয়েছে। ’

কক্সবাজারের লবণ শিল্প উন্নয়ন কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আফসার উদ্দিন বলেন, ‘নভেম্বরের শুরু থেকে লবণ উৎপাদন শুরু হলেও এখনো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক হয়নি। এ জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ’

আন্তঃমন্ত্রণালয় লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়। এবারও আন্তঃমন্ত্রণালয় লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করবে। ’

বিসিকের তথ্যমতে, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম উপকূলের লক্ষাধিক চাষি লবণচাষ করে থাকেন। আরো অর্ধ লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করেন। এতে দেড় লক্ষাধিক মানুষ লবণচাষের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।

এছাড়া লবণ পরিবহন, মিলিং ও বাজারজাত করার কাজে চার থেকে পাঁচ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত হয়ে বছরের প্রায় ছয় মাস জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। আর এসব কর্মক্ষম লোকের আয়ের ওপর নির্ভরশীল ২০ থেকে ২৫ লাখ লোক। এই লবণের ওপরই নির্ভর করে তাঁদের জীবন-জীবিকা। তাই লবণের বিষয়ে সরকারকে আন্তরিক হওয়ার দাবি জানান চাষিসহ লবণ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

কুতুবদিয়ার লবণচাষি নেতা হাছান কুতুবী ও হুমায়ুন কবির বলেন, গত বছর পর্যাপ্ত লবণ উৎপাদন ও দাম ভালো পাওয়ায় চলতি মৌসুমে প্রতি একর জমির লাগিয়ত ধরা হয়েছে ৭৫ হাজার টাকা। একজন শ্রমিক নিয়োগ হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায়। সেই হিসাবে একজন চাষিকে তিন কানি জমিতে পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয়েছে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। আবহাওয়া ভালো হলে ওই জমিতে উৎপাদন হতে পারে ৮০০ থেকে ৯০০ মণ লবণ। পুরো মৌসুমে মণ প্রতি গড়ে ৪০০ টাকা দাম না পেলে লাভের আশা অনিশ্চিত। বর্তমানে পুরাতন লবণ মণপ্রতি ৫০০ এবং নতুন সাড়ে ৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

কুতুবদিয়ার লেমশীখালী ইউপি চেয়ারম্যান আখতার হোছাইন, সদর উপজেলার পোকখালী ইউপি সদস্য আলাউদ্দিন জনি ও লবণচাষি নেতা সাইফুদ্দিন, ইয়াছিন উল্লাহ বলেন, লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত লবণ উৎপাদন হলেও কিছু অসাধু মিলমালিক এবং সুবিধাভোগী আমলাদের কারণে গত বছরও আড়াই লাখ মেট্রিক টন লবণ আমদানি করা হয়। এবারও যদি এসব কুচক্রী মহলের ফাঁদে সরকার পা দেয়, তবে কক্সবাজারের লাখো লবণচাষি পথে বসবেন।

বাংলাদেশ লবণচাষি সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট শহিদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘প্রকৃতির বৈরি আচরণ না থাকলে বা আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে এবার রেকর্ড পরিমাণ লবণ উৎপাদন হবে। চলতি মৌসুমে লবণ উৎপাদন ২০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে আন্তরিক হওয়ার আহবান জানাচ্ছি, যাতে সংকট দেখিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীরা বিদেশ থেকে লবণ আমদানির পাঁয়তারা করলেও সুযোগ না দিতে। ’

পাঠকের মতামত: